রহমান মৃধা

এই লেখাটী মন কেড়ে নিল। মনে করলাম শেয়ার করি। এই শেয়ার আমার ব্যাক্তি অনুভুতি। আমি মুক্তিযুদ্ধের কিছু পেলে পড়তে খুব মন টানে। পড়ি। মাঝে মাঝে যদিও মুক্তিজোদ্ধারদের উপর রাগ করি। খারাপ কথাও বলি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে অনেক। যা ভাবা বা কল্পনার বাহিরে। কারো ভাল লাগাই আমার ভাল লাগা।

সারা দেশে চলছে গণ হরতাল “স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। সমস্ত শরীরে বইছে একই কথা- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বপনে জাগরণে একই চিন্তা, একই ভাবনা। ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছেলে। নাইনে উঠতে বেশি দিন বাকি নেই। বাংলার দুরন্ত ছেলে, থাকে তার মামা বাড়িতে। নানা মারা গেছেন তার জন্মের আগে।

মামা-মামী এবং মামাতো ভাই-বোনদের আদর-যত্নে গড়ে ওঠা এই ভাই মাগুরা শহর ছেড়ে বাস করছে নহাটাতে, তার মামাতো ভাই-বোনদের সাথে। তখন ছোট, জানিনে যে সে আমাদের আপন ভাই নয়, ফুপাতো ভাই। কখনও ভাবনাতে এটা আসেনি। একই পরিবারে আর দশজন ভাই-বোনের মতো সেও পরিবারের এক আপনজন।

শরণার্থীর ঢেউ বয়ে চলছে তৎকালীন বাংলার বিশ্ব গ্রান্ড ট্রাংক রোড দিয়ে, যা শুরু হয়েছে ফরিদপুর থেকে এবং শেষ হয়েছে যশোর বেনাপোল, পরে ঢুকেছে ভারতে। দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত বাঙালি দেশ ত্যাগ করছে বর্বর পাকিস্তানিদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য।

পথে কেউ বাচ্চা প্রসব করে ফেলে চলে যেতে দ্বিধাবোধ করছে না। ফেলে রাখা বাচ্চাদের মধ্যে ছিল এক পরিচিত নাম, হারান। ফেলে যাওয়া হারান হারিয়ে ছিল হরতালের সময় তার মার কোল থেকে, তাই নহাটা (মাগুরা জেলা) বাজারের এক কর্নার থেকে অন্য কর্নারে হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠে সেই হারান।

পরে জানা গেলো জন্মেছিল হারান প্রতিবন্ধী হয়ে তাই তাকে ফেলে চলে যায় তার পরিবার। হরতাল চলছে, যুদ্ধ শুরু হতেই রাতের আঁধারে হঠাৎ আমার এই ভাই রাশেদ, আরেক ভাইয়ের সঙ্গে প্ল্যান করে শরণার্থীদের সঙ্গে রওনা দেয় ভারতের উদ্দেশ্যে। তখন কেউ জানতো না কতদিন এ যুদ্ধ চলবে।

আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা, তার জন্য ভালো ট্রেনিং দরকার বিধায় ভারত সরকার তখন এ সুযোগ করে দেয়। দীর্ঘ ছয় মাস ট্রেনিং শেষে আমার ছোট কাকা নজরুল ইসলাম মৃধা ফিরে এসে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। রাসেদ ভাই বাংলাদেশে ঢোকেন সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাস, ১৯৭১ সালে।

তার বাবা আব্দুল মাজেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মাজেদ বাহিনীর সদস্য হয়ে তিনি যুদ্ধে রত। যুদ্ধ চলাকালীন কোনো এক সময় জানা যায় যে, রাসেদ ভাই যশোর জেলার ভেতরে হাজিপুর মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। যুদ্ধ চলছে বিশাল আকারে সারা দেশে।

বাঙালিরা জঙ্গলে, কচুরিপানার তলে, পাটের ক্ষেতে, ধানের ক্ষেতে, মাটির তৈরি মরিচার তলে সব জায়গাতে। রাজাকার এবং পাকবাহিনীর পরাজয় ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাঙালির রক্তে বইছে তুফান, তাঁরা গাইছে দেশের গান।

“আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি”। সবার মুখে একই কথা, “এদেশ ছাড়বি কিনা বল?” যুদ্ধ চলছে।

হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এলো আমাদের পরিবারে। বিরাট কিছু পেতে, দিতে হলো এক সাগর রক্ত, দিতে হলো ভালোবাসার জলাঞ্জলি, দিতে হলো মা-বোনদের ইজ্জত, উৎসর্গ করতে হলো রাসেদ ভাইয়ের জীবন।

১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর একটি অপারেশন শেষ করে হাজীপুর বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা। তারা মাগুরা-ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী শৈলকূপার কামান্না গ্রামে মাধবকুণ্ড নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে রাত্রি যাপনের জন্য অবস্থান নেয়।

রাজাকারদের মাধ্যমে তাদের এ অবস্থানের খবর শৈলকূপা ও মাগুরার পাক বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। এই খবরে শৈলকূপা ও মাগুরার পাক সেনারা ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে ওই বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাক হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে।

সে সময় ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তাদের মধ্যে রাসেদ ভাইও ছিলেন। বাড়ির মালিক এখনও সেই অবস্থায় বাড়িটিকে রেখে দিয়েছেন। কামান্না গ্রামের গণকবরে শুয়ে আছেন আমাদের ভাই রাসেদ।

আজ এত বছর পর জাতির কাছে আমার প্রশ্ন- ২৭ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাতে একসঙ্গে শহীদ হয়েছিল এই বাংলাদেশের জন্য। কতজন তা জানে? জানা হয়নি অনেক অজানা আজও। ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার অকাল মৃত্যু বাংলার স্বাধীনতার জন্য।

কেউ তো তা নিয়ে মিছিল করেনি আজও যেন কামান্না দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়! এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। রাসেদ ভাইয়ের মত লাখো শহীদের রক্তে বাংলাদেশ পেয়েছি। আজ তা হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। যার যা খুশি সে তাই করছে।

যারা দিয়েছে তারা কী পেয়েছে? যারা কিছু করেনি তারা করছে আজ ভোগ। ৪৯ বছর পার হতে চলেছে, সময় এসেছে জাগার “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে।” সেই ছোটবেলার মুখস্থ কবিতা যেন এই বৃদ্ধ বয়সেও দুর্বোধ্য লাগে। কারণ তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি বলে।

প্রতি বছর ২৬ সে নভেম্বর কামান্না গ্রামের কথা মনে পড়ে, কারণ সেখানে রয়েছে রাশেদ ভাইয়ের কবর সঙ্গে ২৬ জন নাম জানা-অজানা ভাইয়েরা। ২৭ জন ভাইয়ের গণকবর যে গ্রামে, স্বাধীন বাংলার জন্য যে গ্রামে ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে ২৭ জন শহীদ ভাইয়েরা। কী পেয়েছে সেই গ্রাম? আমি জানিনে। তবে বড় জানতে ইচ্ছে করে।

যে পরিবারের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ সে পরিবারের লোক হয়ে কী করে দুর্নীতি এবং কুশিক্ষাকে সাপোর্ট দেই? শাসন, শোষণ ও ভাষণ নয় দুর্নীতি মুক্ত পরিবার ও দেশ চাই। তাইতো আমার সংগ্রাম দুর্নীতি এবং কুশিক্ষা মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম, হৃদ্যতা ও মানবতা ফিরে পাবার সংগ্রাম।

হাত জোড় করি সারাদেশের মানুষের কাছে : আসুন এক হয়ে একসঙ্গে হাতে হাত রেখে গড়ি রাশেদ ভাইয়ের দেশ। যে দিয়েছে তার সব শুধু আপনার, আমার, সবার জন্য। সেদিনের সেই ফেলে যাওয়া প্রতিবন্ধী হারান হারিয়ে গেছে। রাশেদ ভাই শহীদ হয়েছে।

স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখি তোমাকে আজও তোমার কথা মনে পড়ে। তুমি শুধু ভাই নয়, তুমি আমার বাংলাদেশ। রাশেদ ভাইসহ যারা ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে সেই কামান্না গ্রামে। লাখো সালাম তোমাদেরকে। সেই সঙ্গে আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা।

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে, [email protected]

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ