ঘটনা-০৪ঃ মনছুরা... 

সময়টা ১৯৭১। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। চারিদিকে আতংক।সারাদেশের মানুষের মতোই মনছুরা খাতুনও খুব শঙ্কিত তাঁর পরিবার পরিজন এবং অনাগত সন্তানকে নিয়ে। পৃথিবীতে তাঁর ১ম সন্তান আসছে, এই ভেবে একজন মায়ের যতোটা উচ্ছ্বাসিত হবার কথা তার চেয়ে হাজার গুন বেশি উদ্বিগ্ন মনছুরা। মনে একটাই প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত তাঁর অনাগত সন্তানটিকে কি সে পৃথিবীতে আনতে পারবে ?
সেদিন সকালে আর ১০ টা দিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজে ব্যস্ত মনছুরা। হঠাৎ কিসের যেন একটা শব্দে প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে ছুটে গেল বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছে। “আব্বা, আইতাছে ওরা...”
কিছু বুঝে উঠার আগেই দানবের মতো কয়েকটা লোক দাঁড়ালো মনছুরাদের উঠোনে। সামনে তাকাতেই সে দেখতে পেল হিংস্র নেকড়ের মতো কয়েকটা লোক এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। প্রায় আধ ঘণ্টা পাকি হানাদারগুলা হায়নার মতো মনছুরার শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে ভোগ করলো। নিজের চোখের সামনে ছেলের বউয়ের এই পরিণতি দেখে জ্ঞান হারালেন মনছুরার বৃদ্ধ শ্বশুর। এখানেই শেষ নয়; এরপরে সেখান থেকে মনছুরাকে রংপুর টাউন হলে ১৯ দিন আটক রাখে পাকি জানোয়ারগুলো। এ সময় পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিভিন্ন অফিসাররা তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করত।একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে লাগলো অনাগত সন্তানকে নিয়ে দেখা সকল স্বপ্ন। সে বুঝতে পেরে গেলো তাঁর বুকের মানিকের আর আসা হবে না এই পৃথিবীতে, আর কোনোদিন মা ডাক শুনবে না ওর মুখ থেকে। এবং তা-ই হল। মারা গেল মনছুরার গর্ভের নিষ্পাপ শিশুটি।
কোনোরকমে মরার মতো বেঁচে রইলো সে। পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে জানা যায়- তাঁকে যে রুমে আটক রাখা হয়েছিল, ঐ রুমে আরও ১০/১২ জন যুবতী মেয়ে এবং পাশের রুমেও ১০/১২ জন যুবতী মেয়ে আটক ছিল। তাদের কারও পরনে সালোয়ার-কামিজ, কারও পরনে শাড়ি ছিল। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কথা বলতে দেয়া হতো না।
তাদের সেখানে আলবদর ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাহারা দিয়ে রাখত। রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়িতে আর্মি অফিসাররা টাউন হলে আসত এবং মনছুরা ও আটককৃত যুবতী মেয়েদরকে এক এক রুমে নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা একেকজনকে ২/৩ জনে পালাক্রমে ধর্ষণ করত। মনছুরা খাতুন যে টাউন হলে আটক ছিল সেই হলের অনেক সময়েই জানালার ফাক দিয়ে দেখতে পায় যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও আলবদররা প্রতিরাতেই অনেক পুরুষ এবং মহিলাকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে চাকু দিয়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করত। একটা টিনের কৌটায় এ্যাসিড দিয়ে একটা কাপড় পেঁচানো লাঠি ঐ এ্যাসিডের মাঝে ভিজিয়ে কাটা জায়গায় দিত, নাকে, মুখে, চোখে দিত, যৌনাঙ্গে দিত, এবং মরে গেলে লাশ উত্তর পাশের কূপ এবং ঝোপ জঙ্গলে ফেলে দিত।

ঘটনা-০৫ঃ শ্যমল বরণ মেয়েটি...

শ্যামল বরন একটি মেয়ে। নামটি জানা নেই আমার। খুব মেধবী ছাত্রী ছিল সে। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে একদিন, সেবা করবে দেশের মানুষের। তাঁর সেই স্বপ্নের পথেই সে এগিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। সময়টা ১৯৭১। উত্তাল সারাদেশ। বাঙালিদের উপর বর্বরচিত হামলা চালাচ্ছে পাকি হায়নারা। ৮থেকে ৭০ কিংবা ৭৫ বয়সী নারীদেরকে ধরে নিয়ে নিকৃষ্ট অত্যাচার করছে। ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছে সেই মেয়েটি।কিন্তু বুকের ভেতর তাঁর সেই স্বপ্নটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে যত্ন করে। দেশ স্বাধীন হলেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবে সে।অন্ধকার রাত, কয়েকটি হায়নার থাবা, চিৎকার, হাহাকার। হায়নারা নারকীয় অত্যাচার চালায় সে রাতে মেয়েটির পবিত্র দেহটির উপর।কিন্তু হাল ছাড়ে নি সে । বুকের ভেতরের স্বপ্নটিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে সে।
যুদ্ধ শেষ। এবার স্বপ্নের পথে পা বাড়ানোর পালা তাঁর। কিন্তু কোন মেডিকেল কলেজেই ভর্তি হতে পারে নি সে। কারণ সে বীরাঙ্গনা। সে যেখানেই যায় সেখানেই ভীড় জমে যায়! না, কারো চোখে সহানুভূতি ছিলো না, ছিল কৌতুহল আর নোংরামি। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে স্কট করে মেডিকেল কলেজের অফিস থেকে নিরাপদে নিয়ে আসা হলো কমন রুমে। তাতেও সমস্যা মিটলোনা। শিক্ষকরা অসহায় ভাবে জানিয়ে দিলেন-তাকে ভর্তি করা বিপদজ্জনক। শ্যামল বরন মেয়েটি ফিরে গেলো, কেউ জানলোনা কোথায় হারিয়ে গেলো সে। কেবল ইতিহাসের পাতায় ‘বীরঙ্গনা’ নামের মহিমায় অদৃশ্য হয়ে রইল শ্যামল বরন মেয়েটি।
স্বাধীনতার পর এমন হাজার হাজার মেয়ে দুঃখে,কষ্টে, অপমানে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। যুদ্ধের সময় প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিল পাকি হায়নাদের দ্বারা। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পরেই তড়িঘড়ি করে চাপা দেয়া হয় সেই সব ইতিহাস। বলা হয় এসব ইতিহাস জাতির জন্য কলংকের। কোনোরকম হিসেব করে বলা হয় ৭১ এ বীরঙ্গনা মায়েদের সংখ্যা ২ লাখ। কিন্তু বিভিন্ন বিদেশি সংবাদিক এর উক্তি এবং প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ৭১ এ প্রায় ৪ লাখের বেশি নারী ধর্ষিত হয়।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রেরিত ডা. জিওফ্রে বাংলাদেশে ৭১ এ নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেছেন- “ তৎকালীন সরকারী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে যে হিসেব দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। তাঁরা জেলাওয়ারী হিসেব করেছেন। সেখানে রয়েছে সারা দেশে ৪৮০ টি থানা ২৭০ দিন পাকিস্তানিদের দখলে ছিল।এবং প্রতিদিন গড়ে ২ জন করে নিখোঁজ নারীর সংখায়নুযায়ী নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ”। কিন্তু এটা একেবারেই মনগড়া একটি হিসেব, বলা যায় দায়সারা গোছের। যোগ্যতা
জিওফ্রের মতে, এই সংখ্যা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ।  তবে পুংখানুপুংখন ভাবে হিসেব করলে এই সংখ্যটি গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখের ঘরে। বীরাঙ্গনা মায়েদের সঠিক সংখ্যা, তাঁদের উপর যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী নির্যাতন সেই সাথে বিস্তারিত আরো কিছু তথ্য  নিয়ে ভিন্ন আরেকটি সিরিজ হয়তো শীঘ্রই দিবো। আপাতত আজ এখানেই শেষ করা যাক...

শেকড়ের সন্ধানে ... (পর্ব-০১) 

শেকড়ের সন্ধানে ... (পর্ব-০২)

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ