আমরা স্কুলে ফিরতে চাই

রিমি রুম্মান ২২ জুন ২০২০, সোমবার, ০৬:৪৫:১৬অপরাহ্ন সমসাময়িক ১৮ মন্তব্য

নিউইয়র্ক সিটির শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করছে দীর্ঘ তিনমাস যাবত। এতোটা সময় তারা তাদের শিক্ষক, সহপাঠীদের সংস্পর্শ থেকে আগে কখনো দূরে থাকেনি। এদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল, শিক্ষক, এবং সহপাঠীদের ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে স্কুলে কর্মরত অন্য সকলকে। এমন কী স্কুল সেফটি এজেন্টও এই ভালোবাসার বাইরে নয়। রোজ স্কুলের শুরুতে শিক্ষার্থীরা সবাইকে শুভসকাল জানিয়ে দিন শুরু করে। আবার ছুটির সময় বিদায় নেবার আগে শ্রেণি শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয়। শীতপ্রধান এই দেশে কখনো কখনো ঠাণ্ডাজনিত শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও স্কুল কামাই দিতে অপরাগ এদেশের শিশুরা। স্কুল চলাকালীন সময়টুকু শিক্ষার্থীদের জন্যে আনন্দময় করে তুলতে শিক্ষকরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন। মোদ্দাকথা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সম্পর্কটি প্রগাঢ় মমতার। এবং একই সাথে স্নেহের, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার। এহেন স্কুল পাগল শিশুরা দীর্ঘ তিনটি মাস ভেতরে কতটা ক্ষরণ পুষে রেখে বাড়িতে বসে অনলাইন ক্লাস করছে, তা কেবল তারাই জানে। আমারও কিছুটা উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল বলে এই লেখার অবতারণা।

গত ১২ই জুন শুক্রবার ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখি মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা। আমার চতুর্থ গ্রেড পড়ুয়া ছোট পুত্র রিহানের শ্রেণি শিক্ষক মিস সুয়ারিজ লিখেছেন, ‘ বেলা বারোটায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দেখতে চাই। আমরা ওপথ দিয়ে যাবো, তোমরা পথের পাশে অপেক্ষা করো।’ ক্ষুদেবার্তার সাথে একটি মানচিত্রও দেয়া হয়েছে। সেখানে লালদাগে শনাক্ত করে দেখানো হয়েছে শিক্ষকরা কোন কোন পথে অতিক্রম করবেন। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নেই। রিহান যারপরনাই আনন্দিত। বহু বহুদিন পর সে তার শিক্ষকদের দেখবে। তার আনন্দ আমার মাঝেও সংক্রমিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মা-ছেলে বাসার পাশের বড় সড়কের মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই। যেহেতু এলিমেন্টারি স্কুলগুলো জোনভিক্তিক, তাই স্কুলের আশেপাশেই শিক্ষার্থীদের বসবাস। সকল ক্ষুদে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কাছ হতে প্রযুক্তির মাধ্যমে বার্তা পেয়ে বাবা-মায়ের সাথে একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সড়কের দুইপাশে অবস্থান নেয়। মুখে মাস্ক পরিহিত শিশুদের হাতে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। সেগুলোয় লেখা, ‘ আমি আমার স্কুল ভালোবাসি, আমি তোমাদের মিস করি, আমি আবার স্কুলে ফিরে যেতে চাই, আমাদের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করছো বলে ধন্যবাদ জানাই।’ জংশন ব্লুবার্ডের দুইপাশের ফুটপাতে শিশুদের এমন আবেগঘন লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমার ভেতরটা আবেগাপ্লুত হয়ে উঠে। চোখের কোণে আর্দ্রতা টের পাই। ছোট্ট রিহানের দুইচোখ ডানে, বাঁয়ে, চক্রাকারে খুঁজে বেড়ায় তার সহপাঠীদের। কিন্তু মাস্কে আবৃত অবয়বগুলো কেউ কাউকে চিনতে পারে না। বাবা-মায়ের হাত ধরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। ঘড়িতে যখন বারোটা বেজে বিশ, ঠিক তখনই আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে গাড়িগুলো। প্রথমে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের গাড়ি, তারপর একে একে শিক্ষকসহ স্কুলে কর্মরত সকলের গাড়ি। শিক্ষকরা তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলো সাজিয়েছেন নানান রঙের বেলুন আর পোস্টারে। সেখানেও আবেগঘন লেখা। আমরা তোমাদের মিস করি, শক্ত থাকো, নিরাপদ থাকো, আমরা তোমাদের ভালোবাসি, পোস্টারের এমন সব লেখাগুলো যখন পড়ছিলাম, তখন সড়কের দুইপাশে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের উৎসুক চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাদের নিজ নিজ শ্রেণি শিক্ষককে। শিক্ষকরা কেউ কেউ ছাদখোলা গাড়ির ভেতর থেকে গলা উঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিল। কেউবা গাড়ির জানালায় অর্ধেক শরীর বের করে আনন্দধ্বনি দিচ্ছিল। আবার কেউ খোলাজীপে চড়ে মিউজিক বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন। অনেকদিন পর তারা তাদের ছাত্রছাত্রীদের দেখা পেয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! অন্যদিকে সড়কের দুইপাশে অপেক্ষারত শিশুরাও হাত নেড়ে প্রতিউত্তর দিচ্ছিল, ফ্লাইং কিস দিচ্ছিল শিক্ষক এবং স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে।

আচমকা ছোট্ট রিহান উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে, ‘ হাই, মিস সুয়ারিজ!’ মাত্র একপলক! মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস পরিহিতা মিস সুয়ারিজ শিশুদের উদ্দেশ্যে শুন্যে হাত নাড়ছিল, চুমু ছুঁড়ে দিচ্ছিল। মুহূর্তেই গাড়িটি মিলিয়ে গেল করোনা এভিনিউয়ের দিকে, অন্য গাড়িগুলোর ভিড়ে। আমি রিহানের দিকে ঘুরে তাকাই। চোখে মুখে তীব্র উচ্ছ্বাস, আনন্দ। আলোর ঝলকানির ন্যায় এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে সে আমায় বলে উঠে, ‘ আম্মু, আমি মিস সুয়ারিজকে দেখেছি, তুমি দেখছো?’ আমি উত্তর দেবার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ততোধিক বিস্ময়ে নয় বছরের এই সহজ, সরল বালকের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকি সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচাইতে সুখি মানুষটির দিকে। এদেশের শিশুরা তাদের শিক্ষকদের কতটা ভালোবাসে তা আবারও নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হোল।

প্রায় দশ মিনিটব্যাপী একে একে গাড়িগুলোর চলে যাওয়া দেখি। দেখি ছোট ছোট শিশুদের চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরবার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাদের কেউ কেউ ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিল শিক্ষকদের দেবেন ভেবে। যদিও তা আর দেয়ার সুযোগ হয়নি কারোর। দীর্ঘদিন আতঙ্ক, ভয় আর বিষণ্ণতার চাদরে ঢাকা এইসব শিশুরা ঘরবন্দি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আগের মতো মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে, ছুটোছুটি খেলতে চাইছে সহপাঠীদের সাথে। স্কুল শেষে শ্রেণি শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিতে চাইছে। কিন্তু করোনাভাইরাস নামের অণুজীবের কাছে তাদের চাওয়াগুলো বড় বেশি অসহায়!

রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ