বেরসিক দুপুরে

রোকসানা খন্দকার রুকু ১ ডিসেম্বর ২০২১, বুধবার, ০১:২৮:০২অপরাহ্ন উপন্যাস ১৯ মন্তব্য

বিয়েটা পরে আর এগোয়নি। বাবা যেহেতু চাইতেন আমি ভালো কিছু করি তাই শাহরুখের চ্যাপ্টারে আগুন ধরিয়ে পড়ার টেবিলেই পরের কিছু বছর মুখ গুঁজে থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে ভাইয়া বিয়ে থা করে নিজের মতো গুছিয়ে , নিজের সংসারে  ব্যস্ত। সেখানে আমাকে নিয়ে তার আর ভাবার সময়ও হয়তো ছিলো না। তাই যে সময় বিয়েতে স্যাটেল হবার কথা ছিলো তা আর হয়ে ওঠেনি।

বয়স কখন যেন বাড়তে বাড়তে তেত্রিশ পার হয়ে গেছে বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু মাঝে একটা ঘটনা আর বাবার আমাকে একা করে চলে যাওয়া তার সাক্ষী। মনের ভেতর যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। তা মোছানোর মতো সাহস ছিলো না। তাই আর নতুন করে কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করেনি। মন সব সময় বলেছে এই তো ভালোই আছি!

মা আর আমি। অভ্যস্ত জীবন। সহজ রুটিন। মাকে বাই বলে সকালে কলেজ চলে যাওয়া। কলেজে কলিগদের সাথে খুনসুটিময় সময় কাটানো। স্টুডেন্টদের সাথে অযথা চিৎকার, বকাঝকা, ক্লাস, ক্যান্টিন, কম্পিউটার ল্যাবের হিন্দি গান এসব শেষে বাসা।

অভ্যস্ত ছিলাম এমন রুটিনে। আজ কেন যেন সব রুটিন এলোমেলো হয়ে মন বলছে, এতোদিনের জীবন জুড়ে চলছিল আসলে কার্তিকের অমোঘ খরা। হঠাৎ তাতে বর্ষা নেমে কেমন ভিজিয়ে দিলো। শুধু ভিজলে না হয় হতো, একেবারে কর্দমাক্ত অবস্থা। এ বয়সে টুকটাক জানালার গরাদ পেরিয়ে ঝিরঝির বৃষ্টি চলে। কিন্তু যা হলো তা সহ্য করাটা একটু কষ্টসাধ্যই হয়েছে। দশ বছর আগের সেই ফেলে আসা বর্ষা হঠাৎ শরীরে কেমন শীতের কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। এ কাঁপুনি লেপ, কাঁথা, কম্বলে নিবারণ হয় না। বরং বাড়তেই থাকে।

কলেজ থেকে আজ তারাতারী বাসায় ফিরে এলাম। মা খুব খুশি খুশি হয়ে ডাকছে-‘ কি রে সংকলিতা খেতে আসবি না? আজ তোর পছন্দের রেসিপি! আয় তারাতারী।‘

খাবার টেবিল আজ মোটেও টানছে না। তার বদলে কেমন বিছানা টানছে, একাকিত্বতা টানছে। কি যেন ভাবতে মন চাইছে।

অন্যদিন হলে রেসিপি জানতে চাইতাম আজ ইচ্ছে করলো না। টেবিলে খেতে গেলাম কিন্তু খাওয়াতেও তেমন মন নেই। প্রিয় চিংড়ি কচুতেও না।

দুপুরের খাবার পর আমার অতি প্রিয় ভাত ঘুম আজ আর এলো না। বিছানায় এপাশ- ওপাশ করলাম খানিকক্ষণ। কেবলই মনে হচ্ছে আজ বিকেলটা বড্ড দেরিতে আসছে কেন বুঝতে পারছি না। অপেক্ষা করছি একজনের তিনি আসবেন। এতোবছর পর নতুন করে এ অপেক্ষা কষ্ট দিচ্ছে, মন যেন তরুনীদের মতো আনচান করছে। এমন অনূভুতি কাউকে শেয়ারও করা যায় না।

আমি যে বাসায় থাকি তিনি আমাকে মেয়ের মতোই দ্যাখেন। প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই একটা টান তৈরি হয়ে গেছে। হয়তো তার মেয়ে প্রবাসে থাকেন বলেই তিনি আমায় দিয়ে অভাব পূরনের চেষ্টা করেন। তার অধিকাংশ জরুরী কাজ আমিই করে দেই। তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে বেড়াতেও যাই। আমার অনুপস্থিতে তিনি মার খোঁজখবর রাখেন। ভালো- মন্দ রান্না এবং তার পারিবারিক সকল অনুষ্ঠানেই আমাকে রাখেন। আন্টিকে ফোনেই জানিয়েছি সব। ব্যাচেলর ভাড়া দেন না তবুও আমার জন্যই রাজী হলেন। হয়তো তিনি আমার কথায় কিছু খুঁজে পেয়েছেন। আঙ্কেল একটু রাগী টাইপ মানুষ। কিন্তু বউ এর কথা ফেলেন না।

কলিং বেল বাজলো ঠিক পাঁচটায়। বেরসিকের সময় জ্ঞান প্রকট বোঝা গেলো। আশফাক আহমেদ, নামের মতো একদমই না। সেই সকালের মলিন শার্ট আর স্যান্ডেল পায়েই আছেন। থাকবেনই বা না কেন? তিনি তো আর জানেন না যে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাহলে হয়তো বদলে আসতেন।

কিংবা এতো দেরী না করে, দুপুর দেড়টায় কলেজ থেকে বেডিয়ে আর একটু আগে আসতেন আমাকে দেখা দেবার জন্য। আমি যে তার জন্য মরে যাচ্ছি, সেই মরণ যাত্রা রোধ করতেন তারাতারী এসে।

ভাবছি বিয়ের পর আশফাক আহমেদকে একটু টাইট দিতে হবে। মানে স্মার্ট বানাতে হবে।আধা কাচের চশমা বদলে ব্রান্ডের চশমা পরাতে হবে। বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক সাজার তার যে চেষ্টা তা বদলে একটু রংচঙ দেখে কাপড়- চোপড় পরালে তখন সংকলিতার হাজবেন্ড হিসেবে চলবে।

-কি হলো ভেতরে যাবো না? গেটেই দাডিয়ে রাখবেন?

-ও হ্যাঁ, আসুন। আন্টি বাসাতেই আছেন।

আবার আমার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। কি সব ভাবছি আমি। এও কি সম্ভব! আমি কি পারবো আবার নতুন করে সব শুরু করতে?

চলবে——

ছবি- নেটের

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ