অনেক বছর আগের কথা।
আমার এক বন্ধু নিউইয়র্ক শহরে নতুন ট্যাক্সি চালানো পেশায় নেমেছে। এক আমেরিকান যাত্রী উঠেছে তাঁর গাড়িতে। বিশ মিনিট দূরত্বে যার গন্তব্য। আমার বন্ধুটি সোজা রাস্তা এড়িয়ে দূরের রাস্তা দিয়ে ঘুরে যাত্রীকে তাঁর গন্তব্যে নামিয়ে দেন মিটারে বেশি ভাড়া উঠবে, সে আশায়। মধ্যবয়সী যাত্রী স্মিত হেসে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যাবার আগে বললেন, " ইয়ং ম্যান, তুমি যে বিশ মিনিটের রাস্তা হাইওয়ে ধরে ত্রিশ মিনিট ড্রাইভ করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো, তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।" যাত্রীর মুখের কোনে ঝুলে থাকা এক চিল্তে হাসি বিদ্রুপের কিংবা তাচ্ছিল্যের ছিল কিনা কে জানে ! তবে আমার বন্ধুটি ভীষণভাবে লজ্জিত হয়েছিলো সেদিন। এরপর আর কখনোই সে বাড়তি কিছু অর্থ উপার্জনের জন্যে এমন অসৎ পন্থা অবলম্বন করেনি।
এক কাজিনের কথা বলি।
অল্প বয়স, সবে স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিনকার চেনাপথ দিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাওয়া এক বালিকাকে তাঁর ভাল লেগে যায়। বালিকার পিছু পিছু স্কুল পর্যন্ত সেও হেঁটে যায় প্রায়ই। প্রেম নিবেদন করার সাহস হয়নি তখনো, বিধায় কখনো কখনো স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটিকে একনজর দেখবে বলে। মেয়েটিকে রোজ সকালে স্কুলে পৌঁছে দেন তাঁর বাবা। সম্ভবত সব বাবারাই অজানা আশংকায় চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন কন্যাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তিনি বিষয়টি লক্ষ্য করেন। একদিন আমার কাজিনকে ডেকে কাছে টেনে নেন পরম মমতায়। বলেন, " বাবা, আমার কন্যাটি প্রতিদিন এ পথে স্কুলে আসে, দেখে রেখো তোমার এই ছোটবোনটিকে।" সেইদিন আমার কাজিন "পৃথিবী দু'ভাগ হও, প্রেম চাই না, মাফ চাই" টাইপের লজ্জা পেয়ে আর কোনদিন ওপথ মাড়ায়নি। নিজের পড়াশুনায় মনোযোগী হয়েছে।
এবার নিজের কথা বলি।
শপিং মলের পার্কিং লটে গাড়িতে বসে আছি। প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত। পানি পান করে খালি বোতলটি হেঁয়ালি করেই বাইরে ফেলে দেই। কিছুক্ষন পরেই একজন ভিনদেশী বৃদ্ধ জানালার কাঁচে টোকা দিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। কাঁচ নামালে খুব বিনয়ের সাথে বললেন, "এক্সকিউজ মি ম্যাম, সম্ভবত এটি তোমার হাত থেকে অসাবধানতাবশত পরে গিয়েছে।" সামনে বাড়িয়ে দিলেন ফেলে দেয়া সেই বোতলটি। আমি ওহ্, সরি, থ্যাংকস টাইপের কিছু শব্দ উচ্চারণ করি বিড়বিড় করে। সেদিন আমি এক সমুদ্র সমান লজ্জায় ডুবে গিয়েছিলাম যেন। এরপর আজ এতগুলো বছরের প্রবাস জীবনে আর এমন ভুল হয়নি ভুলেও। সেই থেকে আজ অবধি হাতে থাকা চিপস্ এর খালি প্যাকেট কিংবা কোকের ক্যান বাড়িতে নিয়ে এসে ময়লার ঝুড়িতে ফেলি।
জীবন আমাদের কতভাবে কত কি-ই না শিখিয়ে দিয়ে যায়। প্রতিদিন আমরা শিখছি। প্রতিদিন আমরা বদলাচ্ছি একটু একটু করে। তবে, কিছু শিক্ষা আমাদের বোধকে কি গভীরভাবেই না নাড়া দিয়ে যায়, তাই না ?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৩টি মন্তব্য
নাসির সারওয়ার
আসুন, এই পোস্টের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের বোধ শিক্ষা শেয়ার করি। আমি নিশ্চিত আমরা একে অপরের কাছ থেকে কিছুনা কিছু শিখবো।
ছোটবেলার কথা – দুষ্টামির ছলে একটা রিকশার তিনটা চাকাই ফুটো করে দিলাম। রিকশাওয়ালা ভেজা চোখে বলেছিলো, “আমার ছেলেমেয়ারা আজ না খেয়ে থাকবে”।
এরপর থেকে চেষ্টা করছি ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে, পারলে দু চার টাকা বেশী দিতে। আমাদের দু চার টাকা দিয়ে ওরা কিন্তু বাড়ি গাড়ি বানাবেনা।
ঐ ভেজাচোখ দুটো এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
নাসির সারওয়ার
এই লেখাটা প্রথম আলোতেও আছে। সোনেলা অবশ্যই গর্ব করতে পারে।
http://m.prothom-alo.com/durporobash/article/1003227/%E0%A6%AC%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE
রিমি রুম্মান
ভাল বলেছেন। আমরা আমাদের নিজেদের উপলব্ধির শিক্ষাগুলো শেয়ার করতে পারি। এতে আমরা অনেক কিছু শিখতেও পারবো । আমি প্রথমত আমার লেখা ” সোনেলা”য় দেই। আরও বেশি সংখ্যক পাঠক পড়তে পারে যখন সেটি কোন জাতীয় পত্রিকার অনলাইন নিউজপোর্টাল কিংবা তাঁদের ফেসবুক পেইজে পাবলিশড হয়।
অনেক শুভকামনা।
রুম্পা রুমানা
বাইরে চিপস চকলেট যা ই খাই প্যাকেটটা পার্সে করে বাসায় নিয়ে আসি । অভ্যেসটা অনেকদিনে আয়ত্ত করেছি। নিজের শহর নিজেকেই রাখতে হবে সুন্দর। ভাল্লাগলো আপনার লেখাটা ।
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন। শুভকামনা রইল।
আবু খায়ের আনিছ
এই বোধ শক্তিটুকুই যে অনেকের জাগ্রত হয় না। তবে শিক্ষা নিতে চাইলে শিক্ষাক্ষেত্রের অভাব হয় না। ছোট ছোট এই বিষয়গুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে জীবনকে সুন্দর করতে পারি।
খুব ভালো একটা পোষ্ট।
আবু খায়ের আনিছ
আপনার লেখাটি অনেকগুলো অনলাইন নিউজ এ দেখলাম, সাথে দেশের প্রথম সারির পত্রিকা প্রথম আলোতেও দেখলাম। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।
রিমি রুম্মান
আমাদের ভুলগুলো আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনা হয়তো। অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করলে আমরা খুব দ্রুতই তা দেখতে পাবো , বুঝতে পারবো। অনেকটা “মনে করিয়ে দেওয়া” র মতন।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল।
ব্লগার সজীব
যাদের লজ্জার বোধ নেই তারা এসবকে পাত্তা দেয় না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় লজ্জাহীন অসৎ মানুষ। আমাদের এই বোধ জাগ্রত থাকুক।
রিমি রুম্মান
বোধ জেগে উঠুক। ভুলগুলো শুধরে নেই। এটাই হোক প্রার্থনা।
ইঞ্জা
বেশ শিক্ষণীয় কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ শিখবেনা উল্টা বেশি বেশি করবে এমন অসভ্য হয়েছি আমরা। 🙁
রিমি রুম্মান
আমাদের দেশে এমন সূক্ষ্মভাবে কেউ ভুলগুলো ধরিয়ে ও তো দেয় না।
অনেক শুভকামনা।
ইকরাম মাহমুদ
বোধের পুনর্জন্ম হোক।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা রইল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এ অভ্যাসটি আমিও মেনে চলি। রাস্তায় কিছু ফেলতে পারিনা।
আর ট্যাক্সিচালকের কথা বললেন! আমাদের দেশেতো এখন এটি গড়পড়তা সকল সিএনজিওয়ালাই করে।
রিমি রুম্মান
ওরা গরীব মানুষ। অভাবে স্বভাব নষ্ট। কিন্তু এইদেশে তো কেউ গরীব নই আমরা। অন্তত খেয়ে পড়ে সুন্দর একটি জীবন তো যাপন করছি। তাই এমনটি করা উচিত নয় আমাদের।
নীলাঞ্জনা নীলা
এ বোধ যেদিন আমাদের দেশের সবার মধ্যে আসবে, সেদিন দেশের পথ-ঘাটে শোয়াও যাবে।
আর ট্যাক্সিচালকদের কথা তো বাদই দিলাম। এখানেও একই।
রিমি আপু অনেকদিন পর তুমি পোষ্ট দিলে, খুব ব্যস্ত নাকি?
ভালো থেকো। -{@
রিমি রুম্মান
নীলা’দি, ব্যস্ততার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। ছেলের পরীক্ষা শেষ হলেই নিয়মিত আসতে পারবো আশা করছি।
ভাল থেকো। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস তোমরা সবাই ব্যস্ত। কবে যে আমি ব্যস্ততায় ডুববো!
ভালো থেকো আপু।
ছাইরাছ হেলাল
শিখতে চাইলে শেখা হয়েই যায়, শুধু প্রবল ইচ্ছেটুকু খুবই দরকার।
রিমি রুম্মান
আমাদের প্রবল সেই ইচ্ছেটুকু আসুক পরিবার থেকে। তারপর আশেপাশের মানুষগুলোর থেকে।
লীলাবতী
এমন বোধ যদি আমাদের থাকতো দেশটিই পালটে যেতো আপু।
রিমি রুম্মান
আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। আমার বিশ্বাস একদিন আমাদেরও কোন কোন দেশ অনুসরণ করবে।