পর্বতকন্যের ইতিকথা

প্রদীপ চক্রবর্তী ৩১ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ০৫:৫৩:৪৯অপরাহ্ন উপন্যাস ১১ মন্তব্য

#পর্ব_১১

দুপুর প্রায় ঠিক ১২:৪৫ পার্বতীর বিয়ের সম্মোধন নিয়ে এসেছে পাত্রপক্ষ কলকাতা থেকে বলরাম দাদার বাড়িতে। ছেলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সে বিলেতে চাকরী করে। তখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার সাথে বেকারত্বের অভিশাপে জড়িত।
যাই হোক পার্বতীকে দেখে পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়েছে।
পাত্রপক্ষ পার্বতীর বাবা-মা কে পাত্র দেখার জন্য আহ্বান করেছেন। এবং যাবার বেলা পাত্রের বাবা পাত্রের একখানা ছবি দিয়ে গেলেন।
পার্বতী মুখ কালো করে পাশের কামরায় বসে আছে। আর একটু পর পর আবির পাশে গিয়ে পার্বতীকে বলছে আহ্ কি মজা কি মজা পার্বতী দিদির বিয়ে হবে।
তখন পার্বতী ধমক দিয়ে আবির কে বলছে এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে যা।
অন্যদিক মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে পাড়ায় চড়ক ও গাজন উৎসবের সমারোহ চলছে। বাড়ি বাড়ি সবাই গিয়ে পিঠেপুলি খাচ্ছে।
সকলেই আনন্দে ভরপুর হলে পার্বতীর মনে অশান্তির এক বীজ বপন করে দিলো এই বিবাহের বার্তা।
যদিও এখনো কন্যাপক্ষ পাত্রকে দেখে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয় নি। তবুও পার্বতীর কপালে বইছে বেশ চিন্তার ভাঁজ।
আজকাল অধিকাংশ মেয়েরা স্বয়ংবরা। কিন্তু পার্বতী তার পিতামাতার উপর নির্ভরশীল। বিবাহের জন্য পিতামাতা যে ছেলে ঠিক করে দিবেন পার্বতী তাকে বিবাহ করিবে। কিন্তু পার্বতীর এই বিবাহের পীড়িতে বসতে চায় না। অপ্রত্যাশিত নীরবতা মনে ধারণ করে বেশ কদিন কেটে গেলো পার্বতীর।
পার্বতীকে বলরাম দাদার বাড়িতে নিয়ে আসার মূল কারণ হচ্ছে ভালো পাত্র দেখে তার বিবাহকার্য সম্পাদন করা।
দুর্ভাগ্য আমার, দেশে থাকতে একটাও বিবাহের আলাপ আসেনা নাই। আমি যে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। তার পাশাপাশি চলছে আমার লেখাপড়া।
এমন বেকারত্ব ছেলের কাছে কোন মেয়ের বাবা ভুলেও তার কন্যাকে আমার কাছে সম্প্রদান করবে না।
যদিও বিবাহ দিয়ে থাকে কন্যা আমাকে তার ঘরজামাই করে নিলে নিতে পারে। পরিণামে আমায় যে শ্বশুর শাশুড়ির গৃহ হইতে ঠেঙা লাঠি লইয়া বৈষ্ণব সাজেসজ্জিত হইয়া বৃন্দাবনে যাইতে হবে। তার কোন সন্দেহ মাত্র নেই। তাই বেকারত্ব দূর না হলে আমার কপালে বিবাহ জুটবে না না।

#পর্ব_১২

বলরাম দাদা দুদিন ধরে খুবি ব্যস্ত। ইংরেজদের দেওয়া খেতাবটা জনগণ এবার পছন্দের সহিত যেকোনো প্রার্থীকে এই রায়বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করতে চায়।
এই পদটা পশ্চিমবঙ্গবাসী ইংরেজদের কাছ থেকে দত্তক হিসেবে এনেছিলো।
রায়বাহাদুর খেতাব পদে ভোটের মাঠে বলরাম দাদার জনপ্রিয়তা বেশ জমজমাট। বলরাম দাদা হুগলির জেলার সাংসদ তাছাড়া সকলের শিরোমণি ও অভিভাবক। পাড়ার অলিগলিতে চলছে ভোটের ক্যাম্পাস।
আজ সন্ধ্যা সাত ঘটিকার সময় বেরিয়ে পড়লাম আমি আর বিনোদ বলরাম দাদার সাথে ভোটের মাঠে।
রাত্রি প্রায় এক ঘটিকায় বাড়িতে ফিরলাম।
পরেরদিন মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে ভোট আরম্ভ হবে। আমি আর বিনোদ মনেমনে ভাবলাম চিন্তার কোন কারণ নেই ভোটের মাঠে এত জনপ্রিয়তা বলরাম দাদার। নিশ্চয় জয়টা হবে বলরাম দাদার। এই বলে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি বিনোদ। যদিও আমাদের রাত্রিবেলা খাবারের আহ্বান করা হয়েছিলো পেট ভরা ছিলো তাই আর খাইনি।
বিবাহের আলাপে পার্বতী রাত্রিবেলা ভাত খায় নি।
এই কথা শুনে আমার একটু বিষণ্ণ লাগলো।
এত রাত্রিবেলা সে একা বসে আছে বারান্দায়। তাকে দেখে মনে হলো চোখে কাজল নেই,ঠুটে লিপিস্টিক নেই, মুখে হাসি নেই। এ যেন এক শুষ্কতা বইছে।
আমি কাছে গিয়ে বললাম পার্বতী এত কি ভাবছ বসে একা একা?
তখন পার্বতী উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলো কিছুনা।
আমি আবারও থাকে বললাম কি হয়েছে?
তখন সে বলে উঠলো এই দেখো পূর্ণিমারাত্রির ষোড়শী যার রূপে ছিলাম আমি অষ্টাদশী। আজ এই বিবাহের আলাপে আমার রূপে বইছে অমানিশার কালোরঙের ছায়া। আমি যে এই বিবাহের পীড়িতে বসতে চাই না দীপ।
আমি আনমনা হয়ে তাকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু ছিলোনা।
এই কথা বলে আমি শুয়ে পড়লাম।
সকাল হয়ে গিয়েছে তাই তাড়াহুড়া করে আমি আর বিনোদ বেরিয়ে পড়লাম বলরাম দাদার সাথে ভোটের মাঠে।
দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে তখন বিকাল চারটা। জয়ের মালাটা যে বলরাম দাদা গলে তা বলরাম দাদার জনপ্রিয়তায় বেশ সাড়া দিয়েছিলো। অবশেষে সকল জল্পনাকল্পনার অবসান শেষ করে বলরাম দাদা বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে রায়বাহাদুর খেতাব পদে ভূষিত হলেন। চলছে আনন্দ আর মিষ্টি খাওয়ার সমারোহ।
বেশ আনন্দের রেশ কাটিয়ে চললাম সবাই বাড়িতে।

#পর্ব_১৩

হঠাৎ করে আবির আমার কাছে এসে বলছে জানো দাদা পার্বতী দিদির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
আজকে দুপুরবেলা রোজ মঙ্গলবার পার্বতীর বাবা-মা পার্বতীকে না জানিয়ে বিবাহের দিনতারিখ ঠিক করে এসেছেন।
এই কথা শুনে পার্বতী কাঁদতে শুরু করলো। এমনকি তার ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া নেই। ঘুম নেই। এ যেন দিনভর কাটাচ্ছে কপালে অজস্র চিন্তার ভাঁজ নিয়ে।
পার্বতীর বয়স উনিশ-কুড়ি। বিবাহের আসনে বসা যদিও তার প্রযোজ্য। কিন্তু কোনমতেই এই বিবাহতে রাজী হচ্ছে না পার্বতী। এমনকি পার্বতী ভয়ে তার বাবা মাকে বলতে পারছেনা সে বিবাহের পীড়িতে বসবে না।
যতদিন যাচ্ছে পার্বতীর বাগদানের সময় তত করে আগাচ্ছে। বিষণ চিন্তায় আছে কি করবে কি না।
হঠাৎ করে একদিন পার্বতী তার বাবাকে বলে দিলো সে এই বিবাহের পীড়িতে বসবে না।
এই কথা শুনিয়া পার্বতীর বাবা পার্বতীকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন তোমার কি লজ্জা হয় না?
ছোটমুখে বড়কথা বলে কেন আমার মুখে চুনকালি মাখতে চাও। পার্বতীর তার মায়ের মুখে চাহিয়া রইলো,কিন্তু কথা কহিল না।
পার্বতী যদি স্বয়ংবরা হইত তাহলে নিজেই পাত্র পছন্দ  করিয়া বিবাহ করিত। পার্বতী স্বয়ংবরা নয় তাই সে তার পিতামাতার পছন্দের পাত্রকে বিবাহ করিতে চায়।
কিন্তু পার্বতী এই পাত্রের সহিত বিবাহের পীড়িতে বসতে নারাজ!
পাশের বাড়ির অনেক মহিলা এসে পার্বতীকে বলছে এমন পাত্র হাতছাড়া করো না গো। পাত্র বিলেতে চাকরী করে। জমিদার  পরিবারের ছেলে। অনেক জায়গা- সম্পত্তি রয়েছে। এসবের প্রতি পার্বতীর যে কোন ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নেই।
পার্বতীর মা কিছুক্ষণ পর এসে অশ্রুরুদ্ধ স্বরে বলছেন মা এই বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। ছেলে দেখতে খুবি ভালো। পার্বতী প্রায় নির্বাক।

#পর্ব_১৪

একদিকে এমনিতে আমি বেকারত্বের অভিশাপে জড়িত। হঠাৎ করে দিনবর বলরাম দাদার বাড়িতে ঘটকের উৎপাতের জ্বালা। আমি যে বেকারত্বের অভিশাপে জড়িত তা জেনেশুনে কন্যার পরিবার ও ঘটক কেন আমাকে বিবাহের পীড়িতে বসার আহ্বান করছে। আমি যে বিবাহের পীড়িতে বসতে চাই না। এমনকি আমার পিতামাতার অনুমতি নেই যে আমি বিবাহের পীড়িতে বসি।
আজকাল অধিকাংশ মেয়েরা স্বয়ংবরা।
কিন্তুু যে পরিবার হইতে আমাকে বিবাহ করার আহ্বান করা হচ্ছে সেই পরিবারের মেয়ে যার সাথে আমার বিবাহের পীড়িতে বসার আহ্বান করা হচ্ছে সে পার্বতীর ন্যায় স্বয়ংবরা নয়। সে তার পিতামাতার উপর নির্ভরশীল। পিতামাতা যে বর সম্মোধন করে দিবেন সেই বর হবে তার জীবনসঙ্গী। বর্তমান সময়ে মেয়েটির এমন সদাচারীভাব দেখে সত্যিই আমি গর্বিত।
কেননা বর্তমান সময়ে এমন মেয়ে পাওয়া খুবি কঠিন বটে। আমি যে একজন বেকারত্বের অভিশাপে জড়িত তাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিবাহের পীড়িতে বসব না।
মেয়ের বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে আমাকে কর্মদক্ষ করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা দিয়ে আমার বেকারত্ব দূর করবে। এমন স্বর্ণময়ী থালা পেয়েও এই মেয়ের বাবা মায়ের এমন সিদ্ধান্ত নিজেই উপড়ে দিলাম। আর বিনোদ এসব কথাশুনে আমায় বলে উঠছে দাদা এমন করে না করো না রাজী হয়ে যাও।
আমিও বিনোদের এসব কথা উপড়ে দিলাম।
যাই হোক ভাগ্যদেবতা প্রজাপতির চিহ্নচাপ পড়েনি আমার ললাটে তাই বেঁচে গেলাম।
বলরাম দাদা মেয়ের বাবা-মাকে বলে দিলেন যে আমি বিবাহের পীড়িতে বসব না। এই কথাশুনে কন্যার বাবা মা চলে গেলেন।
এইদিকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। তার সাথে বইছে আদ্রতার ধমকা হাওয়া। পার্বতী রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে একা বসে আছে। কপালে রাজটীকা,রক্তনেত্রে বহমান অশ্রুজল এ নিয়ে কাটাচ্ছে পার্বতী। এসব দেখি প্রায় সমব্যথিত আমি।
পার্বতী এতদিন হাসি খুশিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। আজ তার কপালে চিন্তা নিয়ে দিনরাত কাটাতে হচ্ছে বিবাহের দিন ঠিক হওয়াতে।

#পর্ব_১৫

এদিকে আমি রাত্রিবেলা একা একা বসে মনের অজান্তে চিঠি লিখছি। এই চিঠি কাকে প্রেরণ করব এমন কাউকে এখনো নির্ধারণ করিনি।
মাঝেমধ্যে শীতের হিমেল ধমকা হাওয়াতে আমার চিঠি উড়িয়ে যেতো। ছোটবেলা থেকে আমার লেখালেখি বেশ ভালো লাগতো। তাই লেখা ছাড়া আমার হাতে অন্যকোন অস্ত্র নেই। পার্বতীর বাগদানের দিনতারিখ প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। পাত্রপক্ষের যদিও কোন যৌতুক নেই। তারপরও পার্বতীর বাবা মা পার্বতীর জন্য পাঁচপদে বস্ত্রালংকার দিয়ে সাঁজিয়ে দিবেন। এই কথা পাত্রপক্ষের নিকট বলেছেন। তাই স্বর্ণের সকল হিসাব নিকাশ সেকরার কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছেন।
তাছাড়া বরযাত্রীসহ প্রায় সাতশত মানুষের খাবারের আয়োজনের ব্যবস্থা করার বন্দোবস্ত করেছেন পার্বতীর বাবা। পার্বতীর বিয়ে বলরাম দাদার বাড়িতে হবে।
যদিও এখনো বাগদানের নেমন্তন্ন হয় নি। পার্বতী যে এই বিবাহের পীড়িতে বসতে চায় না। কিন্তু পার্বতীর বাবা পার্বতীর সকল কথা অগ্রাহ্য করে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করতে শুরু করলেন।
করিডোরের কাঁচের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পার্বতী।
তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। রাত্রি তখন প্রায় তিনটে দুজনের মধ্যে কোন ককথোপকথন নেই।
গভীর রাত্রিবেলা অকাল শ্রাবনের সাথে পাল্লা দিচ্ছে পার্বতীর চোখের নোনাজল। চোখেরজল দেখে আমিও আবেগ আপ্লুত। পার্বতী কে আমি বললাম বিয়েতে রাজি হয়ে যাও ছেলে বিলেতে চাকরি করে। পার্বতী আমার এই কথা শুনে অশ্রুজলে রাগান্বিত হয়ে বলছে আমি বিয়ে করব না না। এই কথা বলে চলে গিয়েছে।
পাশের কামরায় একরাশ শূন্যতায় নিয়ে স্তব্ধ হয়ে কাঁদছে পার্বতী।
.
ক্রমশ

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ