একটি অন্ধকার রাত

কেসি মিলান ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শুক্রবার, ১২:০১:১৮অপরাহ্ন বিবিধ ৩ মন্তব্য

সেদিন কলেজে গেলাম। পর পর চারটা ক্লাসে আমার উপস্থিত থাকবার কথা।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম ক্লাসটি করলাম। টগবগে তরুনী বয়সের প্রভাষিকা লোপা ব্যানার্জী পূর্ণ উপভোগ্য করে যেভাবে ক্লাস নেন ঠিক সেভাবেই ক্লাসটি নিলেন। সন্দেহ নেই তার ক্লাসে সবাই অনেক মজা পেয়েছিল। আমিও পেয়েছিলাম।

পরের ক্লাসে যাবার আগে আমরা ১৫ মিনিট হাতে পেয়েছিলাম।

আমি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে এলাম আর একজনের সন্ধানে পুরো ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি করলাম। সত্যি কথা বলতে কি গত কয়েক দিন ধরেই আমি ওর সন্ধান করছিলাম। আর আগের মতই ওই দিনও আমি ওকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

ও কি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে? গ্রামের বাড়িতে গেছে কি ও না কি …? আমার মনে এ ধরনের কিছু প্রশ্ন বার বার আসতে শুরু করল। সম্ভবত এ কারণেই অবশিষ্ট ক্লাসগুলো করার কোন ইচ্ছেই হলো না আমার। ওই দিনের বাকী সবগুলো ক্লাস বাদ দিয়ে আমি আমার এক বন্ধুর সংগে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একই সাথে আমি যে ওকে ভালবাসি আর খুবই মিস করছি বিশেষকরে এই বিষয়টি জানিয়ে একটা চিঠি লেখার এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেল্লাম।

একই কলেজে পড়ত আমার আর এক বন্ধু নুরুল আলমের কাছ থেকে জেনেছিলাম মেয়েটির নাম দোলা, দোলা ইসলাম। বন্ধুর সাথে দেখা করে আমার আবেগ অনুভূতি ও ইচ্ছার কথা জানালাম। ভাগ্যক্রমে পরের দিন চিঠিটি দোলার কাছে পৌঁছে দেবে বলে ও আমাকে কথা দিল।

এর পর আমি আদমদিঘীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যে বন্ধুর সংগে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার সেই বন্ধুটি এখানে থেকেই একটি বেসরকারী কলেজে পড়াশুনা করত।

ট্রেনে মাত্র এক ঘন্টার পথ। পৌঁছে গেলাম। গল্প-গুজবে, খেয়ে-দেয়ে, ঘুরে ফিরে প্রায় সারাটা দিনই কেটে দিলাম। শেষ বিকেলের ট্রেনে যখন ফিরে এলাম তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।

টুটুল ভাই খুবই স্নেহভরে আগেই বলে রেখেছিলেন যেন ওই দিন রাতে উনার সাথে খাওয়া দাওয়া করি আর উনার মেস বাড়িতেই থেকে যাই।

অন্য কোথাও না গিয়ে আমি সোজা উনার মেস বাড়িতে যেয়ে উঠলাম, খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর ঘুমুবার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই উনি আমাকে পাশের একটা শূণ্য ঘরে নিয়ে গেলেন।

আমি ক্লান্ত ছিলাম না তবে দোলাকে চিঠি লেখার জন্য ভিষন এক উত্তেজনা অনুভব করছিলাম।

আমি টেবিলের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসে পরলাম। উপর থেকে ১০০ ওয়াটের একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব যতেষ্ট আলো ছড়াচ্ছিল। আমি তখনই লেখা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু মনের ভুলে ব্যাগটা অন্য ঘরে রেখে এসেছিলাম। আর ওই ব্যাগেই ছিল আমার কলম আর লেখার খাতা। তাই উঠতেই হলো আমাকে।

যাহোক, কলম আর খাতা নিয়ে টেবিলে ফিরে এলাম এবং লিখতে শুরু করলাম।

প্রিয় দোলা,

আমি জানি তুমি আমাকে চেন না, জানও না। তাই আমি নিশ্চিত যখন এই চিঠিটি হাতে পাবে তখন তুমি অনেকটাই অবাক হয়ে যাবে। তবে তোমাকে আমি নিশ্চিত করছি আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ এবং তুমি যে কলেজের ছাত্রী আমিও এই একই কলেজের ছাত্র।

গত কয়েকদিন ধরেই আমি তোমাকে খুঁজছি কিন্তু তুমি কলেজে আস নি। কলেজে তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণেই আমি এই চিঠিটি লিখছি। আর লিখছি শুধু একটি কথা বলবার জন্য যে …

পুরো ঘরটাকে অন্ধকারে ভরে দিয়ে বিদ্যুৎ চলে গেল।

ঘটনাটাকে প্রথমে আমি বিদ্যুৎ বিভ্রাট বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু হাতে টর্চ নিয়ে টুটুল ভাই এলেন। আমাকে জানালেন তারে অথবা সুইচ বোডের্র কোথাও সমস্যা হয়েছে। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ আর আসবে না। আমার বরং ঘুমিয়ে যাওয়াই ভাল।

আমি তাই করলাম। লেখা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে কিছুটা দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। দেখলাম কয়েকজন ইলেট্রিুশয়ান কাজ করছে। তারা মূলতঃ তারে বা সুইচ বোডের্ যে সমস্যা হয়েছে তা সমাধানের চেষ্টা করছে।

অবশেষে জানতে পারলাম তারে নয় সুইচ বোডের্ ছোট্র একটা সমস্যা হয়েছিল।

ওই ঘটনা থেকে আমি একটা ধারণা পেলাম। ধারণাটি হচ্ছে বাল্ব নিজে কোন আলো নয়। আলো দেবার জন্য এর শক্তির প্র্রয়োজন। আর শক্তির জন্য এর একটা শক্তির উৎস আছে। বাল্ব তখনই আলো দিতে পারে যখন এই শক্তির উৎস থেকে শক্তি প্র্রাপ্ত হয়।

এমনকি দিনের যে আলো তারও উৎস আছে। আর সেই উৎসটি হচ্ছে সূর্য। মেঘ দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কিংবা ঢেকে গেলে সূর্যও আর আলো দিতে পারে না।

আলো সম্পকের্ এটুকুই ছিল আমার ধারণা।

মানুষও আলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই মতটাকে আমি বরাবরই উপেক্ষা করে গেছি। কোন অথের্ আলো তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। তবে পরবতির্তে তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছিল। কিন্তু মানুষ যে সত্যি সত্যিই আলো এ ধরনের উদাহরণের সংখ্যা খুবই কম।

এই বিরল উদাহরণের মধ্যে এটি হচ্ছে সোনিয়া আকতার যাকে দেখে নিজেকে সেদিন ধন্য মনে হয়েছিল।

আমার এক সাংবাদিক বন্ধু সেদিন আমাকে ফোন করে বল্ল একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠন হতে যাচ্ছে যেখানে এই সোনিয়া আকতারকে সম্মানিত করা হবে।

আমি জানতে চাইলে ও আমাকে এটাও জানাল যে সোনিয়া আকতার একজন আলোকিত মানুষ।

আর কোন প্রশ্ন না করে ওর সাথে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সম্মতি জানালাম।

শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে মহিলা কল্যাণ কালাব নামক একটি স্থানীয় সংস্থা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে।

আলোকিত এই নারী সোনিয়া আকতারকে এক নজর দেখার জন্যই শুধু প্রথম বারের মত আমি ওই গ্রামে গেলাম। দীর্ঘ দেহী, মধ্য বয়সী সুন্দর নারীদের মত তিনিও একজন। তার মধ্যে অন্য কোন ভিন্নতা আমার নজরে আসে নি।

কিছু সময় পর তার নিজের বক্তব্য থেকেই জানলাম অনেক কষ্ট করে কোনভাবে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন উনি।

ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ছোট একটা চাকরি শুরু করেন। পড়তে খুব ভালবাসতেন উনি। বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা, তাসলিমা নাসরিনের মত নাম করা বড় মাপের নারীদের জীবন কাহিনী অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিলেন। তাদের লেখা পড়ে দারুনভাবে অনুপ্রানিত হয়েছিলেন।

সত্যি কথা বলতে কি তিনি আজও পড়েন। সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম ও অন্য যে কোন বিষয়েই হোক তিনি তা পড়েন। আর এটিই হচ্ছে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূল উৎস।

একটা সময়ে তিনি গ্রামের হত দরিদ্র, অশিক্ষিত মেয়েদের জন্য কিছু একটা করার আকাংখা অনুভব করেন।

কি করা যায় তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ভাবতে থাকেন তিনি। পরে সিদ্ধান্ত নেন এই মেয়েদের তিনি শিক্ষিত করে তুলবেন আর এ জন্য যদি তার বেতনের সিংহ ভাগও খরচ করতে হয় তাও করবেন তিনি।

 

(https://www.youtube.com/watch?v=kLhuH0_mqFU&list=PLptDGtWYjAtJ3kOdWtDzwzhY9qY_FN3g-&index=7)

 

তার সান্নিধ্যে এসে এই মেয়েগুলো এতটাই উৎসাহিত হয়েছিল যে শত বাধা বিপত্তি সংগ্রাম সত্বেও তারা হতাশ হয় নি, আশা ছাড়ে নি। বরং কাংখিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে গেছে।

তাদের অনেকেই আজ অধ্যাপক, শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, আইন জীবি, ম্যাজিস্ট্রেট। আকাশের তারার মতই তারাও আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে, পরিবারে, সমাজে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

তাদের দেখে যে বিশেষ বিষয়টি উপলব্ধি করলাম তা হচ্ছে একজন আলোকিত মানুষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোতে জ্বলে আর সেই আলো ছড়িয়ে দেয় যেন অন্যরাও আলোকিত হয়ে উঠে।

0 Shares

৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ