বীরাঙ্গনা শেষ পর্ব

মনির হোসেন মমি ১৪ অক্টোবর ২০১৪, মঙ্গলবার, ০৭:০৬:২৪অপরাহ্ন গল্প, মুক্তিযুদ্ধ ২০ মন্তব্য

পাকিদের অমানবিক নির্মম শারিরীক অত্যাচারে ফুলী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।ফুলীর চোখঁ ঘূড়ে ঘূড়ে দেখে ছোট ক্যাম্প কি ভাবে ধীরে ধীরে ভরে গেল শিশু থেকে ষাট বছরের ধর্ষিত বৃদ্ধায়।ফুলী অবাক হন একটি আট দশ বছরের অন্তঃসত্ত্বার কিশোরীকে দেখে।যে বয়সে বাবার হাতটি ধরে কৈশরের রঙ্গীন স্বপ্নগুলোকে পেড়িয়ে যাবার কথা যে বয়সে অবাক পৃথিবীকে চেখে দেখবার কিংবা উপভোগ করার কথা সেই বয়সেই অনাগত ভবিষৎ প্রজন্মের ভার সয়ে যাওয়া এ বড় বেদনাদায়ক জীবনের বাকী ইতিহাস।

ফুলীরা পাকিদের অত্যাচারের মাত্রার কাছে মাথা নত করেননি মাথা নত করেছেন এ দেশের মা মাটির কাছে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ত্বের দাবী আদায়ে এ অত্যাচার যেন একটি স্বাধীন দেশের বীজের অঙ্কুউদ্দ্যমের।ফুলীদের স্হানীয় পাকি ক্যাম্পেটি ছিল টিন সেট ওয়াল আর ক্যাম্পটির পিছনে ছিল গভীর জঙ্গল বলা চলে পুরো ক্যাম্পটি ছিল একটি বিশাল জঙ্গলের মধ্যখানে কৃত্রিম ভাবে পাকিদের তৈরীকৃত আস্তানা।

ক্যাম্পের শেষ মাথায় কর্ণারে দূর থেকে ভিতরে না ঢুকলে কি হচ্ছে সেখানে বলা মুশকিল সেই স্হানে ফুলীর বুদ্ধি মত্তায় সুরঙ্গ খুড়া শুরু করেছিল বহু আগ থেকেই সর্তকতায় আজ রাত অনুমানিক দশটায় সুরঙ্গ খুড়া শেষ হয়....আজই ওরা প্লান করেন যে করে হউক আজই পালাতে হবে এ নরক থেকে।ঠিক যে কথা সেই কাজ ফুলী সহ বেশ কয়েক জন সবল বীরাঙ্গনা নরক থেকে বেড়িয়ে পড়েন সুড়ঙ্গ দিয়ে বাকী যে কয় জন দূর্বল অচল রয়ে গেলেন তারা পরবর্তীতে জানা যায় সেই ক্যাম্পটি ১৪ই ডিসেম্বর আগুন লাগিয়ে বীরাঙ্গনা সহ পুড়ে ছাই করে দেন পাকিরা।

ফুলীরা ধীরে সাবধানে পথ চলতে শুরু করেন নের্তৃত্ত্ব দেন ফুলী বীরাঙ্গনা।গভীর জঙ্গলে অন্ধকারে দুরের কিছুই দেখা যায় না শব্দের অনুমানে পথ চলে ওরা, কখনও ঝর্ণার স্রোত ধারায় কখনও ডোবা সাতরিয়ে।অর্ধ নগ্ন অন্তবাস আর কোন মতে জীর্ণ কাপড় ব্লাউজে ঢাকা উলঙ্গ শরীলে জুক কেচোর আঘাত বোধহীন দেহে এমন বিষাক্ত সাপের ছোবলের যন্ত্রনাও যেন কিছুই নয়।পথে যেতে যেতে হাতে কুড়িয়ে নেয় অগ্রভাগ সরু ডালপালা।কিছু দূর এগুতে চোখেঁ পড়ে কিছু ময়লার স্তুব তা সড়িয়ে অবাক হন ফুলীরা অনেকগুলো গ্রেনেট বোমা যে যে কয়টা পারছেন কোমড়ে হাতে গুজে নেন বোমা গুলো ভেবে, হয়তো প্রয়োজনে কাজে লাগবে।আরো কিছুক্ষণ হাটার পর ক্লান্ত দেহে চোখ পড়ে বাহিরের পৃথিবীর আলো বাতাস।

বনের মাঝেই একটি সরু মেঠো রাস্তা পথ দেখিয়ে দেয় গভীর জঙ্গল হতে বের হবার বাধ সাধে সরু পথটিতে কিছু পাকি সৈন্যদের পাহাড়া দেয়ার আনাগোনা।ফুলীরা বুদ্ধি আটেন কি ভাবে ওদের নজর এড়িয়ে এ পথ দিয়ে জঙ্গল হতে বের হওয়া যায়।ফুলীর কথা মত দু'জন বীরাঙ্গনা ছোট ছোট খেছুর গাছের সরু কাটা দিয়ে এলোথেলো চুলগুলো ঠিক করে অন্যের পরিধানের পেডিকোটে কাদামাক্ত মুখটি পরিষ্কার করে একে বাড়ে চির যৌবনা সেজেঁ পথটি পাড় হতে চলছিল হঠাৎ এক পাকি সৈন্যের পিছু ডাকে থমকে ভয়ে দাড়িয়ে পড়েন দুই বীরাঙ্গনা।পাকি সৈন্যটি তাদের কাছাকাছি এসে নজর দিয়ে দেখতে থাকে তাদের।

-কি য়া নাম তোমাহারা?

-জি,আমি মোহিনী...

-আমি বকুল...

সৈন্যটি মিচকি হাসছে।

-বাহ্..মারহাবা বকুল ফুল....

তাদের কথার মাঝে ফুলী সহ অন্যরা হঠাৎ আক্রমন করেন সৈন্যটির উপর অবশেষে স্বাসরুদ্ধ করে টেনে হিচড়ে জঙ্গলে এক ডোবায় ফেলে দিয়ে দ্রুত ফুলীরা কেটে পড়তেই দূর দিগন্তে চোখেঁ পড়ে একটি পাকি সৈন্য ভর্তি লরি তাদের দিকেই আসছে...ফুলীরা লুকিয়ে পড়ে পথের ঢালুতে লরিটি কাছা কাছি আসতেই পর পর কোমড়ে গুজানো হাত বোমার স্প্রিংটার টান দিয়ে খুলে ছুড়ে মারে লরিকে লক্ষ্য করে।মুহুর্তেই ড্রাইভার চালিত কন্ট্রোল হারিয়ে গর্তে পড়ে লরিটিটি সাথে সাথে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় লরিতে থাকা পাকিরা এরই মাঝে ফুলীদের সাথে যোগ দেন সেখানকার মুক্তি যোদ্ধারা আর যায় কোথায় পাকিরা বাবা আপনা জান বাচা কেউ পালিয়ে কেউবা বোমার আঘাতে লাশ হয়ে পড়ে থাকে পথের ধারেই।মুক্তি যোদ্ধার দলটি বীরাঙ্গনাদের সহযোগিতা করেন তাদের গন্তব্যের পথে।ফুলীকে এক যোদ্ধা প্রশ্ন করেন।

-এই হাত বোমাগুলো কোথায় পেলেন?

ধীরে মৃধু কান্ত অর্ধ ভাঙ্গা শব্দে উত্তর দেন।

-জঙ্গলের ভিতরে,

-যাক,তাহলে স্বার্থক হলো খুজেঁ পাচ্ছিলাম না জঙ্গলে আমাদের লুকিয়ে রাখা বোমাগুলো....শব্দ শুনে ছুটে এসে দেখলাম আপনারা এর ব্যাবহার করছেন।তা এখন যাবেন কোথায়?

-জানি না,তবে প্রথমে আমার গ্রামে যাব।

-আমরা কি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

-অবশ্যই ...চলুন।

সরু পথ শেষে নিজ গ্রামে ঢুকার আগ মুহুর্তে ফুলী দেখতে পেল এক দল লোক আনন্দ করে বন্দুক উচিয়ে গান গাইতে গাইতে আসছেন "জয় বাংলা বাংলার জয়......।কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখতে পেলেন আরো একটি দল আসছেন এ দিকেই আনন্দ আর উল্লাসে, তার পর আরো একটি দল এভাবে দলে দলে আনন্দে আত্ত্বহারা হয়ে আসতে থাকেন এ দেশের অকুতভয় মুক্তি যোদ্ধা।লোক মুখে শুনা গেল পাক সরকার আত্ত্বসর্মপণ করেছেন বাংলার দামাল ছেলেদের আত্ত্ব বিশ্বাসী যোদ্ধাদের নিকট।

দেশ স্বাধীন হয় পৃথিবীর বুক চিড়ে উদিত হয় একটি নতুন সূর্য্য যার নাম বাংলাদেশ।রক্তে ভেজাঁ অর্জিত স্বাধীনতা শস্য শ্যামলা সবুজ বাংলা হয়ে উঠে দেশের লাল সবুজ রংয়ের পতাকা।গ্রামে ফিরে যান ফুলী প্রান ভরে স্বাধীনতার শীতল বাতাস গ্রহনের আশায় কিন্তু স্বদেশীয় মানুষগুলোর অত্যাচারিত ফুলীর দিকে তাকানো চোখগুলো যেন বলে দেয় "ফুলী নামক বীরাঙ্গনারা এদেশে এখন নিষ্প্রয়োজন এরা এ দেশের যেন কলংক এদের দেহে শত্রুদের বিষাক্ত বীজ"। যুদ্ধের সময় নয়মাস তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আল বদর, আল শামস, রাজাকার আর বিহারীদের কাছে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে। আর যুদ্ধের সময় বা পরে যারা তাদের মিত্র হওয়ার কথা ছিল, পরম স্নেহে বা ভালবাসায় বুকে টেনে নেবার কথা ছিল, সেই বাপ-চাচা, ভাই বেরাদারেরাই তাদেরকে ধর্ষণ করেছে মানসিকভাবে, আরো করুণভাবে, আরো দয়াহীন ভাবে।ফুলীর আত্ত্বীয় স্বজনও তাকে সে দিন বিতারিত করেছিল গ্রাম থেকে।লজ্জ্বায় মুখ ঢেকে রাতের অন্ধকারে ভিক্ষাবৃত্তি করে চলে আসে এই ঢাকা শহরে তার এ লজ্জ্বা যেন আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অপারগতা আমাদেরই লজ্জ্বা।পায়নি তার  মহান আত্ত্ব ত্যাগের বিনিময়ে এতটুকু ভালবাসা কিংবা  রাষ্ট্র পারেনি দিতে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি কিংবা মানুষের স্নেহে বেচে থাকার প্রেরনা।

লেখকের কলমের ইঙ্কের লেখনির গতি যেন মন্থর হতে থাকে ঘটনার বর্ননায় যেন বাধা আসে লেখকের চোখের কোণে জমে থাকা কাগজে পড়ন্ত কষ্টের লোনা জলে।বৃদ্ধ ফুলীকে সালাম করে লেখক যদিও সে দিনের মতন চলে এসেছিলেন সেখান থেকে কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাকে আর সেখানে খুজেঁ পাওয়া যায়নি কেউ জানেও না সে এখন কোথায় হয়তো রাগে দুঃখে কিংবা অভিমানে জীবনকে চিরতরে ঢেলে দিয়েছেন পরম শান্তির পরপারে।

প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

বিভিন্ন লেখকের সারমর্ম

যুদ্ধ মানে ধ্বংস যুদ্ধ মানে লক্ষ জীবনের অবসান।পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের পাশা পাশি ১৯৭১ এ দেশে ফুলীর মতন অনেক বীরাঙ্গনাই হাতে তুলে নিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র।হয়ছিলেন সম্ভ্রম হারা অত্যাচারিত পাকিদের কামনার খোরাক যার বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন দেশ কিন্তু যাদের আত্ত্ব ত্যাগে অর্জিত হয়েছিল এ গৌরবময় অর্জন তাদেরই আমরা রেখেছি অমর্যাদায় অবহেলায়।

‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা'দের একটা সুব্যববস্থা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী হবে, তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সম্মনের সঙ্গে মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না’। (ইব্রাহিম ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল।শেখ মুজিবের এই বক্তব্যই হয়তো যুদ্ধ শিশুদেরকে দত্তকের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে তখন বাংলাদেশি কোন শিশুকে ভিন দেশে দত্তক দেওয়ার বিধান ছিল না, যদিও বাংলাদেশি পিতামাতা দত্তক সন্তান নিতে পারতেন অবশেষে এর জন্য আইন তৈরী করতে হয়েছিল।

যে যুদ্ধ শিশুদেরকে আমরা আমাদের সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিতাড়িত করেছিলাম দেশ থেকে তারা কিন্তু বাংলাদেশেরই সন্তান। শুধু সন্তানই নয়, এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশও তারা। চোখ বন্ধ করে যতই আমরা তা অস্বীকার করি না কেন, বিবেক নামক কোন কিছুর যদি সামান্যতম অস্তিত্ব আমাদের থেকে থাকে, তবে সেখানে ঠিকই কিছুটা হলে রক্তক্ষরণ হওয়ার কথা। যদি কোনদিন ওই সমস্ত যুদ্ধ শিশুরা করুণ গলায় জিজ্ঞেস করে, বলো, কি আমাদের অন্যায় ছিল, যার জন্য তোমরা আমাদেরকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছো জন্ম মুহুর্তেই। বঞ্চিত করেছো আমাদেরকে মাতৃস্নেহ থেকে সারা জীবনের জন্য। এমনকি অপরিসীম ঘৃণায় দেশ থেকেও বিতাড়িত করেছো চিরতরে। আমরা কিছু বোঝার আগেই। আর সে কারণে আজ আমাদের কোন শিকড় নেই। নেই কোন মমতা মাখানো হাত দুঃসময়ে বুকে টেনে নেয়ার জন্য। নেই কোন জন্মভূমি যাকে আমরা ভালবাসতে পারি প্রাণ ভরে। আমাদের জীবনকে এরকম দুঃসহ, ছন্নছাড়া আর লণ্ডভণ্ড করে দেবার অধিকার তোমাদেরকে কে দিয়েছিল? আমাদের জন্মগত অধিকারকে কেন তোমরা কেড়ে নিয়েছিলে নিষ্ঠুরভাবে?

এর কি কোন জবাব আছে আমাদের কাছে?

জানি কোন জবাব নেই আমাদের। যে অন্যায় এবং অবিচার আমরা করেছি সাইত্রিশ বছর আগে তার প্রায়শ্চিত্ত এবং পাপমোচনের সময় এসে গেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এখন উচিত তার তাড়িয়ে দেওয়া, হারিয়ে যাওয়া হতভাগ্য যুদ্ধ শিশুদের কাছে নতজানু হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। পূর্ণ মর্যাদায় তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা। গভীর ভালবাসা দিয়ে বলা, তোমরা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই আপনজন। এই দেশ তোমাদেরই দেশ। কারো চেয়ে এক বিন্দু কম অধিকার নয় তোমাদের এই মাটিতে।

আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের জন্য, গণহত্যা চালানোর জন্য আমরা পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা দাবী করি। আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেইসব বীরাঙ্গনা এবং তাদের সদ্যজাত সন্তানদের উপর যে চরম অবিচার করেছি, যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়েছি কখনো? চাইনি। চাইনি বলেই যে চাওয়া যাবে না এমন কোন কথা নেই। এখন সময় এসেছে সেই সব বীর নারীদের এবং তাদের প্রসূত যুদ্ধ শিশুদের কাছে জাতিগত ভাবেই আমাদের করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

বীরাঙ্গনা ২য় পর্ব

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ