“ আমাদের সাথে যে সাংবাদিক ছিলেন, তিনি কালো মতো একটা প্যান্ট পরেছিলেন। সাদা জামা এবং তার ওপর হলুদ রঙের সোয়েটার ছিল তার গায়ে। আমাদের উপর যখন হামলা হয়, তখন দেখলাম বুকে হাত চেপে ধরে-ওখানে একটা দেয়াল ছিল, তার গায়ে পড়ে গেলেন। দেখলাম, ওনার কাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তারপর আমি কিছুদূরে একটা গাছের পেছনে আশ্রয় নিয়ে দেখি কয়েকশো বিহারী ড্যাগার আর কিরিচ নিয়ে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসল। তারপর তারা মাটিতে পড়ে থাকা দেহগুলো কোপাতে কোপাতে টেনে পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে টেনে নিয়ে গেল। তারপর আর আমি সেই লাশগুলোকে খুজে পাইনি ”

হ্যাঁ সেদিনের পরে আসলেই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু, তিনি নিখোঁজের ১৫-১৬ বছর পর সারা মুখে দাড়ি-গোঁফ ভর্তি ভিখিরি বেশের এক লোক তাঁর বাড়ির কাজের লোকের কাছে গিয়ে বলেন-“ তিনি ফিরে এসেছে, আজকেই কোন এক সময়ে তিনি ফিরে আসবে...”
পাঠক, আশান্বিত হচ্ছেন কি ? ভাবছেন কি যে তিনি সত্যিই কি ফিরে এসেছিলো ? হ্যাঁ, সেটাই স্বাভাবিক। সুমীতা দেবীও সেদিন আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর সন্তানেরাও আবারো কিছুটা সময়ের জন্য বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো তিনি ফিরবেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর থেকে রাত হল আবারো সকাল হল তিনি ফিরলেন নাহ্। দেখা মিললো না সেই আগন্তুকেরও...

১৫ বছর এভাবেই কেটে গেলো তিনি ফিরলেন নাহ্‌। সুমীতা,অনল ধরেই নিলেন তিনি আর ফিরবেন নাহ্‌। কিন্তু... কিন্তু, আবারো শোনা গেল ২৮-২৯ বছর আগের নিখোঁজ অনেকের সন্ধান মিলেছে, কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের অস্থি’ র সন্ধান মিলেছে। আপনজনের অস্থি’ র সন্ধানে সেদিন অনেকেই ছুটে গিয়েছিলো মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের মুসলিম বাজারের সেই পুরনো কুয়োর কাছে। যেখান থেকে উদ্ধার করা হচ্ছিলো শত মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়।

হয়তো সেই মানুষটিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু এরপরেও তো সে তাঁর বাবার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে ! এই আশায় অনল ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। সেই সাদা শার্ট, হলুদ রঙের সোয়েটার দেখে সনাক্ত করেছিলেন তাঁর বাবার অস্থি কে। ২৭ বছর পরে সে ফিরে পেয়েছিলো বাবার অস্তিত্বকে। কিন্তু নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা দেখুন, এতো বছর পরেও বাবাকে ফিরে পেয়েও অনল চিৎকার করে “বাবা” বলে ডাকতে পারছে নাহ্‌ , বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না । শুধু কিছু ক্ষয়ে যাওয়া হাড়গোড় আর পোশাক দেখেই সে বুক ভরা কষ্টে,যন্ত্রণায় বাবাকে অনুভব করতে পারছে !!

আমি আর কিছু লিখতে পারছি নাহ্‌। প্রচণ্ড কষ্টে দিশেহারা লাগছে। আমি একবার আপনাকে দেখতে চাই, হোক সেটা অবাস্তব আবদার। কিন্তু এরপরেও সেই আবদারটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।জহির রায়হান স্যার, আপনি কি সেদিন সত্যিই সেই কুয়োর পানিতে মিশে গিয়েছিলেন? আপনি কি সত্যিই সেদিন চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন ? আপনি কি আসলেই আর ফিরে আসবেন নাহ্‌...(!)

0 Shares

৪৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ