জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...

আমাদের হেডস্যার ক্লাশে আসতেন যখন, পুরো ক্লাশ তটস্থ থাকতো। আমাদেরকে ইংরেজী পড়াতেন। স্যারের ভয়েও জানা পড়া ভুলে যেতো। তবে আমাদের ক্লাশে রেহানা-মনি-ঊষা-ঝর্ণা-শেফালী এই পাঁচজন প্রতিদিনই মার খেতো, তারপরেও পড়া শিখে আসতো না। আর রেহানার মতো হাসি-খুশী-দুষ্টু-ভালো মেয়ে কম দেখেছি। অভিনয় জানতো না। শুধু পড়ালেখা করতোনা তাই মার খেতো রোজ। স্যার যখন ক্লাশ নিতেন দরোজার বাইরে আমাদের স্কুল দপ্তরী মন্নাফ দাঁড়িয়েই থাকতো হাতে দুটো বেত নিয়ে। একদিন মন্নাফকে স্যার স্কুলের কাজে বাইরে পাঠালেন, রেহানা খুব খুশী। আজ মন্নাফ নেই বেত নিয়ে তো স্যার নিজে আসেন না। কপালের ফের ক্লাশ শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগেই মন্নাফ চলে এলো। স্যার ভালো করে পেটালেন, তারপর ঠিক সময়ে গেলেন। এই স্যারের বেতের মার খেয়েছি আমি। জীবনের দ্বিতীয় বেতের মার বলে কথা! আমার থেকে স্যার কখনোই কোনো ভুল পাননি। একদিন স্যার এসে Tense নিয়ে পড়াচ্ছেন। আর মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। এমন ঘুরিয়ে প্রশ্ন করছিলেন অনেকেই জেনেও উত্তর দিতে পারছিলো না। আমাদের তারাবতীও পারলোনা। স্যার তো ক্ষেপে শেষ। চরম গালাগাল, "হিদইল-হুকুইন(শুটকী মাছ) খাইয়া আইলে মাথার মধ্যে কুন্তা ঢুকবোনি?" রেহানা চরম শয়তান, বললো "স্যার মন্নাফ তো রোজ আপনার বাড়িত হিদইল-হুকুইন কিনিয়া নেয়। আমরার অতো পয়সা নাই রোজ ইতা খাইবার।" স্যার তো মারাত্মক রেগে গিয়ে সবাইকে মারলেন। ওই কথার জন্য যে তা নয়। পড়া কেউই পারেনি, তার উপর মুখে মুখে কথা। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, "ওই তোরা হজ্ঞলগু দেখ, এই মাইয়া হিদইল-হুকুইন খায়না, মাথাও ঠিক আছে।" স্যারের মুখে চুনকালি ফেলে কাঁপতে কাঁপতে Is-এর জায়গায় Was বসিয়ে দিলাম। আর যায় কোথায়, মাত্র একটা মার। আধাঘন্টার মধ্যে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, হাত ফুলে ঢোল। মামনি আমাকে নিয়ে বাসায় গেলো। সন্ধ্যার সময় স্যার বাসায় এলেন। শুধু কপালে হাত দিয়ে জানতে চাইলেন ব্যথা কি বেশী? মামনিকে বললেন, "এম.আর.ডি ম্যাডাম আপনার মেয়েটা ব্যথা লুকাতে জানে। আল্লাহ যেনো এরে কোনো কষ্ট না দেয় আমি দোয়া জানাবো নামাজে বসে।" বাপি আসতেই বললেন স্যার "জীবনে আজ প্রথম একটা অন্যায় করেছি করুণাবাবু। মেয়েটারে মেরে।" বাপি বললো "পড়া পারেনি, মেরেছেন এটাই আপনার দায়িত্ত্ব স্যার।" স্যারের কষ্ট হচ্ছিলো একটা মারে এতো জ্বর, হাত ফুলে গেছে উনার জীবনে এমন দেখেননি। নাহ স্যারের পায়ে ধরে প্রণাম করে আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম অনেক বড়ো মুখ নিয়ে বলেছিলেন আমি পারবো। কিন্তু পারিনি। স্যার আমায় অনেক ভালোবাসতেন। আমায় নিয়ে স্যারের খুব গর্ব ছিলো। আমি কি না কি জানি হবো!

মজা হলো মাষ্টার্স পরীক্ষার পর বাসায় এলাম। স্যার বাসায় এসে বললেন, "এভাবে বসে থাকলে চলবে? স্কুলে তোমার মতো মেয়েদের দরকার।" পরেরদিন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। সেই পরিচিত টিচাররা অনেকেই আছেন। তাঁদের সামনে চেয়ারে বসা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। আমাদের স্কুলের আয়া সবাই ডাকতো উনাকে কামালের মা। আমি কিছুই ডাকতাম না। কারণ কামালের মা মামনিকে ডাকতেন বৌদি বলে, আমার সহপাঠীরা কেউ ডাকতো আপা আর কেউ কামালের মা। উনার সামনে গিয়ে বললাম কোনো টুল কি আছে বসার? স্কুলের স্যার-ম্যাডাম বললেন, "নীলাঞ্জনা তুমি এখন আমাদের কলিগ।" তারপরেও সেখানে চেয়ারে বসতে পারিনি। ছয় মাস ছিলাম ওখানে, তারপরেই কলেজে চাকরী পেয়ে যাই। যখন চলে আসি ছাত্রীরা যতোটুকু মন খারাপ করেছিলো, ঠিক স্যার-ম্যাডামরাও।

এই স্কুল অনেক স্মৃতি। স্যার-দিদিমনিদের আদর-স্নেহ সব একেক করে আসবে। প্রধান শিক্ষক বশির আহমদ স্যারের একটি কথা দিয়ে আজকের পর্বের ইতি টানছি। "আল্লাহ সবাইরে সবকিছু দেয়না। যেটুকু দেয়, বুঝিয়া-শুনিয়াই দেয়। তোমারে একটা কথা কই, জীবনে পাশে কে থাকলো, কে না থাকলো সেইটা দেখতে যাইও না। আল্লাহ চোখ দিছে, আর দিলও দিছে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখলে খোদা-ভগবানেরও সাধ্য নাই ওই বিশ্বাস ভাঙ্গার।" সেদিন শুনেছি স্যার সুস্থভাবে আছেন। ভালো লাগলো। জানিনা কবে দেখা হবে। কিন্তু বিশ্বাস রাখি দেখা হবে, স্যারের সাথে একটা ছবি তুলে রাখতে চাই শুধু নিজের জন্য।

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
১০ জুলাই, ২০১৬ ইং।

যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন (দ্বিতীয় ভাগ)

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ