স্মৃতিতে চৈত্র সংক্রান্তি

নীলাঞ্জনা নীলা ১৩ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৪:৫৪পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২২ মন্তব্য

চৈত্র সংক্রান্তি...
চৈত্র সংক্রান্তি...

পথভোলা পথিক তুমি আমায় "রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে!"---বসন্তের শেষ দিন। প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। এইতো সেদিনকার কথা, বসন্ত উৎসব! নাহ বিশাল আয়োজন করে নয়, আমাদের বাসায় হ্যারিকেনের আলোয় হারমোনিয়মে মামনি আর তবলায় বাপি, আর ছোট্ট আমি গান গাইছি চোখ বন্ধ করে।
"ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥"

তারপর আরও অনেক গান। তবে সবশেষ গান হতো,
"মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে এসে
হেসেই বলে, 'যাই যাই যাই।'
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
'না না না।'
নাচে তাই তাই তাই॥"---এ গানের সাথেই বসন্তকে বিদায় জানাতাম আমরা। বসন্ত ঋতুর শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। আমার যতো আনন্দের স্মৃতি সব চা' বাগানের জীবনে। বছর শেষ কিংবা শুরু সবকিছুতেই আনন্দ লেপে থাকতো। উৎসব কাকে বলে, কি এসব শিখিয়েছে বাগানের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। একটা কথা এখনও অনেকের কাছেই শুনি, যারা চা' বাগানে বড়ো হয় তারা নাকি খুব উদার এবং সহজ মনের হয়। তাদের মধ্যে জটিলতা-কুটিলতা ব্যাপারটা সেভাবে থাকেনা। নাহ নিজের বিজ্ঞাপন করছিনা। সময়ে সবাই পাল্টে যায়। আমিও গেছি। যে চৈত্র সংক্রান্তিতে অস্থির থাকতাম পরের দিনের জন্য, এখন কি আর তেমন থাকি?

যাক সেসব কথা। মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আমাদের বাসায় শিব-দূর্গা সেজে মানুষরা আসতো, নাচ-গান করতো। মামনি ওদেরকে টাকা দিয়ে দিতো, সাথে বিভিন্ন রকমের মোয়া(চিড়া, মুড়ি, খই), নারকেলের নাড়ু। কারণ ওই দিন আমরা নিরামিষ খেতাম। যখন থেকে জ্ঞান হয় আমি দেখেছি চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মামনি পূজো দিতো রোজকার মতো নয়। সকালে উঠেই স্নান করে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রণাম দিতাম। আর মামনিকে দেখেছি সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে ভেঁজা কাপড়ে পিতলের ঘটিতে জল ভরে তার ভেতরে নিমপাতা সাজিয়ে দিতো। সেই নিমপাতার উপর সিঁদুর লাগিয়ে জবা ফুল, কাঁচা হলুদ, আড়াই টুকরো লবঙ্গ রেখে মাথার ওপর ওই ঘটি নিয়ে শীতলা দেবীর পূজা দিতো। সাধারণত নদীর পাশে বসে এই পূজা করা হয়, কিন্তু আমাদের বাগানে ছোট্ট একটা ছড়া(খাল) আর একটা পুকুর ছিলো। মাঝে-মধ্যে মামনি ভৈরব মন্দিরের পুকুরে যেতো, কখনো ওই খালে। একই সাথে গঙ্গা পূজাও করতো মামনি। প্রথমে জলে ধান-দূর্বা ছেড়ে দিয়ে দেবী গঙ্গাকে বরণ করে নেয়া হতো। আর পানের ওপর তেল-সিঁদুর মাখিয়ে তার উপরে রাখা হতো খই, জবা ফুল, ধান-দূর্বা। তারপরে সেই পান জলে ছেড়ে দেয়া হতো। সবশেষে প্রদীপ ভাসিয়ে দিতো জলে। সত্যি বলতে কি আমার ভালোই লাগতো দেখতে।

পূজো শেষ করে বাসায় ফিরে এসে মামনি উপবাস ভাঙ্গতো চা খেয়ে। তারপর চুলায় রান্না বসতো। সকালে হতো সাবু দানার খিচুড়ি, দুপুরে সজনে ডাটা দিয়ে মুগ ডাল, কাঁচা আমের চাটনি, ঘি দিয়ে নিমপাতা ভাজা, শুক্ত তরকারী, ডালের বড়ি দিয়ে নিরামিষ আর সেদ্ধ চালের ভাত। হুম সেদিন কোনো আমিষ রান্না হতোনা। আরেকটা কথা না বললেই নয়, চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই প্রথম কাঁচা আম খাওয়া হতো, তার আগে নয়। আমার জন্মের পর থেকে চৈত্র সংক্রান্তির এ রূপটি দেখে এসেছি দেশের বাইরে আসার আগ পর্যন্ত। একইরকম হলেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি। শুধু তখন নিরামিষ জিনিসটা মোটেও পছন্দ করতে পারতাম না।

খাওয়া-দাওয়া শেষ, পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি নেয়া হতো। নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সেল আমাদের বাসাতেই হতো একমাস ধরে। চা' বাগানের স্টাফ এবং তাঁদের সন্তানরা সবাই মিলে এই অনুষ্ঠান করতো শমশেরনগর চা' বাগানের বিশপ ক্লাবে। প্রথম দিকে ছোট আকারেই শুরু হয়েছিলো। তবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো আমাদের বাসা থেকেই। তার আগে বিশপ ক্লাবে শুধু স্টাফরা গিয়ে পহেলা বৈশাখের আলোচনা অনুষ্ঠান করে চলে আসতো। ১৯৮৫ সালে আমরা যখন শমশেরনগর চা' বাগানে এলাম কানিহাটি ফাঁড়ি বাগান থেকে, তখন মামনি বাপিকে বলেছিলো পহেলা বৈশাখে বাচ্চাদের নিয়ে কেন অনুষ্ঠান হয়না? আমার স্পষ্ট মনে আছে চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছি আমরা, তখন মামনি বলেছিলো বাপিকে, "পহেলা বৈশাখে কোথায় বাচ্চারা আনন্দ করবে, গান গাইবে, নাচবে। তোমরা শুধু আলোচনা অনুষ্ঠানই করো।" বাপি বলেছিলো কেউ কি আর এসবে অংশ নেবে? মামনি পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সব বাসায় বাসায় গিয়ে বলে আসলো স্টাফদের বাচ্চাদেরকে আমাদের বাসায় আসতে। শুধু বাচ্চা না, কিশোর-কিশোরী সবাইকেই। যাক তারপর দিন থেকেই বিকেলে শুরু হলো রিহার্সেল। মামনি সবাইকে শেখালো, "এসো হে বৈশাখ।" সেই যে শুরু হলো রিহার্সেল। ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমি দেখে এসেছি। সংক্রান্তির দিনে হতো ফাইনাল রিহার্সেল। সে যে কি এক আনন্দ! তারপর মামনির যতো সাদা-লালপাড় শাড়ী আছে সব ঠিক করে রাখা হতো সবার জন্য। তারপর ঘুম, নতুন বছরের অপেক্ষা।

হ্যামিল্টন, কানাডা
১২ এপ্রিল, ২০১৭ ইং।

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ