নিছক গল্প-৩

সাতকাহন ৭ জুলাই ২০১৩, রবিবার, ০৫:১৯:১৩অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

মজিদ সাহেব লং জার্নির কারণে অবসন্ন বোধ করছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজ শুধু শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। তিনি সাবান মেখে কঠিন একটা গোসল করলেন। সাধারণত বিয়ে করার দিন এ রকম সব জায়গায় সাবান পৌঁছে দেয়া হয়। গা মুছে মাথার বাম পাশে একটা সিঁথি কেটে টিভির সামনে বসলেন তিনি। বোতামে চাপ দেয়ামাত্র শহীদ কাপুরের নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে এ্যান্টি ড্যানড্রাফ্ট শ্যাম্পুর গুণকীর্তন করছে নাবালক চেহারার ছেলেটি। ‘এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি’ এই বিজ্ঞাপনটা তার স্পষ্ট প্রমাণ। বালক নায়কটি চুলকে চুল বলছে না; শরীরের লোমাদির নামকরণে দুই ভাষা দুই ভূখণ্ডে।

রিমোর্ট হাতে নিয়ে আঙ্গুল কান্ট্রোলে রাখা শক্ত। মজিদ সাহেব মনের সাধ মিটিয়ে রিমোর্টের বোতাম চাপতে লাগলেন, ঢাকাইয়া টকশো বা বুদ্ধিজীবীদের খেজুরে আলাপ, মাত্র কুড়ি টাকার লাত্থি খেয়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত হবার বিজ্ঞাপন, দীপিকা পাড়ুকোনের আহু-আহু ঝোড়ো ড্যান্স, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে কুমিরের কামড়া কামড়ি, দেশী কনডমের বিদেশী ভার্সনে এ্যাড, বারাক ওবামার ‘চেঞ্জ উইনিড, চেঞ্জ উইক্যান’-এর প্রতিশ্রুতি পেরিয়ে মজিদ সাহেব জি বাঙলায় এসে থামলেন। টালিগঞ্জের বস্তাপঁচা বাঙলা ছবি। বাড়ির ছোট ঠাকুরপো বাজার রেখে কলঘরে চান করতে ঢুকল, বড় বৌদি জলখাবার তৈরী করছে। কলকাতার ঠাকুর পো’রা খুব বৌদি ভক্ত হয়, পৃথিবী একদিকে আর বৌদি একদিকে। একজন দজ্জাল মেজ বৌদি থাকাও ছবির ফমুর্লার একটা অংশ। বুড়া বয়সে জিহ্বার নোলাটা সম্ভবত একটু বেড়ে যায়, এটা ওটা খেতে ইচ্ছে করে। বৃদ্ধ পিতার এক টুকরা মাছ খাবার ব্যাপার নিয়ে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র শুরু হয়ে গেলো।

নিখুঁতভাবে গোসলের কারণে মজিদ সাহেবের নার্ভ সিস্টেম, এন্ডোক্রাইন সিস্টেম শিথিল হয়ে পড়ছে, গামা, বিটা, আলফা, থিটা স্তর থেকে তিনি চলে যাচ্ছেন ডেল্টাস্তরে। তিনি ঝিমুতে লাগলেন, কলেজে গিয়ে ঠাকুরপোর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়ার দৃশ্যটা তিনি ঝাপসা দেখছেন। ঠিক এই সময় কোকিল পাখিটা ডেকে ওঠে। প্রকৃতির প্রেমকে তিনি হাতফোনের মধ্যে ভরে দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে বড় ভাতিজা ইমন।

ইমন দেশে ফিরে আসছে। তার ড-এ ডট সংগ্রহ হয়ে গেছে। এখন ইমন মানে ডক্টর ইমন। ইমন দেশে আসছে অথচ তিনি খুশী হতে পারলেন না।

মজিদ সাহেব ফিরে গেলেন এক বেদনাদায়ক অতীতে। হার্ট এ্যাটাকে বড় ভাই আজিজের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় ভাবী দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কারণটা সম্পূর্ণ ফ্রয়েডীয়। মানুষের জীবনে শরীর কখনও কখনও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। বাঙলাদেশের শীর্ষ তারকা দম্পতির সেপারেশন এবং পরবর্তীতে অভিনেত্রীটির দ্বিতীয় বিয়ে দেখার পর মজিদ সাহেব সম্প্রতি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছেন। মজিদ সাহেব ভাইপোদের হাতছাড়া না করে ওদের বাবা-মা হয়ে রইলেন। জীবনে বিয়ে করবেন না এই সিদ্ধান্তটাও নিলেন। সুমনকে নুরজাহান আপার কাছে রেখে ইমনকে নিয়ে তিনি ঢাকায় চলে এলেন। নুরজাহানের সাতকোটি বঙ্গ সন্তানের মুগ্ধ জননীর মতো আদরে সুমন মাথায় ওঠে। অষ্ট্রেলিয়া থেকে টাকা আসে, চাচার কাছ থেকে টাকা আসে, নুরজাহান ফুপুও কিছু দেন। প্রাপ্ত টাকা এবং বন্ধুর সাহচর্যে সুমনের গোল্লায় যাবার পথটা মসৃণ হয়। চাচা উপজেলা সদরে বাড়িটা করে দেবার পর সুমন অর্থ প্রাপ্তির সাথে সাথে একা থাকার আনন্দের স্বাদটাও পেতে থাকে। মুগ্ধ জননীদের চোখে গোপালদের কোনো দোষ ধরা পড়ে না-সুমনের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ যায় না মজিদ সাহেবের কাছে।

সমস্যা হয় ইমনকে নিয়ে। ইমন যেখানে ঝামেলা সেখানে। জীবানুরা যেমন সুস্থ্য দেহ সহ্য করে না, তেমনি রাহু, কেতু, শনিরা মানুষের নিরবচ্ছিন্ন শান্তি মেনে নেয় না। ইমনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মজিদ সাহেব ভাবলেন ঝামেলা শেষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো ঝামেলার কেবল শুরু। ইমন নামের সুবোধ ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েই একটা রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে নিলো। বাঙলাদেশের মানুষের বেহেশতে যাবার জন্য যেমন পীর ধরতে হয় তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোগুলোতে ছোট একটা বিছানা, দৈনিক এক টুকরা মাছ অথবা মাংস এবং পানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য ডাল নামক একটা তরল পদার্থ পেতে বড় ভাইদের ধরতে হয়। এর বিনিময়ে বড় ভাইদের দলে সমর্থন দিতে হয়। বড় ভাইদের বালিশের নীচে পীর সাহেবের তসবিহ পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় পয়েন্ট থার্টি ফোর ক্যালিবার পিস্তল, ভায়াগ্রা কিংবা ইয়াবার প্যাক।

মজিদ সাহেব এমনিতেই বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতিকে ভয় পান, ইমনের রাজনীতিতে যোগ দেবার কথা শুনে তিনি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়লেন। এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহনশীলতার খুব অভাব। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। অনেক শিক্ষক ক্ষমতার সাথে সম্পর্ক রাখেন। তারা শিক্ষকতা এবং নিবিড় গবেষণা অপেক্ষা দলীয় কর্মকাণ্ডে বেশি তৃপ্তি পান। তাদের চরিত্র নিয়েও কথা উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকেই যৌন নিপীড়ন বিরোধী আইনের প্রস্তাব উঠলে প্রতিষ্ঠানটিকে সুস্থ প্রতিষ্ঠান বলা যায় না।

ইমন যে হলে থাকে সেই হলের বড় ভাই মাসুম বিল্লাহ। বিরল ধরনের পবিত্র নাম। শোনা যায় তার সাথে ঢাকার দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং এক ইয়াবা সম্রাজ্ঞীর সম্পর্ক আছে। এদের মধ্যে একজন টুণ্ডা হারুন। সে ট্রিপল মার্ডারের আসামী। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। মাসুমের সাথে সম্পর্ক রাখা মানে টুণ্ডা এবং সম্রাজ্ঞীর সাথে সম্পর্ক রাখা। টেনশনে মজিদ সাহেবের ঘুম কমে যায়, অসুখের মাত্রা বেড়ে যায়। ইমন বুদ্ধিমান ছেলে। সে সন্ত্রাসী পাঠ ছেড়ে গভীরভাবে পড়াশুনা এবং রাজনীতি দুটোই চালাতে থাকে। মাস ছয়েক পর মজিদ সাহেব যখন বুঝতে পারলেন ইমন পড়াশুনার স্বার্থে রাজনীতি করছে তখন তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন এবং ইমনের শেষ বর্ষ শেষ হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলেন।

 

(চলবে)

 

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ