মাহবুবুল আলম //

সাহিত্য হলো মানুষের সুচিন্তিত ভাবনা, কল্পনার সুবিন্যন্ত ও সুপরিকল্পিত লিখিত রূপ। তাই সাহিত্য চর্চার মাধ্যেমে মানুষ তার চিন্তা ও কল্পনাশক্তির উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে সাহিত্য অনুশীলনে নিজকে নিয়োজিত করে নিজের ভেতরের আলাদা একটা জগত সৃষ্টির প্রয়াস পান; এবং এর মাধ্যমে তিনি তার ভেতর একটি শুদ্ধ ও পরিশীলিত সংস্কৃতির পরিমন্ডল গড়ে তুলতে পারেন। তাই মানুষ মাত্রেরই সাহিত্যের প্রতি এক অসীম আকর্ষণ করে থাকে। সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে একজন পাঠক এর রস আস্বাদন ও আনন্দ উপভোগ করে থাকে; হোক সেটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস গান প্রবন্ধ বা নিবন্ধ; সাহিত্য পাঠের মাধ্যমেই মানুষ অবসর বিনোদন বা মনের খোরাক সংগ্রহ করে থাকে।  লেখক তার পাঠকদের মনে রসবোধ, আনন্দ বেদনার বিনোদনের বিষয়টি মাথায় রেখেই তার সাহিত্যকর্ম রচনায় নিজকে নিয়োজিত করেন এবং তিনি তার রচনাশৈলীর মাধ্যমেই পাঠকের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান এবং উৎকর্ষতা সাধনের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন।

তবে একজন লেখকের সব রচনাই যে পাঠকের মানের উৎকর্ষতা সাধন বা আনন্দ বিনোদনের মাধ্যেম হিসেবে কাজ করবে এমনটি কিন্তু নয় বা তা কখনো হতে পারে আবার না ও হতে পারে। একজন মানুষের ভাল লাগা না লাগার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমালোচনা বিষয়টি। এ নিয়ে সাহিত্যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলেছে সমালোচনা সাহিত্য। সমালোচনা শব্দটির প্রতিশব্দ দপৎরঃরপরংস’ কে একালের ভাষ্যকার মার্টিন গ্রে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে- `criticism’ কে এককালের ভাষ্যকার মার্টিন গ্রে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- `the interpretation, analysis, classification, and  ultimately judgement of works of literature, which has become a kind of literary genre itself.”আর সাধারণ, একেবারে চলতি কথায় সমালেচনা বলতে গেলে, মনোভাবের বিরূপতা, এমনকি ছিদ্রান্বেষণও বোঝায়। তাই এটি সামগ্রিক যথাযথ যুক্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন। একজন সমালোচকের তাঁর ব্যক্তি মানসের ভাবনার সাথে সমালোচনাকে মিলিয়ে ফেলা উচিৎ নয়। কেননা, প্রত্যেক মানুষেরই দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনার বিস্তার এক নয়। সে হিসেবে একজন লেখক ও সমালোচকের বোধ ও ধারণায় মিল হবে তা কিন্তু নয়; এবং তা হয় না, তখনই সমালোচক ও লেখকের মধ্যে মতপার্থক্য, তিক্ততা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। আমরা প্রায়শঃ দেখতে পাই পক্ষপাতদুষ্ট সমালোচনা, ব্যক্তিগত আক্রোশ ও রসবোধের অভাবের কারণে বৈরী পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়ে থাকে। অপর দিকে সমালোচকের নিজস্ব পছন্দের কারণে কোন রচনা বা তার লেখক সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় উচ্ছ্বাস দেখাতে দেখা যায়। তাই এর কোনটাই আদর্শ সমালোচনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। একজন সমালোচক তার অনুশীলনের মাধ্যমে পর্যালোচনায় স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাবেন, যা খুবই স্বাভাবি বিষয়। কিন্তু এ কথাও তাকে স্মরণ রাখতে হবে তাঁর ব্যক্তিগত রুচি, ভাল মন্দ লাগার ভিত্তিতেই একটি সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন নির্ধারিত হবে না। সমালোচকদের থাকতে হবে উদারতা, সহৃদয়তা এবং সর্বোপরি রসবোধ, তা না থাকলে একটি শিল্প সাহিত্যের আনন্দ ও নান্দনিকতা যথাযথভাবে উপস্থাপিত হবে না।

সেই বিবেচনায়ই Richard Dutto সংজ্ঞায় বলেছেন- সমালোচনা হলো: The understanding and appreciation of literary texts.ঠিক কবে ও কখন থেকে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যেও সূচনা হয়েছে তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বাংলা সাহিত্যের সমালোচনার ইতিহাস ও দীর্ঘ দিনের নয়। এ বিষয়ে যতটুকু জানা যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ মাসিক পত্রে প্রথম বাংলা সমালোচনার সূত্রপাত হয়। এখানে বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ন, মধুসুদন, রঙ্গলাল, দীনবন্ধু প্রমুখের বহু গ্রন্থ সমালোচিত হয়, যার অধিকাংশই কালীপ্রসন্ন সিংহের রচনা। বঙ্কিম চন্দ্রের হাতেও বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের প্রসার ঘটে। ‘উত্তর চরিত’, ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’, ‘শকুন্তলা‘’ ইত্যাদি সমালোচনা প্রবন্ধে তিনি দক্ষতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্রের আগে ও তাঁর সমকালীনদের মধ্যে সমালোচনার ক্ষেত্রে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপÍ, মধুসুদন, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, চন্দ্রনাথ বসুও অক্ষয়চন্দ্র সরকারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ শিল্পবোধ, সৌন্দর্য-উপলব্দি, রসবোধ ও অধ্যায়নজাত পরিশীলিত মননে সমালোচনাকে দিয়েছেন এক স্বতন্ত্র মাত্রা। সমালোচনা সাহিত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি সাহিত্য ছাড়াও সমাজ, দর্শন, শিক্ষা ধর্ম ও দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে সমালোচনায় অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর প্রাচীন সাহিত্য, সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, সাহিত্যের পথে ইত্যাদি সমালোচনা গ্রন্থের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তাঁর সমসাময়িক সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, দীনেশচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল ও অজিত চক্রবর্তী ও সমালোচনা সাহিত্যে বিশেষ নৈপুন্য দেখিয়েছিলেন। রবীন্দ্র উত্তর সমালোচকদের মধ্যে বঙ্গবাণী ও বণীমন্দির এর লেখক শশাঙ্কমোহন সেন, কাব্য জিজ্ঞাসার অতুলচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রভৃতির নাম স্মরণ করতেই হবে। এছাড়াও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সাধনকুমার ভট্টাচার্য, জগদীশ ভট্টাচার্য, নরারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ন চৌধুরী, দীপ্তি ত্রিপাঠী, শঙ্খঘোষ সমালোচনা সাহিত্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। একই সাথে মোহিল লাল মুজুমদার যিনি পাশ্চাত্য সমালোচনার ধারাকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এছাড়া আরও অনেক বিদগ্ধ সমালোচক বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন। সৈয়দ আলী আহসান ও  হাসান হাফিজুর রহমান ও সমালোচনা সাহিত্যের বৃত্তভাঙার ঔদার্য ও বৈদº্যরে পরিচয় দিয়েছেন। তারা সততা, নিষ্ঠা ও প্রাজ্ঞতার সাথে সমালোচনায় বিশেষধারা সৃষ্টি করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ ‘শব্দের অনুসঙ্গ’ দুইটি মূল্যবান বই। আর সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে নির্মোহ নিরাসক্ত ছিলেন বলেই নজরুল সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সাথে একমত হতে পারেননি।

সমালোচক একটি শিল্পকর্মকে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর ইতিবাচক দিক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে নিবিড়ভাবে আলোচনা করেন। একটি রচনার ভাব, বিষয়বস্তু, ভাষার প্রয়োগ, রচয়িতার দৃষ্টি ভঙ্গি ও মানসদৃষ্টি এবং রচনাশৈলীর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তার ভাললাগা নালাগাকে যুক্তিগ্রাহ্যতার সাথে বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা সম্যকভাবে  ব্যক্ত করেন। সাহিত্যরচনা ও পাঠ বা অনুশীলনের পরেই তিনি শুরু করেন সাহিত্যের মূল্যবিচার। এ পর্যায়ে সমালোচক শিল্পের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ খুটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর সমালোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

একজন সাহিত্য সমালোচক কিভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে সমালোচক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমালোচনার কথায়’ এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন-‘ব্যক্তিগত ভাল লাগার ভাবোচ্ছ্বাস বা ভাল না লাগার নিরুচ্ছ্বাস ব্যস্ত থাকবেন না; তিনি যতসম্ভব নিস্পৃহ, নিরাসক্ত ও বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য বিচারে এমনভাবে প্রবৃত্ত হবেন যাতে পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের পরিচয়গত কোন বাধা, কোন আরোপিত নিয়মকানুনের বাঁধন না পড়ে।’ সে হিসেবে একজন সমালোচক তাঁর ব্যক্তিগত সংস্কার , পান্ডিত্যের অহমিকা দ্বারা পরিচালিত হন না। তিনি দায়িত্বশীলতার সাথে সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন সাহিত্যের গুণাগুণ। এই জন্য তাঁকে শিল্প ও সাহিত্য জগতের মূলনীতিগুলো গভীরভাবে জেনে তারপর নিজকে নিয়োজিত করতে হয় সমালোচনার কাজে। তিনি বিচক্ষণতার সাথে সাহিত্যের তত্ত্ব ও নীতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত হয়ে যুক্তি বিচার বিবেচনা দ্বারা পাঠকের মধ্যে আলোচিত সাহিত্য কর্ম নিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি আরও বলেছেন,‘সমালোচকের মধ্যে দশটি গুণের সমাবেশ থাকতে হবে। সে দশটি গুণ হলো: ভূয়োদর্শন, আত্মসমালোচনা, সতর্কতা ও পরমতসহিষ্ণুতা, লেখকের প্রতি সহানুভুতি, মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান, দার্শনিক অন্তর্র্দৃষ্টি, বিশ্লেষণ নৈপুণ্য, যৌক্তিকতার প্রতি নিষ্ঠা, নিস্পৃহতা লেখকের চিত্তভূমিতে অধিষ্ঠিত হবার স্বাভাবিক সামর্থ।’

কাব্য-কবিতা-গল্প-উপন্যাসে যে মৌলিকত্ব; সমালোচনা সাহিত্যে তা নেই। তাই সমালোচক ও সমালোচনা সাহিত্য সাহিত্যের একটি অন্যতম স্তম্ভ হলেও অনেকেই সমালোচনাকে সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ এবং সমালোচককেও সৃষ্টিশীলতার জন্য যথাযথ সন্মান দেন না। একজন কবি-প্রাবন্ধিক বা ঔপন্যাসিক যেমন তার কল্পনার নান্দনিকতা, আবেগ ভালবাসা ও রোমান্টিকতার রূপ দিয়ে থাকেন তেমনি একজন সমালোচক ও একটি সাহিত্যকর্ম এবং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করে পাঠকের বিস্ময় সৃষ্টি করে, তাদের আনন্দের যোগান দেন।

কিন্তু সাহিত্য ও সমালোচনা সাহিত্যের মধ্যে তফাৎ হলো সাহিত্য লেখকের সৃষ্টি হলেও সমালোচনা মূল সাহিত্যের ওপর নির্ভরশীল। তবে তিনিই আদর্শ সমালোচক যিনি লেখকের মতোই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে পাঠকদের কাছে সুপাঠ্য করে তুলতে বা মূল রচনাকে বোঝতে সাহায্য করা ছাড়াও পাঠককে উৎসাহিত করে রচনার রসাস্বাদনে  বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মিডলটন মারির মন্তব্য থেকে এ বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়-Òif it gives this delight, criticism is creative, for it anables the reader to discover beauties and significances which he had not seen those which he had himself glimpsed in a new and revealing light.Óবিশেষ কোনো  সৃজনী আবেগ-উদ্দীপনা, মন ও মননের কোন গুঢ় বিন্যাস থেকে একটি সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি হয়। সেই মানসিক আবেগ-উদ্দীপনার জন্মকথা তথা ক্রিয়াশীলতার রূপটি পুরোপুরি বোঝতে গেলে শিল্পকর্মটির রূপ ও অঙ্গিকের রহস্যটি উন্মোচন করতে গেলে একজন সতর্ক, সচেতন, বোদ্ধা পাঠকেরও প্রয়োজন। সমালোচক বাস্তবিক পক্ষে সেই বিশেষ পাঠক যিনি শিল্পকর্মটিকে তার সামগ্রিকতায় যাচাই ও ব্যাখ্য করার জন্য নিজকে যথাযথভাবে শিক্ষিত ও প্রস্তুত করেছেন এবং যিনি তাঁর সহৃদয় সৃষ্টিধার্মকতায়, তার আবেগ-মনন-কল্পনা শক্তিতে স্বতষ্ফর্তভাবে পুরো সৃজন প্রক্রিয়াটিকে সাধারণ পাঠকের মনে পুন:সৃষ্টিতে সক্ষম। এই বিবেচনায় একজন সমালোচককে হতে হয় খুবই জ্ঞান সম্পন্ন। তিনি ব্যক্তিবিশেষ হয়েও নৈর্ব্যত্তিক জনরুচির শ্রষ্ঠা। নিছক পান্ডিত্য-প্রদর্শন বা আমিই বেশি জানি বা বোঝি মনোভাব প্রকাশ উচিৎ নয়।

এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, আর সে কথাটি হলো সমালোচনার আদি পর্ব থেকে লেখক ও সমালোচকের মধ্যে বিরোধ ও অবিশ্বাসের এক অদৃশ্য কাঁচের দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। এটা আগেও যেমন ছিল এখনও তা ই আছে। এর জন্য দায়ী উভয় পক্ষই। লেখক যেমন সমালোকের নেতিবাচক সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি কোন কোন সমালোচকও সাহিত্যক্ষেত্রে বিভিন্ন রচনার ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোকেই প্রাধাণ্য দিতে গিয়ে এবং নিজের জ্ঞানের পরিধি ও প্রান্ডিত্য জাহিরে প্রবৃত্ত হন এবং নানা ধরনের ছিদ্র অন্বেষণ করে লেখকের লেখা নিয়ে আক্রমনাত্বক বক্তব্য প্রদান করে রচনাকে অখাদ্য-কুখাদ্য বলতেও কন্ঠাবোধ করেন না। তাই লেখক ও সুযোগ পেলেই সেই সমালোকচকের বিদ্যার দৌড় নিয়েও প্রশ্ন তোলতে দ্বিধাবোধ করেন না।

সমালোচনার ক্ষেত্রে কবিতার সমালোচনা নিয়েই সমালোচক ও লেখকের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিতর্ক বা যুদ্ধ চলে আসছে। তাই আমি আজকের এ নিবন্ধে সমালোচকদের প্রতি কিছু লেখক ও কবির মনোভাবের একটি খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই।

ড.ই. ণবধঃং সমালোচকদের টেকোমাথাধারী, আত্মপাতকভোলা, ঝুনোপন্ডিত এবং পোকা বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি সমালোকদের কাজের ধরন সম্পর্কে বলেছেন-এরা মূলত যা করে তা হলো, পঙ্ক্তি, ছন্দ ও অন্তমিল খুঁজে খুঁজে কাশিতে কালি ছিটাতে থাকে। আর রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ সমালোচকদের প্রতি ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন-

“বরং তুমিই লেখো নাকো একটি কবিতা-/ বলিলাম ম্লান হেসে ছায়াপি দিলনা উত্তর;/ বুঝিলাম সেতো কবি নয়-সে যে অরূঢ় ভণিতা/ পান্ডুলিপি, ভাষ্য, টিকা কালি আর কলমের ‘পর বসে আছে সিংহাসনে-কবি নয় অজর অক্ষর/ অধ্যাপক দাঁত নেই-চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি/ বেতন হাজার টাকা মাসে-আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি/ যদিও সেসব কবি ক্ষুদা আর আগুনের সেঁক/ চেয়েছিল-হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি। (সমারূঢ়: জীবনানন্দ দাশ)

আর বর্তমান সময়ের আলোচিত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আধুনিক কবি ও কবিতার ঘোর সমালোচনাকারীদের প্রতি চরম ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এমন উচ্চারণ করেছেনÑ

ধর্ষকামে মত্ত ছিল তারা/ আহা প্রাজ্ঞজনা বিত্তশালী সমালোচনায়/ ও বোন কবিতা তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?/ এ যদি উপমা খোঁজে, বাকিগণ রূপক সন্ধানী/এ যদি কৈবল্যবাদী বাকিগণ ছন্দবিশারদ/ এ যদি শৃঙ্গার প্রিয়, বাকিগণ সঙ্গমবিলাসী/ এ যদি করেছে চিৎ বাকিগণ উপুর করেছে/ সাধু, সাধু প্রাজ্ঞজনা...কামশাস্ত্রে পার্থক্য খচিত/ ধর্ষকামে মত্ত ছিল তারা/ (কবিতা বিষয়ক সেমিনার: আবু হাসান শাহরিয়ার)

সমালোচনার সংস্কৃতি যে সমাজ বা রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে সে সমাজ বা রাষ্ট্রে তৈরি হয় সৃষ্টিশীল মানুষ। সমালোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠা একজন মানুষ পরিশীলিত, আদর্শবান  উচ্চ মননশীল হতে বাধ্য। এ বিষয়টি আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বেলায় আরো বেশি প্রযোজ্য। তবে এক্ষত্রে সমালোচকের দায় ও কিন্তু অনেক। একজন মেধাবী, সৃষ্টিশীল ও প্রতিভাবান সমালোচককে যে কোন শিল্প মাধ্যম বা শিল্পীর মৌলিক প্রতিভা যতটা উৎকর্ষ মানের বা কতটা নিকৃষ্ট বা নিচু মানের তা ব্যাখ্যা করতে হয় তাত্ত্বিকভাবে। বিশ্লেষণ করতে হয় তার অভিজ্ঞতা, দুর্বলতা, অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধতা এবং ভুল ত্রুটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হয় ভাষা, শিল্প সাহিত্যের সব ধরনের নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনেই। তবে তা করতে হয় যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্যতার মাধ্যমে। এখানে আবেগ, পক্ষপাতদুষ্টতা আক্রমন বা অধিক পান্ডিত্য দেখানোর কোন অবকাশ নেই। শুধুমাত্র একজন প্রকৃত ও ন্যায়নিষ্ট সমালোচকের সমালোচনার মাধ্যমে আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রে শুদ্ধ ও পরিশীলিত সাহিত্য, সংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে ওঠতে পারে।

আর যাকে সমালোচনা করা হলো তাকেও সমালোচনা গ্রহণ করতে হবে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং যা সমালোচিত হলো তা শুদ্ধ ও পরিমার্জন করার জন্য থাকতে হবে উন্নত মনমানসিকতা তা না হলে সমালোচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কখনও কল্যাণকর কিছু উপহার দিতে পারবে না সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশের মানুষকে।

 

 

 

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ