আজ পনেরোই আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর বাঙলাদেশের এক মর্মান্তিক দিন। যে দিনের সূচনা হয়েছিলো বাঙলার এক কলঙ্কিত অধ্যায় দিয়ে। দীর্ঘ শাসন শোষণ উৎপীড়ন, সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে যখন তিনি কি করে গোছাবেন ভাবছিলেন তখন অন্যদিকে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করছিলো কুখ্যাত মস্তিষ্ক বিকৃত ঘাতকদল। বঙ্গবন্ধু তার সোনার দেশকে নিজ হাতে গড়ার সুযোগটাই পেলেন না। তবে আজ অন্যভাবে আমরা এ দিনটার তাৎপর্য তুলে ধরব। সেই বঙ্গবন্ধুর বাঙলার "ব" এর মহিমা নিয়ে জানব।

'ব’ তে ‘বর্ণপরিচয়’। বাংলা ভাষায় প্রাথমিক স্তরের শিশুশিক্ষা গ্রন্থ। শিশুদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটিই প্রথম। ১৮৮৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এটি রচনা করেন। সেই সময় থেকে অদ্যাবধি শিশুপাঠ গ্রন্থ হিসেবে এটি উভয় বাংলায় সমান গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ সকল বর্ণ দিয়েই আমরা শব্দ গঠন করি, বাক্য গঠন করি মনের যাবতীয় ভাব প্রকাশ করি।

তেমনি ‘ব’ এর মহিমাতে খুঁজব কিছু সৃষ্টি।

যে কোনো সৃষ্টিরই একটা জন্ম ব্যাথা আছে। যেমন সন্তান জন্মে মায়ের প্রসব বেদনা। তারপর জন্ম হয় এক নতুন শিশুর। নিজের সমস্ত অস্তিত্ব খুঁজে ফেরা যেনো সেখানে। এটা আমার সন্তান এই ভেবে গর্বে তার দিকে বার বার ঘাড় উঁচু করে তাকানো। প্রচন্ড মমতায় চোখের পানি গড়িয়ে পড়া। সন্তানের সাফল্যে সিনা টান করে হেঁটে বেড়ানো, বুক চাপড়ে বলে ওঠা,’হ্যাঁ এ আমার সন্তান আমার বুকের মানিক।'

এসব সৃষ্টির প্রসব বেদনা তীব্র হলেও সে বেদনার কিছুই যেনো মনে থাকে না। মুহূর্তেই যেনো সকল বেদনা হাওয়ায় উড়ে যায়।

আমরা বাঙ্গালী, আমাদেরও জন্মের এক ইতিহাস আছে, পৃথিবীতে টিকে থাকারও এক ইতিহাস আছে।

একটা পরিচিত কলি থেকে লেখাটা শুরু করিঃ

‘ভাটি হইতে আইলো বঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি।’

এখানে বঙ্গালকে ভাটি অঞ্চলের একটি এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা গঙ্গা-মোহনার পাড়ের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নিচু সমতলভূমিকেই বোঝায়। এখানে বঙ্গাল দেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে দেশে বৃষ্টিবাদল কখনোই থামে না। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় এক ভূমি এ বাংলা।

আবুল ফজল(খ্রিঃষোলো শতক) তার ‘বাঙ্গালাহ'(বঙ্গ +আল) নামের ব্যাখ্যায় বঙ্গ এর সাথে বঙ্গাল শব্দটির উৎপত্তিতে বঙ্গ এর সাথে প্রাকৃত প্রত্যয় ‘আল’ যোগ করেছেন। গ্রিয়ারসন মতপ্রকাশ করেছেন যে বঙ্গাল এসেছে ‘বঙ্গ + আলয়’ থেকে এবং বঙ্গদের বাসভূমি অর্থে। সুকুমার সেন বলেন, বঙ্গাল এসেছে বঙ্গে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী থেকে। বঙ্গাল বলতে আসলে নিন্ম ভূমির জনগোষ্ঠীকেই বোঝাতে চেয়েছেন এসব পণ্ডিতেরা।

পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তরে শিলং মালভূমির পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বরাবর বিস্তৃত অববাহিকা। এটি মূলত টারশিয়ারি যুগের শিলাস্তর দিয়ে পরিপূর্ণ, যদিও উত্তরবঙ্গে ভূগর্ভে অতি প্রাচীন পারমিয়ান যুগের শিলাস্তর বিদ্যমান। ভূত্বকীয় ভারতীয় প্লেট এবং এশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে বঙ্গীয় অববাহিকার উৎপত্তি হয়েছে।

ইয়োসিন উপযুগের শেষাংশে এই সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে একদিকে টেথিস সাগরের বিলুপ্তি এবং অপরদিকে হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি। এই দুটি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বঙ্গীয় অববাহিকার জন্ম হয় এবং ক্রমাগতভাবে তা হিমালয় পর্বত থেকে আগত নদীধারা কর্তৃক বাহিত পলিমাটি দ্বারা ভরাট হয়ে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সৃষ্টি করে।

দুটি হিমালয়ী নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, সম্মিলিত স্রোতোধারায় বিশ্বের যে কোনো নদী-ব্যবস্থার তুলনায় সবচেয়ে বেশি অবক্ষেপ বঙ্গোপসাগরে এনে ফেলছে। হিমালয়ের আশীর্বাদ হিসেবে গঙ্গা ও যমুনা বাংলাকে করেছে সুজলা সুফলা। এই দুই নদী অপর অ'হিমালয়ী নদী মেঘনার সহযোগে বিশ্বের সর্ববৃহৎ যে ব-দ্বীপটির সৃষ্টি করেছে, সেটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ বা বঙ্গীয় বদ্বীপ নামে পরিচিত।

বাংলায় মানব বসতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। বর্তমান সময়কালের উদ্ভিজ্জ আবরণ ও ভূদৃশ্য কয়েক হাজার বছরের মানবীয় কর্মকাণ্ড ও প্রভাবের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান এবং ভূ-পৃষ্ঠে বসতির ধরন ও কৃষিকাজ থেকে এতদঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। বাংলায় বসতির ক্রমবিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ভূমির উচ্চতার বিন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, সমগ্র প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলার অধিকাংশ স্থানই ছিলো হিংস্র জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ বনজঙ্গল ও জলাভূমিতে আচ্ছাদিত।

এক কথায় এই ভূমি ছিলো বিশ্বের অন্যতম বন্যপ্রাণি সমৃদ্ধ বৃষ্টিবহুল বনভূমি সমূহের একটি। যেখানে হাতি, বাঘ, বুনোমোষ, তিন প্রজাতির গণ্ডার এবং সাত প্রজাতির হরিণ বিচরণ করতো। ঐতিহাসিক সময়কালে এ নিন্ম ভূমির অধিকাংশ অঞ্চলই ছিলো মানুষের বিচরণের জন্য অনুপযোগী। তবে প্রাচীন সময়ে কৃষি সম্ভাবনা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কারণে এ দেশে বসতি গড়ে ওঠে। বিদেশী পর্যটক শাসকদেরও বার বার এ দেশে আসা এ ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে। এ বাংলার মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে প্রকৃতি ও বিদেশি পর্যটক শাসক গোষ্ঠীর সাথে। তা আমরা বিভিন্ন পুঁথি পাঠ করলেই স্পষ্ট ধারনা পাই। কিছু পুঁথির কথা উল্লেখ না করলে পাঠককে হয়তো অতুষ্টি করা হবে, যেমনঃ ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে!’ এখানে বর্গী বলতে দস্যুদের কথা বলা হয়েছে। আমরা ইতিহাস পড়লে তাদের অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারি। আর একটা ছড়া যেমনঃ 'ধান ভানলে কুঁড়ো দিব, কালো গাইয়ের দুধ দিব।’ এসব ছড়া ও পুঁথির ইতিহাস থেকে আমরা বাংলার মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে পারি।

বাংলায় প্রথম আর্যরা গাঙ্গেয় অববাহিকার উজান অঞ্চল দখল করে বসবাস করতে শুরু করে এবং এ অঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে তারা এসেছিলো। যাদেরকে তারা নাম দিয়েছিলো ‘নিশাদাস’ যার অর্থ বন্য মানুষ। সম্ভবত এরাই ছিলো বর্তমানের বাংলাদেশ গঠনকারী অঞ্চলের আদি অধিবাসী। তাই আদিবাসীদেরই আমরা বাংলারই মানুষ বলতে পারি।

এ অঞ্চলে মানব পরিব্যাপন এবং বসতি বন্টনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ামক প্রভাব বিস্তার করেছিলো।

এই ভূমির মানুষজন ধীরে ধীরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে করে একটা বসতি গড়ে তুলেছে। তারা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে তারা বীর বাঙ্গালী।

ইতিহাসের দীর্ঘ পথ অতিক্রম(পর্যটক শাসক থেকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং সর্বশেষ বর্বর পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া) করে বাংলা নামক একটি দেশের সৃষ্টি হয়েছে। প্রসব বেদনার মতো সমস্ত কষ্ট সহ্য করে যেনো পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে এক নতুন সন্তানের জন্ম। যার বর্তমান সাফল্যের উদাহরণ দিচ্ছে বিশ্ব।

আমাদের বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। আমাদের আছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে স্বাধীনতা অর্জন করার এক ব্যতিক্রমী রক্তাক্ত ইতিহাস আছে আমাদের। একুশকে নিয়ে আমাদের এই অহংকার শুধু এখন আমাদের বুককে শোকে কাঁপায় না, তাকে সম্মান দেয় পৃথিবীর সকল দেশ। আমাদের একুশ এখন সবার। আমার মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা এখন পৃথিবীর সকল দেশের সকলের মাতৃভাষার প্রতিনিধিত্ব করছে, সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মাতৃভাষার গুরুত্ব। ইউনেস্কো দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। এ ভাষার সম্মান এমন যে তার জন্য একটা জাতি জীবনও দিতে পারে। আর তারা বাঙ্গালী জাতি। যা পৃথিবীর আর কোনো জাতি দেয় নাই। আমরা দেখেছি এ পর্যন্ত কতো ভাষার বিলুপ্তি হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের ভালবাসায় ও রক্ত দিয়ে এ বাংলা ভাষাকে আগলে রেখেছি।

একুশেই আমরা শিখেছিলাম কিভাবে রক্ত দিতে হয়, কিভাবে জীবন দিতে হয়, কিভাবে আন্দোলন প্রতিবাদ করতে হয়, কিভাবে কোন কিছু অর্জন করতে হয়। কিভাবে শত্রুকে বাধ্য করতে হয়, কিভাবে তাদের হাত থেকে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। একুশের আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে গেছি। স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। আর এ দেশটি স্বাধীন করতে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন,’বঙ্গবন্ধু’ বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে পাকিস্তানীদের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার ভাষনে বাংলার মানুষের মনে এমন এক আলোড়ণ তুলতে পেরেছিলেন যে মাত্র নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ দেশটাকে স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ, বাঙ্গালির প্রতি তার ভালবাসার কথা বলতে গেলে এ প্রবন্ধটি শেষ করতে পারব না। শুধু একটি কথাই বলতে চাই, বাঙালী হিসেবে বাংলা ও বাংলার মানুষকে ভালবেসে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই দিনের পর দিন এ দেশের মানুষের কথা বলে গেছেন। বার বার কারাবরণ করেছেন। বাঙ্গালীকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুই। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের পরিচিতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ দেশকে স্বাধীন করে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাংলার স্বাধীন মাটিতে ফিরে আসেন তাও বাহাত্তর সালে জানুয়ারী মাসে।

আমাদের মানচিত্রটি দেখলেই দেখতে পাই এটা একটা ব-দ্বীপ আকৃতি। যা এখন বিশ্বের দরবারে উন্নতির রোল মডেল হিসেবে দাড়িয়ে আছে।

বাংলা সাহিত্য চর্চায় এ ব্লগ হবে একটি উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। কারণ, বাংলা সাহিত্য সগৌরবে তার হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকল পর্যটক শাসক গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে টেক্কা দিয়ে। তবে এ কথাও অস্বীকার করছি না যে এ সকল সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও হয়েছে।

‘ব’ তাই একটি মাত্র অক্ষরই শুধু নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে কিছু আত্মার নাম নিজেদের অস্তিত্বের নাম।

বায়ান্ন থেকে বিজয় সব কিছুতেই ‘ব’ এর মহিমা।

‘ব’ তে বাংলা, বাঙ্গালী, বঙ্গবন্ধু, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গৌরব এবং বাংলাদেশ। ‘ব’ এর মহিমা নিয়ে বাঙলার মাটিতে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রবে মানুষের ভালবাসায় পৃথিবীর আয়ুকাল পর্যন্ত। ‘ব’ তে আর একটি নাম জড়িত আছে তা হলো, আমার জেলা শহর বাগেরহাট। আর এ জেলাতেই আছে পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর। ঐতিহাসিক স্থাপনা খানজাহান আলীর মাজার।

‘ব’ এর সকল মহিমায় উজ্জীবিত হোক সকল মানব সমাজ। সকল কলুষিত ধুয়ে মুছে যাক এই কামনা।

সবশেষে বলতে চাই,,

যতোদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান
ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান'

ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

,,রিতু জাহান,, রংপুর।

ছবিটি আমার ছেলের আঁকা।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ