বর্ণিল প্রকৃতিতে থ্যাংকসগিভিং

রিমি রুম্মান ১৪ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, ১০:৩৮:৪২পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ১৩ মন্তব্য
কবি বলেছেন, চির সবুজের দেশ বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর সেই সবুজ দেশে জন্মেছি আমি। কিন্তু এই পাশ্চাত্যে এসে দেখেছি এখানকার প্রকৃতি চার ঋতুতে সাজানো। স্প্রিং, সামার, অটাম, উইন্টার। প্রতিটি ঋতুই বৈশিষ্টপূর্ণ। ঋতুর যে বিবর্তন, তা কখনো সেই অর্থে উপলব্ধি করা হয়নি দেশে থাকতে। সবুজের বাইরেও যে প্রকৃতির আরও কতো রং আছে! প্রকৃতির অন্তর্গত সেইসব রঙের ছোঁয়া দেখেছি এই আমেরিকায় এসে। এ যে হাজারটা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতি নয়। এ না চাইলেও সামনে এসে রঙ ছড়িয়ে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা এক ঝলমলে উজ্জ্বল প্রকৃতি। এই যান্ত্রিক শহরে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা মানুষগুলো প্রকৃতির প্রতিটি অধ্যায় তীব্রভাবে উপভোগ করে। এখানে অক্টোবর-নভেম্বরে বাহারি সব পাতার বর্ণিল সাজে ঝলমল করে উঠে শরৎ ঋতু। অর্থাৎ শরৎ ঋতুকেই এদেশে অটাম কিংবা ‘ ফল সিজন’ বলা হয়। বাংলায় বলে ‘পতন ঋতু’। লাল-খয়েরি-হলুদ-কমলার অদ্ভুত এক অনুভূতির নাম ‘ ফল সিজন’। এই সময়ে হাইওয়ে ধরে দুর্বার গতিতে ছুটে চলা গাড়ি থেকে সড়কের দুইপাশে প্রকাণ্ডসব বৃক্ষের দিকে তাকালে আগুন লাগা বর্ণিল রঙ যে কাউকে নিয়ে যাবে অদ্ভুত এক ঘোরের জগতে। আর পাহাড়ের উপর থেকে নিচে যতদূর চোখ যায়, তাকালে মনে হবে গাছগুলোতে হলি খেলা চলছে। কেউ আবীর ছড়িয়ে দিয়েছে। কিংবা মনে হবে শিল্পীর হাতে যত্নে আঁকা রঙিন ক্যানভাস। কিন্তু প্রকৃতির এই অনিন্দ্য রুপান্তর খুবই ক্ষণস্থায়ী।
ঝিরিঝিরি শীতল বৈরি বাতাস পাতাদের গান শোনাতে শোনাতে কখন যে মাটির দিকে টেনে নেয়! মাটিতে হুটোপুটি খায় বিবর্ণ ঝরাপাতা। স্তূপীকৃত হয়ে পুরু কার্পেটের মতো পড়ে থাকে শহরের রাস্তা জুড়ে। ম্যপল কিংবা পাইন গাছের পাতা পড়ে থাকে কাঠের বেঞ্চিতে, রাস্তার দুইধারে পার্ক করা গাড়িতে। কখনোবা ব্যস্ততম সড়কে ছুটে চলা গাড়ির চাকার সাথে ছুটে যায় শুকনো পাতা উদাসী সুরে। কিছুদূর গিয়ে থমকে থাকে পিচঢালা পথের বাঁকে বাঁকে। তাদের মাড়িয়ে হেঁটে চলে মানুষের কোলাহল। চরাচরে কান পেতে ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি শোনার সময় নেই কারো। আমরা পাতায় পাতায় ভরে থাকা বাড়ির সামনের অংশটুকু ঝাঁট দিয়ে তুলে নেই তাদের। অবশিষ্টরা উদাসী বাতাসে পাক খেতে খেতে গড়াগড়ি খায় পথের আনাচে-কানাচে। যেন হৃদয়ের ভেতরে ঘূর্ণি পাতার মতো ঘুরে ঘুরে বলে যায়, এ বেলায় যাই তবে, ফের দেখা হবে, দেখা হবে...। ঝরাপাতার বিদায়ে চারিদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্পত্র কঙ্কালসার বৃক্ষরাজি। যেন হাহাকার করা বিষণ্ণ সুন্দর প্রকৃতি। জানি, গ্রীষ্মের আগমনে আবার গাঢ় সবুজ পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠবে বৃক্ষরাজি। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আঙিনা, পথ-ঘাট। তবুও।
আমেরিকায় পাতা ঝরার দিনের মাঝেই অর্থাৎ ৩১শে অক্টোবর ‘ হ্যালোইন ডে’ উৎসব পালিত হয়। একে আমি বলি ভৌতিক মুখোশের উৎসব। ‘ যেমন খুশি তেমন সাজো’র উৎসব। নভেম্বরের শুরুতেই শুরু হয় ‘ থ্যাংকস গিভিং ডে’র আমেজ। আমেরিকার বড় দুটি উৎসবের একটি ‘ থ্যাংকস গিভিং ডে’। এটি একটি সার্বজনীন উৎসব। সারা আমেরিকা জুড়ে মহা সমারোহে উদযাপন করা হয় দিনটি। অনেকটা আমাদের দেশের ঘরে ঘরে ফসল তোলার নবান্নের উৎসবের মতো। বিশ্ববিখ্যাত শপিং প্রতিষ্ঠান ‘ মেসিস’ দিবসটিকে ঘিরে বর্ণাঢ্য প্যারেডের আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র বিশালাকৃতির বেলুনে ফুলিয়ে, নানান রকম সাজসজ্জার ক্লাউন এবং বাদক দল দিয়ে প্যারেডটিকে আকর্ষণীয় করা হয়। মানুষজন অধীর আগ্রহে তা দেখার জন্যে সড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও এই বিশেষ দিনটি উদযাপনে অন্যবারের ন্যায় বিশেষ কোনো তোড়জোড় নেই এবার। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সকল জমকালো আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মহামারির কথা ভেবে। তবুও ভিন্ন আঙ্গিকে ঘরোয়াভাবে ছোট পরিসরে নিজেদের মতো করে দিনটি উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সকলে। নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার দিনটি পালিত হয়ে থাকে।
এর পেছনে জড়িয়ে আছে বিষাদময় এক ইতিহাস।
স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চায় প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়া একদল মানুষ ১৬২০ সালে ইংল্যান্ড ছেড়ে রওয়ানা দেন ‘ মে ফ্লাওয়ার’ নামক জাহাজে চড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। কয়েক মাস পর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের প্লিমিথ গ্রামে যাত্রা বিরতি করে জাহাজটি। কিন্তু অনাহারে, অর্ধহারে, তীব্র শীতের প্রকোপে ১০২ জন নারী, পুরুষ, শিশু যাত্রীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত মাত্র ৫৪ জন বেঁচেছিলেন। সেই দুর্দিনে প্লিমিথ গ্রামের আদিবাসীরা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। তাদের শস্য চাষ করার প্রক্রিয়া, মাছ ধরার কৌশল এবং ম্যাপল গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার পদ্ধতি শেখান। ফলে পরের বছর গ্রীষ্মে আশাতীত ফলন হয়। আদিবাসী ও বহিরাগতরা মিলে একে অপরকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, এবং এক ভুঁড়িভোজের আয়োজন করেন। ময়ূরের মতো দেখতে টার্কি মশলা মাখিয়ে পুড়িয়ে তা দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এবং আশাতীত ফলনের জন্যে। এটিই ক্রমশ ‘ থ্যাংকস গিভিং ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য, সকলে মিলে একত্রে খাওয়া-দাওয়া এবং উৎসবের মাধ্যমে ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানানো। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম জাতীয় পর্যায়ে দিনটিকে স্বীকৃতি দেন ১৭৮৯ সালের ২৬শে নভেম্বর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দিনটিকে বার্ষিক ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন ১৯৬৩ সালে।
যেহেতু এটি একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত আয়োজন, তাই পাশ্চাত্যে বসবাসরত বাঙালিরাও দিনটি উদযাপন করে থাকেন। কেউ কেউ দিবসটিকে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ হিসেবে উদযাপন করে থাকেন। আবার অনেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনকে ধন্যবাদ জানানোর দিন ভাবেন। পাশ্চাত্যের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এ দেশের সংস্কৃতিকে নিজস্ব আঙ্গিকে তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন অনেকে। যেহেতু এটি কোনোভাবেই ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তাই আমরা এই দিনে বাড়িতে বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন সকলে মিলে একত্রিত হই। হালাল টার্কি দেশীয় পদ্ধতিতে মশলা মাখিয়ে ওভেনে পুড়িয়ে রাতের খাবারে টেবিলে পরিবেশন করি। সাথে থাকে ক্র্যানবেরি সস, পাম্পকিন পাই, মিষ্টি আলুর ক্যান্ডি, ম্যাশড পটেটো এবং দেশিয় খাবার। সবাই মিলে আনন্দের সাথে সময় কাটানো এবং খাওয়াদাওয়া শেষে জীবনের প্রতিটি সাফল্যের জন্যে, আমাদের প্রতি অবারিত করুণা বর্ষণের জন্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া এবং কৃতজ্ঞতা জানাই । বন্ধুরা একে অপরকে ধন্যবাদ জানাই সারাবছর বিপদে আপদে পাশে থাকার জন্যে। আত্মীয়পরিজনহীন এই দূর দেশের শুরু দিনগুলোতে যারা একটি চাকুরি পেতে সহযোগিতা করেছিলেন, কিংবা একটি বাসা পেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কেউবা রাস্তাঘাট চিনিয়েছেন, তাঁদের সকলকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি দিনটিতে।
0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ