পর্দার আড়ালে থাকে যে জীবন

রিমি রুম্মান ১১ নভেম্বর ২০১৯, সোমবার, ০২:২২:৪৪পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ১৫ মন্তব্য
বছর কয়েক আগে লিখেছিলাম পরিচিত এক ছেলের বিষয়ে। ছেলেটি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ২০০৪ সালের এপ্রিলের কোনো এক সকালে আমেরিকার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিল৷ দালালের মাধ্যমে প্রথমে ভারত, কিউবা হয়ে গুয়েতেমালা। তারপর কনটেইনারে নিকারাগুয়া গিয়ে কয়েক মাস অবস্থান করেন। সেখানে কোনোমতে চাকরি করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। শেষে অনেকের সঙ্গে তিনিও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মেক্সিকো এসে পৌঁছান। একসময় হারিয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অতঃপর একে-ওকে জিজ্ঞেস করে করে গহিন বন-জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে বুনো কাঁটা, সাপ, ক্ষুধা, তৃষ্ণার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে এসে পৌঁছান। তাঁর ভাষায়, সেসব গাছ-গাছালিঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন গহিন জঙ্গলে কখনো কোনো মানুষ হেঁটেছে বলে মনে হয়নি৷ কেননা, সেখানে কোনো মনুষ্য পদচিহ্ন দেখেননি তিনি। সীমান্তে এসে একদল মানুষ আর দালালের সন্ধান পান। তাঁরা রাতের আঁধারে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমেরিকার সীমানায় ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় থাকেন। তিন রাত দলটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। ফেরেননি শুধু ছেলেটি। অসীম মনোবলের কারণে তিনি চতুর্থ দিন সকালে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বপ্নের দেশের সীমানায় টুপ করে ঢুকে পড়েন। তখন ২০০৬ সাল।
জনমানবশূন্য দীর্ঘ পথ হেঁটে, পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে এক স্থানে ওপর দিয়ে ঝুলে থাকা ইলেকট্রিক তার দেখতে পান। যা থেকে তিনি অনুমান করেন, ধারেকাছে কোন মনুষ্য বসতি থাকতে পারে। সন্ধানী চোখ পাহাড়ের ওপর থেকে দূরে একটি ফার্ম দেখতে পায়। ফার্মটি দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যেতে পারে সেই আশঙ্কা থেকে রাস্তা ধরে হেঁটে না গিয়ে আড়াআড়ি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় ওঠানামা করে করে ফার্মের সামনে এসে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর তিনি শরীরের শেষ শক্তিটুকু হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওখানকার লোকেরা অপরিচিত মানুষের আগমন পুলিশে জানিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন বন্দিশালার বিছানায়। সেটা ছিল অ্যারিজোনা ডিটেনশন সেন্টার। সেই থেকে তিন মাস সেখানেই তাঁর অবস্থান। পরের সপ্তাহে নাম-পরিচয় পাসপোর্টহীন তাঁকে আদালতের শুনানি শেষে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা।
ভাগ্যক্রমে সেই শেষ সময়ে তাঁর পরিবার আমাদের ফোন নম্বর পায় এবং বাংলাদেশ থেকে ফোন করে সহযোগিতা চায়। তাঁর বাড়ি ছিল আমার স্বামীর এলাকার। বরাবরই ক্লাসে প্রথম হওয়ার সুবাদে তাঁকে চিনতে অসুবিধা হয়নি আমার স্বামীর। হাতে সময় কম। তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে অবস্থানকারী কোনো আমেরিকান নাগরিক যদি তাঁর দায়িত্ব নেন, তাহলে তিনি জামিন পাবেন নির্দিষ্ট অঙ্কের বন্ডের বিনিময়ে। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ইমিগ্রেশন জাজ বরাবর একটি চিঠি লিখে সেই সঙ্গে আমাদের সিটিজেনশিপের কপি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, জব লেটারসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফ্যাক্স করে পাঠানো হয় ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নির কাছে। ম্যানহাটনের ফেডারেল প্লাজায় গিয়ে বন্ডের টাকা জমা দেওয়া হয়। সুখের বিষয় হলো, আমাদের সেই নাওয়া-খাওয়াহীন-ঘুমহীন পরিশ্রম বৃথা যায়নি। ২০০৬ সালে বসন্তের এক সকালে তাঁর জামিন হয়। এর পরের কাহিনি রূপকথার গল্পের মতো। আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সবকিছু সুন্দরভাবে মোকাবিলা করেই এ দেশে থাকার বৈধতা পান তিনি। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কনকনে শীতের ঝকঝকে একটি দিনে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে অনেক বছর পর আমেরিকার মাটিতেই মিলিত হয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়া সেই মানুষটি। বরাবরই ক্লাসে প্রথম হলেও জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে থাকা মানুষটি জীবনের কাছে হেরে যেতে যেতে অবশেষে জয়ী হয়ে শেষ হাসিটি হেসেছেন। গত সপ্তাহের সাপ্তাহিক বাঙালী পত্রিকার হেডলাইন দেখে সেই ছেলেটির ভয়াবহ জীবন যুদ্ধের কথা মনে পড়ে গেল। তার মুখে যে গল্প শুনে আমি ভয়ঙ্করভাবে আঁতকে উঠেছিলাম। ‘ জনপ্রতি ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে ১২ দেশ ঘুরে মেক্সিকোর বন্দিশিবিরে বাংলাদেশিরা’, খবরটি আমার ভেতরে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়েও কী স্বপ্নের মূল্য বেশি ?
ভাগ্যান্বেষণে নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দেশ ছেড়ে বিদেশে আসেন, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অসীম মনোবলে ঘুরে দাঁড়ান। অতপর শেষ বয়সে আবারও দেশে ফিরে যাবার জন্যে ব্যকুল হয়ে উঠেন। তারুণ্যের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, তা দিয়ে দেশেই বাড়ি, ঘর, জায়গা, সম্পত্তি গড়ে তোলেন। কেন ? শেষ বয়সে শেকড়েই ফিরে যাবো, গ্রামের বাড়িই হবে আমার শেষ আশ্রয়, শেষ ঠিকানা, এমনটি ভাবেন অধিকাংশ প্রবাসী। যে গ্রামের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠা, সে গ্রামের আলো- বাতাসেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মাঝেও যেন সুখ। কিন্তু মাতৃভূমিতে তিলতিল করে কষ্টার্জিত সম্পদ গড়ে তোলার পর তা রক্ষা করা এবং ভোগ করার ভাগ্য ক’জনার হয়ে থাকে ? আদতে এই সম্পত্তিই এক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। তা রক্ষার জন্যে দেশে থাকা আত্মীয়দের দায়িত্ব দেয়া হলেও একসময় রক্ষকই ভক্ষক হয়ে উঠে। এইতো গত ১৬ই অক্টোবরের ঘটনা, মোহাম্মদ গোফরান নামের ৭২ বছর বয়সী এক প্রবাসি দেশে গিয়ে খুন হন। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের ফুলটন নিবাসী প্রবীণ এই প্রবাসী চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় যাবৎ প্রবাসে বসবাস করছিলেন। সম্প্রতি দেশে গেলে চাটখিলের সনোখালি গ্রামে নিজ বাড়ির ছাদে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধে স্বজনদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন তিনি। দেশ ছেড়ে অন্য ভূখণ্ডে আসা মানুষগুলো জীবকার তাগিদে দেশ ছাড়েন যদিও, কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে দেশে। আর তাই শেকড়ে ফিরবার সুপ্ত আশা আর স্বপ্ন বয়ে বেড়ান বুকের গহীনে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। কেউ কেউ ফিরে যান। কেউ ফিরেন না কখনোই। আবার কেউ ফিরে গেলেও কিছুই থাকে না আর আগের মত। না স্বজন, না প্রিয়জন, না বন্ধুবান্ধব। কেউ না। কেউ বা মোহাম্মদ গোফরানদের মত বলি হন নিজ মানুষেরই হাতে। সেইসব স্বজনদের কেউ জানেন না পর্দার আড়ালে প্রবাসীদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি কিংবা দীর্ঘশ্বাসমাখা জীবন সংগ্রামের কথা।
রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ