বাইসাইকেল

কেসি মিলান ৩ আগস্ট ২০১৬, বুধবার, ০৫:১৬:৪১অপরাহ্ন বিবিধ ৮ মন্তব্য

ক’জন আছে যারা বলবে যে আমি বাইসাইকেল দেখিনি? সারা বিশ্বজুরে দেখা যায় এমনই এক জনপ্রিয় বাহনই হচ্ছে বাইসাইকেল৤ আমার মনে হয় পৃথিবীর কোথাও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না বাইসাইকেলের সাথে যার পরিচয় নেই৤

বাইসাইকেলের তিনটি ভাল দিক আছে৤

১. দামে সস্তা বলে সবাই এমনকি গ্রামের খুব কম উপার্জন করা লোকেরাও কিনতে পারে৤

২.  সময় বাঁচিয়ে কম খরচে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি আয়েশে ও নিরাপদে ভ্রমন করা যায়৤

৩. বাইসাইকেল চালানো একটা ভাল ব্যায়ামও বটে৤ যারা নিয়মিত সাইকেল চালায় তারা সুসাস্থ্যের অধিকারী হয়৤

বাংলাদেশেও বাইসাইকেল আছে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই এখানেও সমান জনপ্রিয়৤

বাংলাদেশে সব বয়সের লোকেরাই সাইকেল চালায় বা চালাতে পারে৤চলাচলের সহজ বাহন বলে আজকাল অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে মধ্য বয়সী অনেক মহিলাদেরও সাইকেল চালাতে দেখা যায়৤

কিন্তু মাত্র ১০/১২ বছর আগেও মেয়েদের সাইকেল চালানো ছিল অনেকটাই অশোভনীয় এবং লজ্জ্বাজনক বিষয়৤ বিশেষকরে গ্রামাঞ্চলে বিষযটি ছিল আরও জটিল৤

ওই সময় রুবিনার বয়স ছিল ১৩ বছর৤ ও গ্রামের মেয়ে৤ ওর বাবা একজন গরীব কৃষক৤

রুবিনা গরীব বাবা-মার ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছিল, গরীবি হালে জীবন যাপনও করত বটে৤ তবে ওর অন্তরে ছিল আকাশের মত উঁচু এবং দিগন্তের মত বিশাল আশা, আকাংখা, স্বপ্ন, সাধ৤

গ্রামটি অতি মাত্রায় গ্রাম্য হলেও ভাগ্যক্রমে সেখানে একটি প্রাইমারী স্কুল ও একটি হাইস্কুল ছিল৤আর রুবিনা এই উভয় বিদ্যাপিঠেই ভাল ছাত্রী হিসেবে পরিচিত ছিল৤

খুবই ভাল ফলাফল নিয়ে একদিন এস এস সি পাস করে রুবিনা৤ আর যেন স্বর্গীয় আনন্দ নেমে আসে ওর বাবা-মা’র মন, প্রাণ ও অন্তর জুরে৤ কিন্তু সেই আনন্দ ছিল মাত্র কয়েক দিনের জন্য৤ কয়েক দিন পরই সে আনন্দ বাষ্প হয়ে উড়ে গেল, হারিয়ে গেল কোথাও৤

শহরে পাঠিয়ে রুবিনাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার মত আর্থিক সামর্থ ছিল না ওর বাবার৤ তবে ওর বাবা চেয়েছিল রুবিনা অনেক অনেক বেশি পড়াশুনা করুক৤ এজন্য চেষ্টাও করেছিল অনেক যদি কোন একটা উপায় করা যায়৤কিন্তু কোন উপায়ই করতে পারেনি৤

কোন উপায় করতে না পেরে অনেকটা হতাশায়, বেদনায় ও কষ্টে রুবিনার পড়াশুনা বন্ধ করে ওকে বিয়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়৤

রুবিনাও ভেংগে পড়ে৤ কিন্তু ওর উচ্চাকাংখা ও শিক্ষার প্রতি অদমনীয় আগ্রহ ওকে ভিন্নভাবে ভাবতে সাহায্য করে৤

স্কুলে এক সংগে পড়ত এমন এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি কলেজ সম্পর্কে জানতে পারল ও৤ কলেজটা দূরের কোন শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেই৤ কিন্তু এমন এক দূরত্বে পায়ে হেঁটে প্রতিদিন যাওয়া-আশা সম্ভব নয়৤ এটাও ছিল সত্যিকারের একটা সমস্যা৤

কিন্তু ও ওর স্বপ্ন ভরা অন্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেল একটা বাইসাইকেল, শুধুমাত্র একটা বাইসাইকেলই সমস্যার উপযুক্ত সমাধান হতে পারে৤

রুবিনা বাবাকে অনুরোধ করল কোনভাবে হলেও যেন একটা বাইসাইকেল কিনে ওকে দেয়৤

কিছুই বল্ল না ৤ তবে বিষয়টি ভাবতে লাগল রুবিনার বাবা৤ তারপর উত্তম বাবার মতই একদিন সত্যি সত্যিই একটা বাইসাইকেল কিনে দেয় রুবিনাকে৤

সাইকেলে চড়ে কলেজে যাওয়া আসা শুরু হলো রুবিনার৤ প্রতিদিনই কলেজে যায় ও৤ গ্রামের লোকেরা চেয়ে চেয়ে দেখে৤ কানাকানি করে৤ মন্দ কথা বলে৤ এমনকি এও বলে- রুবিনা সমাজের কলংক, পরিবারের লজ্জ্বা৤

কিন্তু রুবিনা মনে নেয় না কিছুই৤ ওদের কোন কিছুকে ওর চলার পথের বাধা হিসেবেও মনে করেনি কখনও৤

আমিও ওই একই গ্রামের মানুষ৤ তবে অনেক আগে বলা যায় জীবনের শুরুতেই গ্রামটাকে ছেড়ে এসেছি৤

এখন শুধু গ্রামেরই নয় পুরো এলাকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে৤

অনেক বছর পর অল্প সময়ের জন্য সেদিন গ্রামটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম৤ ভাগ্যক্রমে পুরোনো বন্ধুদের অনেকের দেখাও পেলাম৤

একটা চা’এর দোকানে একত্র হয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম৤ ইতিমধ্যে চা’এর অর্ডারও হয়ে গেছে৤ সেই মূহুর্তে দোকানের অল্প বয়সী এক ছেলে এসে চা’এর কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল৤

আমি কাপটাকে ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে প্রথম এক ঢোক চা পান করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই মোটর সাইকেলের শব্দ শুনতে পেলাম৤আমি রাস্তার দিকে তাকালাম এবং দেখলাম এক ভদ্র মহিলা মোটর সাইকেল চালিয়ে দ্রুত ছুটে চলছেন তার পথে৤

আমি বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম, “মহিলাটি কে?”

একজন উত্তর দিয়ে বল্ল, “এই সেই রুবিনা৤ এখন রুবিনা ম্যাডাম৤”

আরেকজন জানাল, “অনেক বড় সরকারী অফিসার৤ এখন পর্যন্ত গ্রামেই থাকে৤ তবে তা শুধুমাত্র বাবা-মার জন্য৤”

আমার বামে যে বন্ধুটি বসে ছিল সে বল্ল,”বাবা-মাকে নিয়ে খুব ভালভাবে শহরেও থাকতে পারে ও৤ হয়তো যে কোন সময় চলেও যাবে৤”

আমি ওদের কথাগলো মনযোগ দিয়ে শুনলাম৤

আমি রুবিনার মুখ কখনও দেখিনি৤ কিন্তু অন্তদৃষ্টি দিয়ে রুবিনার ছবি দেখলাম৤ আজকের রুবিনা৤ টগবগে, উচ্ছল, সাহসী, কর্মঠ, শিক্ষিত, উচ্চাকাংখী এবং স্বপ্নময়ী ৤

মনে মনে বল্লাম-এমন কারোর জন্যই তো পৃথিবীর সবকিছু অপেক্ষা করে৤ আজকে ও মোটর সাইকেল নিয়ে ঘরে বেড়ায়৤ কালকে মোটর যান নিয়ে ঘুরে বেড়াবে৤ তারপর বিমানে চড়ে উড়ে বেড়াবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে৤

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ