১৯৩০ সালের ২ মার্চ গান্ধী সেই মনের কথাই জানিয়েছিলেন বড়লাটকে লেখা এক চিঠিতে। সেই চিঠিতে গান্ধী খোলাখুলিভাবেই লিখেছিলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য, ক্রমবর্ধমান সহিংস সংগ্রামীদের সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে আমার আন্তরিক শক্তিকে পরিচালিত করা।’[৩০] এই সময়ে গান্ধীর এক প্রশ্নের উত্তরে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘I think attainment of swraj can only be helped by soldiers and not by the spiders.’[৩১] শরৎচন্দ্রের জবাবে গান্ধী উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, ‘সশস্ত্র বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী তারা ভ্রান্ত, আর যারা সন্ত্রাসবাদী তারা দেশের শত্রু।’ গান্ধীজির মুখ থেকে এই ধরনের কথা শুনে তীব্র প্রতিবাদ করেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বলেন:
‘শত্রু শব্দের অর্থ কি? মতবিরোধীতাকেই যদি শত্রুতা বোঝায়, তাহলে যদি কেউ আপনাকে শত্রু বলে আখ্যা দেয়, আপনার ব্যক্তিগত আপত্তি থাকা উচিত নয় কি? আপনার জন্যই জানিয়ে রাখছি যে, বিপ্লবী অর্থে এই সন্ত্রাবাদী দলকে আমি শ্রদ্ধা করি; কারণ তাঁরাও দেশকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তো জীবনের যা কিছু প্রিয় সবই উৎসর্গ করে দেয় বুলেটের সামনে। এই যে এদের ত্যাগ, এই যে এদের আদর্শ, এটা হয়তো আপনার মতে ভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু দেশের শত্রু এরা হলো কেমন করে?’[৩২]
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কথার জবাব দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত গান্ধীজি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন তার কথা। মৌখিকভাবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ক্ষমাও চান গান্ধী।
এদিকে ১৯৩১ সালের ৭ মার্চ মেদেনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার পেডিকে বিমল দাশগুপ্ত গুলি করে হত্যা করেন। ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই আলীপুর জেলার জেলা ও দায়রা জজ মিস্টার গার্লিকে কানাইলাল দত্ত গুলি করে হত্যা করেন। কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে দুই স্কুলছাত্রী শান্তিসুধা ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী গুলি করে হত্যা করেন।
১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলী জেলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হলেন সুভাষ বসুর সহপাঠী সন্তোষ মিত্র ও বরিশালের তারেকেশ্বর সেনগুপ্ত। রাজবন্দীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে, সরকারের জেল-জুলুম ও দমন নীতির বিরুদ্ধে কলকাতায় ব্যাপক প্রতিবাদ করেন সুভাষ বসু। গুলিতে নিহত বরিশালের তারেকেশ্বরের চিতাভষ্ম নিয়ে তিনি তারেকেশ্বরের গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৈলা গ্রামে আসেন। সেখানে শোকাহত জনগণের উদ্দেশ্যে সুভাষ বলেন:
‘আমরা জানি আত্মত্যাগীর রক্তের বিনিময়েই স্বাধীনতা করা সম্ভবপর। সকল যুগ, সকল সময় হইতেই আমরা এই আমরা এই অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আসিতেছি। আমাদের পক্ষেও উহার ব্যতিক্রম আশা করা উচিত নয়। আজকের তারেকেশ্বরের মতোই অসংখ্য বিপ্লবীর রক্তের বিনিময়ে একদিন অর্জিত হবে আমাদের স্বাধীনতা।’[৩৩]
১৯৩১ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করে হত্যার পর ঢাকার সাধারণ মানুষের উপর যে পুলিশি অত্যাচার শুরু হয়, সেই অত্যাচারের তদন্তের জন্য সুভাষ নারায়ণগঞ্জ গেলে ৭ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেখান থেকে তাঁকে চাঁদপুরে পাঠানো হয়। ১১ নভেম্বর যখন চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা, আখাউড়া ও ভৈরব হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে যান তখন পুনরায় তাঁকে তেজগাঁওয়ের কাছে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৪ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি পাওয়ার পরে ওই দিনই তিনি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে একটি আলোচনা সভা করেন। ১৫ নভেম্বর তিনি পুলিশের অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি-ঘর পরিদর্শন করেন। পরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবী বিনা দাশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাঙলার ছোটলাটকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। ওই বছর ৩০ এপ্রিল মেদেনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে বিদ্যুত ভট্টচার্য গুলি করে হত্যা করেন। ১৯৩২ সালের ২৭ জুন মুন্সিগঞ্জের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কামাক্ষাচরণ সেনকে হত্যা করা হয়, এবং একই বছরের ১৭ নভেম্বর রাজশাহীর জেল সুপারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের তত্ত্বাবধানে এভাবেই সারা বাঙলায় সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ চরম আকার ধারণ করে।
তথ্যপঞ্জি:
৩০. মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
৩১. মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
৩২. মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
৩৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩১
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://www.sonelablog.com/archives/24619
অনন্য সুভাষ (২) http://www.sonelablog.com/archives/24727
অনন্য সুভাষ (৩) http://www.sonelablog.com/archives/24827
অনন্য সুভাষ (৪) http://www.sonelablog.com/archives/24920
অনন্য সুভাষ (৫) http://www.sonelablog.com/archives/25039
অনন্য সুভাষ (৬) http://www.sonelablog.com/archives/25609
অনন্য সুভাষ (৭) http://www.sonelablog.com/archives/26083
অনন্য সুভাষ (৮) http://www.sonelablog.com/archives/34341
৬টি মন্তব্য
আজিম
জানলাম; শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ।
ইমন
অনেক শিক্ষনীয় এবং তথ্যবহুল একটা লেখা। ধন্যবাদ। 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রতিটি পর্ব পড়তে পারছি না। সময় ও সুযোগের অভাবে। তবে যেটা পাচ্ছি, পড়ে নিচ্ছি।
উপস্থাপনা আপনার যথেষ্ট সুন্দর। (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ দিদি।