পদ্মার যত স্মৃতি কথা

হালিমা আক্তার ২৫ জুন ২০২২, শনিবার, ০১:০৭:১৮পূর্বাহ্ন বিবিধ ১২ মন্তব্য

পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা।

পদ্মার বুকে আগামীকাল পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘটবে।

এপার-ওপারের মাঝে হবে মিলবন্ধন। পদ্মা নিয়ে কত স্মৃতি ঘিরে আছে। অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম কিছু কিছু টুকরো স্মৃতি শব্দের মালা গেঁথে জুড়ে দেয়ার।

দক্ষিণবঙ্গে বাড়ি। লঞ্চ ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না। এই লঞ্চ যাত্রা আনন্দময় ছিল, তেমনি মাঝে মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো।

সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠতে হতো। সকাল সাতটায় লঞ্চ ছাড়লে। গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় সাত ঘন্টা লাগতো। লঞ্চে যাওয়ার সময় ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর দৃশ্য দেখতে খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে পালতোলা নৌকা। যা এখন আর দেখা যায় না। পালতোলা নৌকার গুণ টেনে নিয়ে যেত। এ দৃশ্য গুলো খুব মিস করি। নদীর ঘাটে মেয়েরা আসতো কাজ করতো। কাজ শেষ করে তারা কলসিতে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতো। কখনো কখনো কল্পনার সাগরে ভেসে আমিও চলে যেতাম সেই নদীর ঘাটে। এখন আর গ্রামের মেয়েরা জল ভরতে নদীর ঘাটে আসে না। সময়ের সাথে অনেক কিছুর বদল হয়েছে।

লঞ্চ যাত্রায় যেমন আনন্দের ছিল, তেমনি বিড়ম্বনা ও কম ছিলনা। শীত মৌসুমে পানি কম থাকায় মাঝে মাঝে চরে লঞ্চ আটকে যেত। তখন জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।

লঞ্চের নারকেলের সাথে চিড়া ভাজা খুব পছন্দের ছিল। দিঘলী বা কাঠপট্টি থেকে নিয়ে উঠতো। একবার মাঝিকান্দি থেকে মাওয়া ফেরার পথে চিড়া ভাজা দেখে কিনে নিলাম। কিন্তু সেই স্বাদ পেলাম না।

বর্ষা মৌসুমে পদ্মা পাড়ি দেয়া ছিল ভয়ঙ্কর ব্যাপার। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এপার ওপার কিছুই দেখা যেত না। পদ্মা পার হওয়ার সময় আল্লাহর নাম নিতো। একবার মহিলা কেবিনে একজন মহিলা উঠলেন। যিনি হয়তো কখনো লঞ্চে উঠেনি। তারপর বর্ষাকাল। সম্ভবত শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন। প্রচন্ড ভয় পেয়ে সারা পথ কান্না করেছিলেন। বর্ষার সময় পদ্মার ঢেউ যেন এক অভিনব এডভ্যাঞ্চার সৃষ্টি করে।

আনন্দে বেদনা নিয়ে পদ্মার স্মৃতিগুলো ভেসে চলে। ২০০০ সালে, ঈদের রাতে দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চে আমার ছোট মামা ছিলেন। রাতের লঞ্চে যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চিৎকার আহাজারিতে মামার ঘুম ভেঙে গেলে, দেখেন কেবিনে পানি ঢুকে গেছে। কেবিন থেকে বের হয়ে কোন রকমে মামা প্রাণে বাঁচেন। এরপর প্রায় ছয় মাস মামা ট্রমায় ছিলেন।

এভাবে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জীবন হাতে নিয়ে পদ্মা মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে প্রিয়জনের কাছে যাওয়া আসা করে।

একসময় সদরঘাট থেকে লঞ্চ যাত্রা করতাম। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মাওয়া হয়ে যাত্রা শুরু হয়। তাতে কি। পদ্মা তো পাড়ি দিতেই হয়। একবার মাওয়া থেকে মাঝি কান্দি যাওয়ার সময় ঘাটে ভেরার আগে, প্রচন্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় লঞ্চ কাত হয়ে যায়। নীচ তলায় পানি ঢুকে যায়। চারদিকে কান্নার আওয়াজ। সে যাত্রায় আল্লাহ সকলকে রক্ষা করেন।

এমনি কতো স্মৃতি রয়ে গেছে পদ্মার বুকে।

ফেরিঘাটে বিরম্বনা তো আছে। ভোর রাতে খবর পেলাম দাদি আর নেই। যে যার মত রওনা দিল। ফেরিঘাটে পৌঁছে দেখা গেল বিশাল লাইন। অনেক দেরি হয়ে যাবে। অগত্যা গাড়ি এ পাড়ে রেখে, স্পিডবোটে নদী পার হলাম। ঝড় বৃষ্টির সময় অনেক ক্ষেত্রে নদী পারাপার বন্ধ থাকে। প্রয়োজন হলেও যাতায়াত করা যায় না। আমার পরিচিত এক কলিগ বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ও বাড়ি যেতে পারেনি। মাওয়া ঘাট থেকে ফেরত এসেছে। এরকম কত যন্ত্রনা বিষাদের স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছে পদ্মার ওপারের মানুষগুলো।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এর ফলে এ সবকিছুর অবসান হতে চলেছে। যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। পদ্মা সেতু এক ভালবাসার নাম। সে ভালবাসার আবেগে যা মনে আসলো তাই লিখে নিলাম।

ছবি সংগ্রহ-নেট থেকে।

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ