জীবন চিতা (১ক)

আবু জাকারিয়া ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, মঙ্গলবার, ০৬:৩০:০৮পূর্বাহ্ন সাহিত্য ১১ মন্তব্য

(১ক)
চার দিনের মাথায় দুপুরের পর শহর থেকে বাড়ি ফিরে এলো মুহাম্মদ। ইদানীং কাজ যে খুব বেশি পাওয়া যায়, তা নয়। তবে শহরে থাকলে কাজ পাওয়া যাবেই, কম অথবা বেশি। হলুদ রংয়ের ব্যাগটা ঘরের এক কোনায় রেখে দিল মোহাম্মদ। ব্যাগ ভর্তি মোটা চাল, আসার সময় শহর থেকে কিনে এনেছে। স্ত্রী জামিলা বলল, দেখতো পেঁপেঁ গাছটার কি অবস্থা হয়েছে?
মোহাম্মদ পেপে গাছটার দিকে তাকাল একনজর। চারদিন আগেও যে গাছটি ভাল ছিল তা এখন পুরোটাই মরে পচে গেছে। পেপেগুলো গাছের তলায় পডে আছে। ফুলো ফুলো পঁচা পেপেগুলো কোন পশুপাখিতেও খায়না।
মুহম্মদ জামিলার দিকে তাকিয় বলল, আমিতো ওদের বলে দিয়েছি, খুব তারাতারিই বাড়িটা ছেড়ে দেব।
-কি বলেছে ওরা?
-কিছুই বলেনি, শুধু শুনেছে।
-মনে হয় তোমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা ওদের।
-হবে হয়ত।
জামিলা ঘর থেকে লুঙী আর জামা এনে মুহাম্মদের হাতে দিয়ে বলল, যাও পুকুর থেকে গোসল করে আসো। জামাকাপড়ে অনেক ময়লা জমে গেছে। খুলে রেখে যাও, আমি ধুয়ে নেব।
মুহাম্মদ তার গায়ের জামাকাপড়গুলো খুলে জামিলার কাছে দিল। জামাকাপড়ে লেগে থাকা ময়লা চারদিনের কাজের স্মৃতি চিহ্ন। অনেক ধুলাবালি আর রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। ফলে জামাকাপড়ে দ্রুত ময়লা জমে যায়। কিন্তু কাজ শেষে ময়লা জামাকাপড় ধোয়ার সময় থাকেনা মুহাম্মদের। তাই বাড়ি আসার পর স্ত্রী জামিলাই ধুয়ে দেয় সব ময়লা জামাকাপড়গুলো।

মুহাম্মদ পুকুর থেকে গোছল করে ঘরে আসল। একটুও দেরি হলনা। অন্য সময় অর্থাৎ যখন বাড়ি থাকে, শহরে কাজে যায়না, তখন মুহাম্মদের অনেক সময় লেগে যায় গোসল করতে। আসলে, মুহাম্মদ যে শহরে কাজ করতে যায়, তা গ্রাম থেকে অনেক দুরে, আসা যাওয়া করতে অনেক সময় লেগে যায়। ফলে মুহাম্মদের শরীর অনেক ক্লান্ত থাকে, তাই দির্ঘ সময় নিয়ে গোসল করেনা সেদিন।
জামিলা একটা টিনের থালায় করে ভাত ও একবাটি পেপের তরকারি এনে মুহাম্মদকে খেতে দিল। ভাতগুলো ভালই আছে, কিন্তু পেপের তরকারী দেখে বোঝা যায় তরকারীটা গতকাল রাতের রান্না করা তরকারি, বাশি হয়ে গেছে।

মুহম্মদ জামিলার দিকে তাকিয়ে বলল, এই পেপের তরকারি কোথায় পেলে?
-ভয় নেই, আমাদের গাছের পেপে না, তুমি খেতে পার।
-তাহলে কই পেয়েছ?
-সানি কালকে কিনে এনেছিল।
-ও তাই বল। আমিতো ভয় পেয়েগিয়েছিলাম। মুহাম্মদ যেন কিছুটা স্বস্থি পেল। বলল, সানি মাদ্রাসায় যায় ঠিক মত?
-মাঝে একদিন কামাই দিয়েছিল।
-কেন?
-জর ছিল।
মুহাম্মদের ছোট ছেলে মনি মা জামিলার পাশে বসে বাবার খাবার খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। চুপ করে বসে আছে ও। চেহারায় একরাশ কাল মেঘের প্রতিফলন, শুধু বৃষ্টিই হচ্ছেনা।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, কেদেছিল নাকি?
-সকাল থেকেই কাদছিল।
-কেন?
-কলা খেতে চেয়েছিল।
-দাওনি?
-কিভাবে দেব, ফুলো কলা, কেটে রাখলে পচেযাবেনা?
ভাত খাওয়া শেষ হলে মুহম্মদ চালের ব্যাগ থেকে একটি পাউরুটি বের করে মনির হাতে দিল, আরেকটা রেখেদিল বড় ছেলে সানির জন্য, মাদ্রাসা ছুটি হলে এসে খাবে।

জামিলা বলল, এই কয়দিন রাতে প্রচুর ঝামেলা করেছে ওরা।
-কি করেছে?
-আর বলোনা, রাত হলেই ঘরের চালে ইট ছুড়ে মারবে, ভয়ে ঘুমাতেও পারিনি ঠিকমত।
-ওই জব্বার যে কত বড় হারামজাদা, এখন বুঝতে পারছি। কতবার বুঝিয়ে বললাম, তোর বাড়ি আমরা তারাতারি ছেড়ে দেব, অন্তত এ কদিন জালাসনা আমাদের, শুনলোই না।
-তাছাড়া চুলার পাশে আরো চারপাচটা তাবিজ পোতা পেয়েছি।
মুহাম্মদ জামিলাকে শান্তনা দিয়ে বলল, একটু কষ্ট করে থাকো এ কদিন। তারপর একট ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।
মুহাম্মদের বড় ছেলে সানি মাদ্রাসা থেকে বাড়ি আসল। জামিলা বলল, তোর আব্বুর চালের ব্যাগের ভিতর একটা পাউরুটি আছে। আগে পাউরুটি খেয়ে জিরিয়ে নেয়। তারপর ভাত খেতে বস। সানি বারান্দায় বসে বসে পাউরুটি খাচ্ছে। মোহাম্মদ ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করছিল।
জামিলা বলল, এখানে থাকলে আমাদের ছেলেরা একটাও মানুষ হতে পারবে না, জাদুটোনা করে একদম শেষ করে দেবে। ওদেরকেও কিনা বান মেরে বসে, বিশ্বাস নেই হারামিদের। ওদের কলিজায় কোন মায়া দয়া আছে বলে মনে হয় না।
মোহাম্মদ বলল, কটাদিন একটু ধৈর্য ধর, তারপর নিশ্চিত একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

রাত নেমে এসেছে। খুব কালো অন্ধকার রাত। ঘরের চালের উপর বাশ পাতার ঘষায় শন শন শব্দ ভেসে আসছে। মুহাম্মাদ আর জামিলা তাদের ছেলে দুটিকে মাঝখানে রেখে নিজেরা দুই পাশে দুইজন ঘুমালো। ছেলেদুটো ঘুমিয়ে গেছে, তাদের দুজনের ঘুম আসছে না। নানান চিন্তা মাথার ভিতর চলে আসছে।
জামিলা হাত দিয়ে আলতোভাবে নিজের নাক চেপে ধরে বলল, গন্ধটা একদম সইতে পারিনা আমি, বমি চলে আসে।
মুহাম্মাদ বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে উকি মারল। দিঘির ওপারেই জ্বলছে চিতাটা। গাড় অন্ধকারে স্পস্ট চিতার আগুন দেখা যাচ্ছে। দক্ষিনা বাতাশে তারই বিশ্রি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিক।
মুহাম্মদ বলল, আজকেও লাশ পোড়াচ্ছে।
জামিলা মুখে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে বলল, ইদানিং যে কি শুরু হল, প্রচুর মানুষ মরতে শুরু করেছে।
মুহাম্মাদ বলল, কেন, শিগ্র আর কেউ মরেছে নাকি?
জামিলা বলল, পরশুও দুইটা লাশ পুরিয়েছে, গন্ধে বমি করে ফেলেছিলাম।
মুহাম্মাদ আবার বিছানায় এসে শুয়ে পরল। একদম নিসতব্দ পরিবেশ। তবে একটু বাতাশ পেলেই ঘরের চালের উপর শন শন শব্দ তৈরি হয়। কারন ঘরের পাশেই অনেক বড় একটা বাশের ঝার। বাতাশ পেলেই বাশপাতাগুলো আছড়ে পরে ঘরের চালের উপর। ফলে শন শন শব্দ তৈরি হয়। কিছুক্ষন পরে লাশ পোড়ানোর বিশ্রি গন্ধটা বন্ধ হয়ে গেল। এর দুটো কারন হতে পারে। হয় লাশ পোড়ানো শেষ হয়ে গেছে নয় বাতাশের প্রবাহ অন্য দিকে মোর নিয়েছে। মোহাম্মদ অবিজ্ঞতা থেকে মনে মনে অনুমান করল, হয়ত লাশ পোড়ান শেষ হয়ে গেছে। কেননা একটা লাশ পোড়াতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। ভাল কাঠ হলে কাজটা অনেক দ্রুত করা যায়। ভাল কাঠ বলতে যা বুঝায়, শুকনো কোন কাঠ যা খুব তারাতারি জ্বলতে পারে। তবে বেশির ভাগ হিন্দুরা লাশ পোড়ানোর কাজে মিষ্টি আম গাছের কাঠ খুব পছন্দ করে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়না। কারন, মিষ্টি আম গাছের কাঠ সংগ্রহ করতে হলে বাড়ির ভাল আম গাছটি কেটে ফেলতে হবে। অথবা কিনে আনতে হবে। কিন্তু একটা মিষ্টি আম গাছ কেনা সবার পক্ষে সম্ভব হয়না। কারন, অনেক টাকা ব্যায় করতে হবে তাতে যা এই এলাকার গরিব হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব না। পুরো এলাকা ধরেই হিন্দুদের বসবাস, মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু এলাকায় একটা ধনি হিন্দু পরিবার আছে বলে মনে হয়না। তাই এলাকার গরিব হিন্দুরা যেন তেন কাঠ দিয়েই লাশ পোড়ানোর কাজ সেরে ফেলে।

মোহাম্মাদ চেয়ে দেখল, জামিলা এখনও জেগে আছে। ভাবল হারিকেনের আলোর কারনে হয়ত ঘুম আসছেনা তার। হারিকেনটা পিট পিট করে জ্বলছে মুহাম্মদের হাত থেকে কাছেই। মুহাম্মাদ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হারিকেনের পাওয়ার আরো কমিয়ে দিল। হারিকেনের পাওয়ার এত কমে গেছে, দেখলে মনে হয় ঘরের ভীতরে কোন আলোই নেই। শুধু অন্ধকার।
হঠাৎ ঘরের চালের উপর ধপ ধপ করে দুইটা শব্দ আসল। বুঝতে বাকি রইল না হারামজাদারা ঘরের চালের উপর ইট পাথর ছুড়ে মারছে। মোহাম্মদ চেচিয়ে বলল, কে ওখানে, ঘরের চালে ইট মারছে কে? উঠে হারিকেনটার পাওয়ার বাড়ালো মুহাম্মাদ। কিন্তু বাইরে বের হল না। জামিলা পাথরের মত নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, কোন নড়াচড়া করছে না। চোখ দুইটা হারিকেনের আলোয় জ্বল জ্বল করছে। মুহাম্মদ কিছুক্ষন হারিকেনটা কোলের কাছে নিয়ে বসে রইল।
(চলবে....)

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ