সত্ত্বার সন্ধানে

নীলাঞ্জনা নীলা ১০ এপ্রিল ২০১৫, শুক্রবার, ০৯:৩১:২১পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, গল্প ২০ মন্তব্য

10491166_650828205022261_4201017364894487040_n
নিজের ভেতরে বেঁচে আছি। এই যে ভেতরের গভীরে আমি, সে-ই সত্য। উপরের হাসি-কান্না এসব মেকী। আমার এই যে পৃথিবীটা তাকে তার মতো সাজাতে পারিনি বলেই তো নিজেকে অপরিচিত লাগে। অন্যের জীবনে বেঁচে থাকাকেই একদিন ধাক্কা দিয়ে উপড়ে ফেলতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি, "এই তুমি কি সত্যিকারের তুমি? কে তুমি?" প্রশ্নের পর প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হবার মতো জায়গা খুঁজে পায়না। এতো ভীড় কেন চারদিকে? কোথায় যাবো, পথ অনেক। নিজেকে খুঁজে নিতে গেলে বুঝি সবকিছু থেকে ছিন্ন-ভিন্ন করতে হয়?

বৃত্তের বাইরে যেতে আমার ভয় লাগেনা, ভাবনাও আসেনা। ভয় হয় এই যে রোজকারের মতো পাকা রাঁধুনী হয়ে হেঁসেল ঠেলছি, আটটা-পাঁচটা অফিস করছি, বাড়ী ফিরে আবার পাকা গিন্নী এবং দায়িত্ত্বশীলা মায়ের ভূমিকায় চারদেয়ালের এই মঞ্চে অভিনয় করছি। আর কতো বাহবা মিসেস সৌরভের মতো এমন মহিলা এ যুগে কমই আছে। নিজের নামটা জানি কি ভুলেই গেছি। সূর্যর মা, সৌরভের বৌ এই যে পরিচয়, এই মুহূর্তে সব ফেলে চলে যেতে পারি। পথকে ভয় করিনা, যতো ভয় ঘরকে। ঘর-ই সবথেকে ক্ষত-বিক্ষত করে। চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বর জন্ম দেয়। নিজের পছন্দ কিংবা অপছন্দ পথ দেখেনা, ঘর চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। ভুল যতো দেখায়, তার চেয়ে বেশী আঘাত করে। তবে এসব কিছুর সমাপ্তি আজ হতে যাচ্ছে।

---'মা আজ ফিরতে দেরী হবে।'

এই হলো আমাদের ছেলে সূর্য। নামটা রেখেছিলো ওর বাবা। মনে মনে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ওর নাম হবে অরণ্য। সবুজের মতো শান্ত-আদুরে-আহ্লাদী। সৌরভকে বলতে যাচ্ছিলাম আগেই বলে দিলো ওর নাম হবে সূর্য। প্রচন্ড তেজ, আলোয় ভরিয়ে দেবে। কিচ্ছু বলিনি। মনে হলো থাকনা ওর এতো ইচ্ছে। এরপর যখন মেয়ে হলো বললাম সৌরভ আমি একটা নাম রেখেছি নদী। ও বলে উঠলো, 'ধ্যৎ আমার মেয়ে কি শুধু বয়ে যাবে? আর পাড় ভাঙ্গবে? কিছুতেই না। ওর নাম স্বাতী। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।' আমার অরণ্য আর নদী মনের কোন কোণায় যে ছিলো, আর কবে যে সেটা হারিয়ে গেছে।
সৌরভ জানেইনা আমার আলাদা একটা সত্ত্বা আছে। একটা অনুভূতি। এমনকি প্রকাশভঙ্গী। ভেবেছিলাম এভাবেই চলে যাবে দিন। জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত নীরবে কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমার ভাবনাগুলো তো প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে।

11150225_650828171688931_282419355823693268_nতবে আর না। এতো বছরের দাম্পত্যজীবনের সমাপ্তি হওয়া খুব জরুরী। আর আজ সেই দিন। আমার ব্যাগ গোছানো, ট্রেনের টিকিট কাটা, সন্ধ্যের সময় ছাড়বে। স্বাতী-সূর্য দেখেও কিছু বলেনি। সৌরভকে জানিয়ে দিয়েছি, তাড়াতাড়ি ফিরলে দেখা হবে, নয়তো না। চাবি পাশের বাসায় রেখে যাবো সেও বলেছি। আর মাত্র দুটি ঘন্টা, এরপর আমার জীবনের অন্য অধ্যায়। নিজস্ব নাম, মতামত দেয়ার একটি প্লাটফর্ম। চাকরীটায় যখন রিজাইন দেই, বস অবাকই হলেন। বাইশ বছরের সংসার আর উনিশ বছরের চাকরী। অনেক কথা বলা মেয়ের ধ্যৎ মেয়ে কই আর? মহিলা! সে তার জগৎ ছাড়া নিজের আসল রূপ কাউকে কোনোদিনই দেখায়নি। আর বিয়ের পরে সৌরভ সেই মেয়েটির সত্যিকারের সেই চরিত্রকে আগলে নেয়নি। আর তাই হয়তো ছেড়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে উঠতে পারেনি। তবু একটা আলগা টান কাঁচের ওই ছোট্ট শো-কেসে ছোট্ট পুতুলটার জন্য। নিজের টাকায় স্বাতীর জন্যে কেনা, তার পাশে একটা পাখী। আমার মনে মনে নাম দেয়া অরণ্যর জন্যে। অরণ্য আর নদীর রুমটা এখন ওদের মনের মতো সাজানো। আমি ওখানে হাত রাখিনা। নিজের সত্ত্বার দাম পাইনি বলেই হয়তো ওদেরকে সেটা বুঝতে দেইনা। আর সৌরভের রুম, ওই বিছানাটাই তো স্পর্শ আমাদের। আর কোথাও কি কোনো দাগ আছে যা আমায় আটকে রাখতে পারে? হুম আছে, ওই আয়নার সামনে একদিন বুকে টেনে নিয়ে আদর। তারপরেই জোরালো ধাক্কা, বাবা-মাকে নিয়ে বাজে উক্তি। সেই যে শুকিয়ে গেলো আবেগ, আর ফিরে আসেনি। তাও থেকেছি, কারণ আমার কোথাও যাবার ছিলোনা। যে চাকরী তা দিয়ে চলার ক্ষমতা ছিলোনা। শুনলে মনে হতে পারে আমি খুব স্বার্থপর, ব্যবহার আমিও করেছি। কে ব্যবহার করেনা? কারুরটা দেখা যায়, কারুরটা না। ছোট ছোট আবেগ যখন চোখের সামনে পায়ের নীচে চটকে যায়, তখনই মানুষ মুখোশের ভীড়ে নিজেকে পুরে নেয়। আমিও তাই। শুধু মা হয়ে পারিনি মুখোশ পড়তে। কিন্তু সন্তান যখন মাকে ব্যবহার করে, অভিনয় করে মিথ্যে দেয়, তখন আর কিচ্ছু থাকেনা।

সিনেমা-নাটকের মতো কোনো চিঠি লিখিনি কাউকে। শুধু বলেছি আজ পাঁচটায় আমার ট্রেন। কেউ কিছু জানতে চায়নি। বাইশ বছরে এই প্রথম আমার কোনো ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়নি। আরেকটি বার চাইলাম এমন কিছু কি আছে যার জন্যে নিজেকে আর যেতে হবে না? ওই গাছগুলো, যারা আমার স্পর্শ না পেলে নেতিয়ে পড়ে। তার দায়িত্ত্বও দেখেছি স্বাতী নিয়েছে। আর স্বাতীকে ভালোই চিনে নিয়েছে। নাহ আর কোনো পিছুটান নেই আমার। স্যুটকেসটা টেনে নিলাম, কেউ আসেনি।

ট্রেনটা ছেড়ে দিলো, নাগরিক জীবনের কোলাহল ছাড়িয়ে দু'পাশের ঘন অরণ্যে বিভোর হলো মন। কতো বছর পর! স্বপ্ন বলেছিলো আমায় নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে ট্রেনলাইনের পাশের ওই পথটা ধরে। যাওয়া হয়নি। একসময় আফসোস হতো, কি যন্ত্রণা! অরণ্য আর স্বাতীর জন্মের পর সেসব চলেও গিয়েছিলো। এরপর আর ফিরে আসেনি। আজও এই এখনও মনে করার জন্যে মনে পড়া, এটুকুই।

ট্রেনটার গতি বাড়ছে।

11101258_650828185022263_5332321196142899293_n

গ্রীনলাইফ হাসপাতাল, ঢাকা
১৫ মার্চ, ২০১৫ ইং।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ