
শরৎ কবে চলে গিয়েছে। এখন আর কাশফুল নেই বললে চলে। দু একটা শিউলি ফুল ব্যতীত।
একটানা বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর সবেমাত্র শীত চেপে বসেছে। চারদিক জুড়ে ঘন কুয়াশা আর শীতের তীব্র শনশন বাতাস।
অবশ্য এখনো পুরোপুরি শীত চেপে বসেনি। কেননা সবেমাত্র হেমন্তকাল।
সদ্যজাত হেমন্তের সাজে বাড়ির আঙিনা জুড়ে ফুটে উঠেছে গাঁদাফুল, জবাফুল আর কত সুগন্ধিজাত ফুল। শরতের শিউলি ফুলের গন্ধ মাখতে গিয়ে, ইরিধানের বাহার বেড়েছে হেমন্তকে ছুঁয়ে।
একে একে নুয়ে পড়ছে ধানের শীষ।
শুধু কাঁধে করে ঘরে নিয়ে ফেরার পালা।
মাঠজুড়ে ইরিধানের সমারোহ। আর ঘরে ঘরে নবান্নের আমেজ।
তবে সে গ্রামের অধিকাংশ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত হলেও নগেন বিশ্বাস ছিলো জেলে সম্প্রদায়ের লোক।
সে বৃষ্টিতে খালে বিলে প্রচুর জল জমেছে।
তার বাপ দাদারা খালে বিলে মাছ মেরে তা বিক্রি করে সংসার চালাতো। বাপ দাদা গত হওয়ার পর সে হাল এখন নগেন ধরেছে।
তা দিয়ে কোনক্রমে সংসার চলে। তবে চাল আনতে নুন ফুরায়। তা নিয়ে সংসারের দন্দ্ব , কলহ নেই।
সেই সাতসকালে নগেন বিশ্বাস বাড়ি থেকে বের হলে এখনো ঘরে ফেরেনি।
সংসার জীবনের মাত্র চার বছর পার হলো।তবে একটা রহস্য আছে! নগেন খুবি ভালো বাঁশি বাজাতে জানে। একদিন সে বাঁশির সুরের প্রেমে পড়ে যায় নীলিমা। প্রেমে পড়ে নীলিমা নগেনের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।ঘরের মধ্যে আদরের দুই ছানা।
যদু আর মধু।
বয়স বেশি না হলেও এ অল্প বয়সে, সারাদিন এ পাড়া থেকে ঐ পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়।
মাঝেমধ্যে বড় ছেলে যদু তার বাপের সাথে মাছ ধরতে যায়। নগেন চায় তার এ দু ছানা বড় হয়ে সংসারের অভাব মোচন করবে। এদের নিয়ে তার বড়ই স্বপ্ন। অবশ্যই সে স্বপ্ন নীলিমাও দেখে।
নগেনের শ্বশুর বাড়ির জমিজমার অভাব নেই। জমিদার বলা যায়। বড় বড় কামরা আর রাজপ্রসাদ। এ যেন বিশাল অট্টালিকার পাহাড়।
নগেন শত ভাগ্যের গুণে এ জমিদার বাড়ির মেয়ে নীলিমাকে পেয়েছে। তবে এ ভাগ্যের গুণ শুধু তার নয় তার বাঁশিরও বটে।
বাপের বাড়ির এত টাকাপয়সা থাকা সত্ত্বেও নীলিমার কোন আভিজাত্য ও অহংকার নেই।
বরং সে সাদাকালো জীবনকে বেছে নিয়েছে।
আর এ সাদাকালো জীবন নিয়ে নীলিমা এক ফুটফুটে সুগন্ধিময় আগামীর দিন দেখে। নগেন ও নীলিমা একে অপরকে বড্ড ভালোবাসে।
একসাথে বাঁশির সুরে রাত কাটানো , একসাথে গল্প বলা, কবিতা শোনা আরও কতকিছু।
সেসব স্মৃতি হেমন্তের এক সন্ধ্যায় মলিন করে দেয়। হঠাৎ সন্ধ্যা অনেক হলে পাশের ঘরের বাসন্তী পিসি, নীলিমাকে ডেকে বলছেন বউ ঠাকুরান,
বউ ঠাকুরান শুনছো গো,শুনছো?
বেলা কত যে হলো এখনো নগেনের খোঁজ নেই।
কী হলো খোঁজখবর নিয়ে একটু দেখো,
দেখি গো।
কোথায় হারিয়ে গেল না কি।
আজকাল যে দিনকাল পড়েছে।
কখন কোথায় কি হয় তা কি আর বলা যায়, গো।
নগেন আগের রাতে মাছ ধরতে গিয়ে কোথায় লাপাত্তা হয়ে যায়। এই বয়সে ঘরে বউ ও আদরের ছেলেপুলে রেখে কেউ কি আর লাপাত্তা হয়ে যায়?
সেটা নীলিমা কখনো বিশ্বাস করে না।
এদিকে বাপের মুখ না দেখতে পেয়ে সেই কবে থেকে ঘরের দু ছানা কান্নাকাটি করে যাচ্ছে।ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনিয়েও তাদের অবুঝ কান্না থামাতে পারছেন না বাসন্তী পিসি।
নগেন হারিয়ে গেলে এ সংসার পরিচালনা করার মতো কেউ নেই।
নীলিমার বাপের বাড়ি টাকাপয়সা থাকলে কি হবে তার পিতা যে বড্ড কঠিন প্রকৃতির কৃপণ লোক।
যাইহোক তাদের এ ছোট্ট সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরালেও সুখের সংসার ছিলো।
এদিকে দুদিন পার হয়ে গেলো নগেনের খবর নেই। লোকজন দিয়ে চারদিক তন্ন তন্ন করে তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।
বাড়ির উঠোনের আম গাছের ডালে বসে একটা কাক কবে থেকে চোখের নোনতা শ্রোতে ডেকে যাচ্ছে।
বাসন্তী পিসি নীলিমাকে বলছেন এমন ভর দুপুরে কাকের ডাক বড়ই খারাপ রে মা।
না জানি কোন খবর নিয়ে আসে।
সময় অনেকটা পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে এখনো খবর নেই। একে তো সূর্য ডুবতে বসেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
ধূপ ধুনার গন্ধে তেমন একটা সুগন্ধি নেই।
ছেলে গুলো সেই কবে থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।
নীলিমা অজ্ঞান হয়ে বিছানার এক পাশে পড়ে আছে।
হঠাৎ তীব্র বাতাসে পচা লাশের গন্ধ ধেয়ে আসে।
সে গন্ধ নীলিমার নাকে পৌঁছালে আঁতকে উঠে দেখে বারান্দার একপাশে পড়ে আছে নগেনের নিথর দেহ।
নগেনের নিথর দেহ বুকে জড়িয়ে শেষ কান্নায় বিভোর হয়ে পড়ে নীলিমা। এমন মৃত্যু কখনো মেনে নেওয়ার না।
নীলিমার সাদাকালো জীবন কালো ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। তবুও আদরের দু ছানার মুখ দেখে নীলিমাও স্বপ্ন দেখে বর্ণিল জীবনের।
পরের বাড়ি কাজকাম করে নীলিমা সংসার চালালেও পাড়ার লোকের অনেক কথা সইতে হতো। অনেকে থাকে অলক্ষুণে বলে ডাকে। অনেকে আবার অল্প বয়সে স্বামীহারা কুলটা বলে ডাকে।
অনেক কথার আঘাত সয়েও নীলিমা চলতে থাকে দু ছানার মুখপানে চেয়ে। আদরের এ দুই ছানা একদিন তার দুঃখ মোচন করবে।
হঠাৎ করে কোন এক শীতের রাতে ঘরের দুই আদরের ছানা সাপের কামড়ে মৃত্যুের কোলে ঢলে পড়ে। সন্তানের মৃত্যু হলে মায়েরা মৃতদেহ হয়ে যায়। মায়েদের আর বেঁচে থাকার অস্তিত্ব থাকেনা।
আদরের দুই ছানার অকাল মৃত্যুতে নীলিমার জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ কালো ছায়া।
নীলিমা এমন দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। তাই সে নিজেই নিজের আত্মমুক্তির পথ আত্মহত্যা বেছে নেয়!
আত্মহত্যা কী কখনো মুক্তির পথ দেখায়?
শোকের কাতরে নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে মানুষের আর পরজন্ম হয় না! পরজন্মে হয় না দুজনের একসাথে দেখা।
যে চলে যায় সে নদীর স্রোত হয়ে যায়। তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়না।
প্রিয়জন ও পুত্র শোকের কাতরে নীলিমার জঠরের কান্না কখনো কেউ বুঝে ওঠেনি।
..
ছবি গুগল।
১৪টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুব কষ্টের লেখা। সুখটা সহ্য হয়না সবার কপালে। সব হারিয়ে তখন আত্নহত্যা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারা যায় না। আত্নহত্যা সমাধান নয় ইহকাল পরকালেও তবুও মানুষ এই পথ বেছে নেয় যখন তার সব পথ, আশা শেষ হয়ে যায়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
নিজের সমস্ত কিছু হারিয়ে গেলে মানুষ বিচলিত হয়ে যায়। তখন চায় সে নিজেই নিজের আত্মমুক্তির পথ বেছে নিতে।
.
যথার্থ বলেছেন, দিদি।
সাধুবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আত্নহত্যা কোন কিছুর সমাধান নয়। তবুও কিছু সময় মানুষ বাধ্য হয় করতে। অনুগল্প দারুন হয়েছে।
শুভ কামনা রইল দাদা। শুভ সকাল।
প্রদীপ চক্রবর্তী
যথার্থ বলেছেন, দিদি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
ভালো লেখা পড়ে মুগ্ধ
শুভকামনা রইল নিত্য
প্রদীপ চক্রবর্তী
সাধুবাদ আপনাকে।
আলমগীর সরকার লিটন
অন্তগভীর থেকে নেওয়া কবি দা
প্রদীপ চক্রবর্তী
অশেষ ধন্যবাদ,দাদা।
মনির হোসেন মমি
যে চলে যায় সে নদীর স্রোত হয়ে যায়। তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়না।
ফিরে পাওয়া সত্য কিন্তু এমন করুণ পরিস্থিতিতে তখন তার আর কী করার থাকে।খুব ভাল লিখেছেন দাদা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
একদম,।
শুভকামনা রইলো,দাদা।
তৌহিদ
আত্মহত্যা কী কখনো মুক্তির পথ দেখায়?
শোকের কাতরে নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে মানুষের আর পরজন্ম হয় না! পরজন্মে হয় না দুজনের একসাথে দেখা।
যে চলে যায় সে নদীর স্রোত হয়ে যায়। তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়না।
এটাই আসল কথা। চমৎকার গল্প পড়লাম দাদা।
শুভকামনা রইলো।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আত্মহত্যা কখনো মুক্তির পথ দেখায় না।
তবে একজনের আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ!
.
আপনার মতামত ভালো লাগলো।
সাধুবাদ,দাদা।
আরজু মুক্তা
এতো ট্রাজেডি কেনো?
প্রদীপ চক্রবর্তী
শোকের কাতরে আত্মহত্যা!
তাই।