“বিহারীরা আমার বোন আমেনাকে ড্রামের পেছন থেকে বের করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।আমার বোন চিৎকার করে বাঁধা দেবার চেষ্টা করে,পরে তাঁর দেহটি হঠাৎ নিথর হয়ে যায়। সেই নিথর দেহের উপর পালাক্রমে চলে ধর্ষণ। ধর্ষণ শেষ হলে নিথর দেহটিতে তিনটি গুলি করে”

... বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান মোমেনা বেগম। প্রায় ২ ঘন্টা পর স্বাভাবিক হলে তিনি আরও জানান-

“লাশগুলো মিলিটারি ও বিহারীরা টেনে গাড়িতে করে কালাপানি বধ্যভূমির দিকে যায়।আমি পালিয়ে গাবতলীতে আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। প্রায় ২ মাস প লুকিয়ে পরিবারের লাশের সন্ধানে “কালাপানি বধ্যভূমিতে” যাই। গিয়ে দেখি যেন একটা মৃত্যুপুরী। অসংখ্য মানুষের ছড়ানো ছিটানো লাশ আর লাশ। কিছু কিছু লাশ মাটিচাপা দেয়া। কারো হাত,পা,চুল বের হয়ে আছে...”

লিখছিলাম মিরপুরের “কালাপানি বধ্যভূমি”র কথা।ভাগ্যক্রমে বেশ করেকবার মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে গিয়ে ঘুরে আসবার সুযোগ হয়েছিলো। বইপত্রর ঘেটে জেনেছিলাম মিরপুর বাঙলা কলেজ আর শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমির কথা। জল্লাদখানা থেকে শুরু করে শিয়ালবাড়ি- প্রতিটা বধ্যভূমিতে ঘটে যাওয়া নৃশংশতা আর লুকিয়ে থাকা হাহাকারের ঘটনা যখনই জেনেছি শিউড়ে উঠেতে, আঁতকে উঠেছে, যন্ত্রণায়, কষ্টে, আক্ষেপে মুখ লুকিয়েছি।

মিরাজ মিজু’র “মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি”  বইটি পড়বো পড়বো করেও পড়ছিলাম না। ভয় পাচ্ছিলাম। অজানা আশংকায় বার বার থেমে যাচ্ছিলাম। স্বজাতির পঁচা লাশ, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ আর বিধ্বস্ত করোটির নির্মম ইতিহাস জানতে যে বড্ড অনীহা হয়। এরপরেও জানি, না জানলে কি করে হবে! এতো আমাদেরই রক্তাক্ত জন্মের ইতিহাস!

মিরপুরেরই আরেকটি বধ্যভূমির নাম হল “রাইনখোলা বধ্যভূমি”। রাইনখোলা বধ্যভূমি খুব কাছ থেকে দেখেছেন ফকির শফিরউদ্দিন। তিনি জানান-

“মরা মানুষের দুর্গন্ধে চারিদিকের বাতাস ভারী হয়েছিল। একটা দো’তলা স্যুয়ারেজ রিজার্ভার দেখতে পাই।পুরো স্যুয়ারেজ রিজার্ভারটিই ছিল মানুষের লাশে ভরা। আমরা সেখানে গিয়ে মাটি সরাতেই বেরিয়ে আসে মানুষের গলিত শরীর-পঁচা দুর্গন্ধ...”

উল্লেখ্য স্যুয়ারেজ রিজার্ভারটির ব্যস ছিল ৫০ ফুট ও গভীরতা ছিল ২৫ ফুট। এখান থেকেই আনুমানিক ৪০০/৫০০ মানুষের মাথার খুলি এবং অস্থিবশেষ উদ্ধার করা হয়। বেশিরভাগ অস্থি’ই ৬ ইঞ্চির বেশি ছিল না। তাই ধারণা করা হয় ধারালো অস্ত্র হয়ে টুকরো করে মানুষগুলোকে মেরে রিজার্ভারে ফেলে দেয়া হয়েছিলো।

টেক বলতে কিছুই নেই। কেবল কালের সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছে খানিকটা উঁচু জায়গা। এবার লিখবো মিরপুরের-ই “শিরনিটেক বধ্যভূমি”র কথা। মূলত দিয়াবাড়ি,কাউয়িন্দা,বাঘসাত্রা ও চান্দারটেকের বাসিন্দাদের হত্যা করা হয়েছিলো এখানে। এই শিরনিটেকের পাশেই অয়ে গিয়েছে তুরাগ নদী। হত্যার পরে লাশগুলো এই নদীতেই ফেলা হতো। কাউয়িন্দার কাইয়ুম খান বলছিলেন তাঁর কিছু অভিজ্ঞতার কথা-

“একাত্তরে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম।শিরনিটক থেকে মিরপুর ব্রীজ পর্যন্ত প্রচুর লাশ ভাসতে দেখি। শিরনিটেকে প্রচুর মানুষ হত্যা করা হয়।পুরো শিরনিটেক জুড়েই ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষত বিক্ষত লাশ। দিনের বেলায় কুকুর আর রাতের বেলায় শেয়াল খুবলে খেত শহিদের লাশ। একটা ঘটনা এখনো মনে পরে,একটি লাশ দেখে মনে হল মানুষটি বেঁচে আছে। তাঁর পরনের লুঙ্গি খুলে গিয়েছিলো।খোলা চোখে যেন তাকিয়ে ছিল সাহায্যের জন্য।হাত পেছনে বাঁধা। হাটুগেড়ে বসার ভঙ্গিতে ছিল। পায়ুপথ দিয়ে মল বের হয়ে এসেছিল। সামনে গিয়ে দেখি তাঁকে নাভির একটু উপর থেকে দু’ভাগ করে হত্যা করা হয়েছে”

......আহারে!

হয়তো রিভিউটা আরো বড় পরিসরে লেখা যেতে পারতো, সাথে বাকি বধ্যভূমির ঘটনাগুলোও টুকে দেয়া যেতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আর পারছি না। যন্ত্রণাটা যেন শরীরের শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে...

 

বইটির পিডিএফ লিংকঃ http://www.liberationwarbangladesh.org/2015/07/blog-post_23.html

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ