“বাবা যখন রাধুনী”

জাকিয়া জেসমিন যূথী ১৪ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ০৮:৫৬:৫৫পূর্বাহ্ন গল্প ২৯ মন্তব্য

 

সকাল থেকে কি হয়েছে জানিনা। আমি এমনিতেই ঘুম থেকে সকাল দশটার আগে উঠিনা। আগের রাতে মা বকেছিলো! “সারাদিন কম্পিউটার নিয়েই পরে থাকো! সংসারের কাজে একটুও মন দিও না! আমি কাজ করতে করতে মরে যাই!” কথাটা খুব গায়ে লেগেছিলো! সাথে সাথে কম্পিউটার বন্ধ করে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পরেছি।

অন্যান্য রাতের চেয়ে দুই ঘন্টা আগে শুয়েও রাত প্রায় সাড়ে তিনটা পর্যন্ত এপাশ আর ওপাশই করেছি। ঘুম কেন হলোনা বুঝলামনা! আমি তো ভীষণ ঘুমকাতুরে। ঘুমের মধ্যে কেউ তুলে নিয়ে গেলেও টের পাবো না এমন গভীর! তার উপর মোবাইলে ফজরের এলার্ম বেজে উঠেছে চারটা বেজে দশ মিনিটে। তারপরে নামাজ পড়ে শুয়েও একই অবস্থা! এই কাত আর ওই কাত! একবার ডানে । একবার বামে! ঘুমের পুরোই ফালুদা! কিচ্ছু ঘুম হয়নি! বিবেকে নাড়া খেলো বুঝি!

সকাল নয়টায় আবারো ঘুম ভেঙ্গে গেল এলার্ম এর শব্দে। ঘুম হয়নি তাই রাতে যতই রাগ করে সকাল সকাল উঠবার কথা বলি না কেন উঠতে ইচ্ছে করলো না! শুয়েই রইলাম। তারপরে উঠলাম আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর।

শোয়া থেকে উঠে দাঁত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেতে বসে দেখি আব্বা-আম্মার তর্ক চলছে। আম্মা বলছে, “রাইন্ধা একেবারে উদ্ধার করবা!”

আব্বা বলে উঠলেন, “তোমার চেয়েও ভালো পারবো! যাও টিভি দেখো গা! এদিকে আসবা না!”

আব্বাকে সবসময় খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখি ঠিকই। কিন্তু আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসলেও ঝামেলা তৈরি করে ফেলে। গ্লাসে পানি ঢালতে গেলে টেবিলে পানি দিয়ে একাকার করেন। ভাত খেতে বসে প্লেটের চারদিকে ভাত ফেলে বিদিকিছরি অবস্থা বানান। ফ্রেশ রুমের বেসিনের আয়নায় দেখে দাড়ি মোছ ছেটে বেসিনে পানি না দিয়েই চলে আসেন। আরেকজন গিয়ে দেখে পুরা বেসিনে কালো কালো ছোটছোট চুলে ঢেকে আছে। এরকম আরো অনেক অনাসৃষ্টি!

মা তাই বিরক্ত এবং অনিশ্চিত। না জানি আবার কি ভেজাল লাগাবে। আর রান্নার সময় পেরিয়ে গিয়ে সব তখন না খেয়ে বসে থাকবো।

আমি রাতের অভিমান ভুলে আব্বা-আম্মার টেলিফিল্ম দেখতে বসলাম।

রান্না করতে বসেছে। কোন্ পাতিলে রানবে। মাছ কিসে ধুবে। কিছুই তাল পাচ্ছে না! আমি রান্না ঘরের দরজার সামনেই খাবার টেবিলের চেয়ারে বসে আছি। না আম্মাকে ডাকছি বাবার কান্ড দেখে যেতে! না আব্বাকে কিছু এগিয়ে দিয়ে হেল্প করি! চরম বদমাশের মত বসেই আছি।

একটু পরেই মায়ের ডাক পরলো,
- এইই, পেঁয়াজ বাটা লাগবে!
- আমরা পেঁয়াজ বাটি নাকি? কুচি করে কেটে দেই।
- দেও কুচি কইরা!
- এহ্, নিজে রান্তে চাইছো। নিজেই কইরা ন্যাও! আমারে কও ক্যাঁ!
- যাহ্ লাগবো না। পাটা কই? আমিই বাইটা নিতেছি!
থালাবাসনের স্ট্যান্ডের নিচে পাটা আছে। দেখিয়ে দিলো মা।

পাটা বের করে শিল ধোয়ার খবর নেই। আগেই বাঁটতে বসে যাচ্ছে! আম্মা হায় হায় করে উঠলো, “আরে করো কি?  পাটা কি কোনকিছু দিয়া ঢাকা থাকে? ইঁদুর উঠে। তেলাপোকা বসে। ধুলা পরে না? এইটা না ধুইয়াই বাটতে লাগছো! এরেই কয় পুরুষ মানুষের কাম!”

আম্মার দাবরানি খেয়ে বাবা পাটা ধুয়ে নিলো। শিল ধুয়েছে কিনা দেখলাম না। খেয়াল করিনি। মনে হয় ধোয়নি।

তারপরে বসে বসে একটা একটা করে পেঁয়াজ পাটার উপরে রেখে থেঁতো করে মিহি বেটে বেটে স্টিলের বাটিতে তুলে তুলে রাখলেন। সেই ছবিটা তুলে রাখা দরকার ছিলো। মনে ছিলো না একদম!এখন আফসোস হচ্ছে!

তারপর আমি বসে বসে নাশতা খাচ্ছি। এদিকে মায়ের ডাক পরেছে, “এএএএই কোন পাতিলে রানবোওওও?” রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে মাকে ডাকছে।

মা বাবার ডাক শুনতে পায়নি। আমি গিয়ে মাকে শোবার ঘর থেকে ডেকে নিয়ে এলাম, “তোমাকে ডাকে”।

- কি ব্যাপার, আমাকে ডাকো ক্যা?
-কোন্ পাতিলে রানবো? পাতিল দেও!
-এই ডিস্কো হাড়িটায়।
-আচ্ছা যাও, সরো এখান থেকে।

আম্মা সরে গেলেন। আমি রান্নাঘরে গেলাম চা গরম করতে। গিয়ে দেখি মাছ আর মশলাকে একত্রে খুনতি দিয়ে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। মাছ না ভর্তাই করে ফেলে! হায়রে! এর মধ্যে আমাকে বলা হলো, কল থেকে পিচ্চি পাতিলে করে পানি দিতে। আমি ভরে দিলাম। পানি দেয়ার পরে সবটুকু পানিই বাবা দিয়ে দিলো পাতিলে। একেবারে ডালের পানির মতন। টুবুটুবু। আঁতকে উঠলাম, এই মরেছে! মাছের ডাল রান্না করবে নাকি? আমি চা নিয়ে সরে আসতে আসতে দেখলাম, লবণ দিচ্ছে তরকারীতে তাড়াতাড়ি। চেহারা দেখে মনে হলো আগে দিতে ভুলে গিয়েছিলো।

কিছুক্ষণ পর আবার মায়ের ডাক পরলো, “এই, পটল কই? পটল দেয়া লাগবে তো!”

-“এতক্ষণে পটল দিবা? কুটতেই তো কিছুক্ষণ সময় লাগবে”। মা বললেন এসে।
- কাটো।

মা আর কথা না বাড়িয়ে তরকারিতে সবজি কাঁচা থাকবে ভেবে ঝটপট কেটে দিয়ে আবার সরে গেলেন। এখন বাবাকে আবার কিছু বললে রাগ দেখিয়ে কিভাবে পটল ছিলবে বা কাটবে তার ও তো ঠিক নেই। তরকারি প্রায় হয়ে এসেছে এই সময় বাবা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, “আলু নাই?”

-আলু দিয়া কি করবা? এতক্ষণে আলু দিলে সিদ্ধ হইবো?
-থাক তাইলে।
বাবার চেহারায় চরম আফসোস। ইস! কেন আগে মনে পড়েনি!

এর মধ্যে আমি ব্যস্ত হয়ে পরলাম। আমার কম্পিউটারের স্পিকারটা নষ্ট। মা খুব গান শুনতে পছন্দ করেন। হেড ফোন দিয়ে শোনা যায়। কিন্তু-ওটা দিয়ে শোনার এত সময় কোথায় তার! তাই স্পিকার হলে ভালো হয়। গান শুনলে মায়ের মন মেজাজ ভালো থাকে। আর আমি কম্পিঊটার নিয়ে বসে থাকলেও তখন রাগ করবে না। তাই বাসার অনেক আগে কেনা আরো একটি স্পিকার ছিলো প্রিন্টারের বাক্সে সেটা ফেলেই দেয়ার কথা। তবু, টেস্ট করে দেখলাম। কাজ করছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

“বাহ্! ভালোই তো আছে। ভাগ্যিস ফেলে দেয়া হয়নি।“

গান শুনছিলাম। কম্পিউটারে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রান্নাঘরের দিকে যেয়ে দেখতে পেলাম বাবা চলে গেছে নামাজে। মাকেই নিতে হলো মাছের তরকারির ফিনিশিং দেয়ার কাজ। পাতিলটা টেবিলে রেখে ছবি তুলে নিলাম। কিন্তু, পাতিলের চেহারা ভালো হয়নি। পাতিলের কানায় জ্বাল জোরে দেয়ার ফলে পোড়া পোড়া ভাব ধরেছে। তাই তরকারী সুন্দর করে ঢেলে আবার ছবি তুলে নিলাম, ব্লগে এটা নিয়ে একটা মজার পোস্ট দেওয়া যাবে,  “ভাগনা মাছের সাথে পটলের ঝোল!”

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মা খেতে বসেছে। জিজ্ঞেস করে সন্তুষ্ট হাসি পেলাম। সেই সাথে আরো জানা গেলো, “মাছের তরকারীটা ভালোই হয়েছে। খাওয়া যাচ্ছে!”

বাবা নামাজ থেকে আসার পর বললেন, “ভালোই তো পারো। আমি অসুস্থ হইলে আর চিন্তার কিছু নাই। রাইন্ধা খাওয়াইতে পারবা!”

-“রানলে এমনেই রানবো। শুধু অসুস্থ হইলে কেন?” বলে বাবা খেতে বসলেন।

আমি তো নাক শিটকে শুটকে খেতে বসলাম। পরে খেতে শুরু করে দেখলাম, মায়ের রান্নার সাথে তেমন একটা পার্থক্য হয়নি। বাবা রেঁধেছেন জানা না থাকলে বুঝতেই পারতাম না!

 

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ