জীবন চিতা-(পর্ব২ক)

আবু জাকারিয়া ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার, ১০:১১:৩৭পূর্বাহ্ন সাহিত্য ১ মন্তব্য

(২ ক)

জামিলার একমাত্র মেয়ের নাম সুমাইয়া। প্রায় ছয় মাশ পর বেড়াতে এসেছে নতুন জামাই মুহিদকে নিয়ে। বিয়ে হয়েছিল বছর দুই আগে। জামাই মসজীদে ইমামতি করে। অনেক শিক্ষিত, অনেক কিছু জানে কোরান হাদিস সম্পর্কে। আফিযিও পড়েছিল সে।
জামিলার মেয়ে জামাই বেড়াতে আসায়, মনে অনেক সাহস জন্মাল তার।
মুহিদ একটা গ্লাসে করে এক গ্লাস পানি আনতে বলল জামিলাকে। জামিলা একটা স্বচ্ছ ও পরিস্কার গ্লাসে পানি এনে মুহিদের কাছে দিল। মুহিদ চোঁখ বন্ধ করে পানি পড়তে শুরু করল। দেখে মনে হয়, দক্ষ কোন কবিরাজ চোখ বন্ধ করে বসে বসে পানি পানি পড়ছে। হয়ত বন্দ চোঁখ দুটি দিয়ে দুনিয়ার সব কিছু দেখতে পায় সে। অনেক সময় পর পানি পড়া শেষ হল মুহিদের। পানির গ্লাসটা শাশুড়ি জামিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আম্মা, পানিটুকু নিয়ে পেপে গাছটার গোড়ায় ঢেলে দিন। সানি আর মনি অধির আগ্রহে দেখতে লাগল, ওদের মা কি করতে যাচ্ছে। জামিলা পানির গ্লাস হাতে মরা পেপে গাছের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ তার কলিজার মধ্যে কেমন মোচর দিয়ে উঠল। বুঝতে পারলো না কি করা উচিত, তাই পিছনে ফিরে মেয়ে সুমাইয়ারর দিকে তাকালো। সুমাইয়া মায়ের ভীত চোঁখ দুটো স্পস্ট লক্ষ করল। সুমাইয়া ওর মাকে সাহস দিয়ে বলল, পানি ঢেলে দাও মা, কোন সমস্যা হবেনা। আমারাতো আপনার কাছেই আছি। জামিলা পানি ঢেলে দিলো মরা পেপে গাছটার গোড়ায়। শুকনো মাটিতে মুহুর্তেই সব পানি শুকিয়ে গেল। জামিলা কোন প্রকার লক্ষন ছাড়াই ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। সুমাইয়া চিৎকার করে উঠল, মা তোমার কি হয়েছে?
মুহিদ বুঝতে পারলো তার শাশুড়ি বেহুশ হয়ে গিয়েছে, পেপে গাছের গোড়ায় পানি ঢালার সময় নিশ্চিত কিছু একটা দেখেছে। মুহিদ আর সুমাইয়া জামিলাকে ঘরের বারান্দায় তুলে আনল। সুমাইয়া ভীত কন্ঠে বলল, আমার মায়ের কি হয়েছে?
মুহিদ সুমাইয়াকে শান্তনা দিয়ে বলল, চিন্তা করনা, ঠিক হয়ে যাবে। সানি বোকার মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সবকিছু, তবে কিছুই বুঝতে পারেনা ও। মনি হঠাৎ করে কান্না শুরু করে দিল। সে দিকে খেয়াল নেই সুমাইয়ার। মুহিদ সানির দিকে তাকিয়ে বলল, সানি ঘর থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো।
সানি ঘরের মধ্যে চলে গেল পানি আনতে। সুমাইয়া আবার একই প্রশ্ন করল, আমার মায়ের কি হয়েছে।
মুহিদ বলল, উনি বেহুশ হয়ে গেছেন, তারাতারি জ্ঞান ফিরবে, তুমি চিন্তা করনা। মনি একটানা কেদে চলছে।
সুমাইয়া ওকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগল।
সানি ঘর থেকে একগ্লাস পানি এনে মুহিদের কাছে দিল। মুহিদ পানিটুকু পড়ে নিয়ে শাশুড়ির নাকে মুখে ছিটাতে লাগলো আর মুখ নাড়িয়ে দোয়া কালাম পরতে লাগল। বিপদের সময় দোয়া কালাম পড়লে অনেক উপকার পাওয়া যায়। কিছুক্ষন পরে জামিলার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপর আসতে আস্তে বলল, আমি পেপে গাছটার গোড়ায় কি দেখলাম?
মুহিদ বলল, কি দেখেছেন আম্মা?
-কালো রংয়ের ছায়ার মত, মনে হচ্ছিল ওখানে কেউ বসেছিল। আমি প্রচুর ভয় পেয়েছিলাম। জামিলা বিড় বিড় করে বলল।
মুহিদ বুঝতে পারল আসল ঘটনাটা। পেপে গাছের সাথে শাশুড়ি জামিলাকে কারা যেন বান মেরেছে। হয়ত এই বাড়ির বর্তমান মালিক যারা তারাই কাজটা করেছে। কালো রংয়ের যে জিনিসটা পেপে গাছের গোড়ায় আছে, ওটা বান মারার কাজে ব্যাবহার করা একটা জ্বীন।
মুহিদ বলল, আম্মা, চিন্তা করার কিছুই নেই। আপনি ঠিক আছেন, কোন সমস্যা হবেনা আপনার।
সুমাইয়া বলল, মা তোমার তখন কেমন লাগছিল যখন পেপে গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে গেলে?
জামিলা বলল, মনে হচ্ছিল কে যেন আমাকে কারেন্টে শক দিচ্ছে। তারপর কি হল মনে করতে পারছিনা।
জামিলা আস্তে আস্তে উঠে বসল। মাথার চুলগুলো একদম এলোমেলো হয়ে রয়েছে তার। চিরুনী দিয়ে আচড়ে ঠিক করল ওগুলো। ছোট ছেলে মনির কান্না এতক্ষনে থেমে গেছে। তবে ওদের দুভাইয়ের চোখের কৌতুহল এখনও কেটে যায়নি।
সুমাইয়াকে নিয়ে বাইরে আসল মুহিদ। এদিক ওদিক একনজর তাকিয়ে বলল, সুমাইয়া, তোমার মাকে বান মারা হয়েছে।
চোখদুটো মুহুর্তে বড় বড় হয়ে গেল সুমাইয়ার। স্বাসপ্রশাসের গতি দ্রুত বৃদ্ধি পেল। সুমাইয়া বলল, কি বলছ এসব? কারা বান মেরেছে আমার মাকে।
বলার সময় গলা কেপে উঠল সুমাইয়ার, যেন অপরিচিত কাল হাত ওর গলাটা চেপে ধরেছে। হঠাৎ অনাকাংক্ষিত দুঃসংবাদে অনেক মানুষের এমন হয়, ভয়ে অথবা খারাপ কিছুর আসংকায় গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। মুহিদ সুমাইয়ার মানুষিক অবস্থাটা আচ করতে পারল। তাই সুমাইয়াকে সাহস দিয়ে বলল, চিন্তা কর না সুমাইয়া। তোমার মায়ের কিছু হবে না, আমিতো আছি।
সুমাইয়া আবার একই প্রশ্ন করল, কারা বান মেরেছে আমার মাকে?
মুহিদ চারপাশে একনজর তাকাল, দেখার চেষ্টা করল কেউ শুনছে কিনা তাদের কথা। না আসে পাশে কোন লোক দেখা যাচ্ছে না। শুধু দুরে একটা কালো কুকুর দাড়িয়ে আছে।
মুহিদ আস্তে আস্তে বলল, এই বাড়ির বর্তমান মালিক জব্বারই হবে, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
সুমাইয়ার মনে পড়ল এই জমির বর্তমান মালিক জব্বার। আগে সুমাইয়ার একমাত্র চাচা জহিরুল এই জমির মালিক ছিল। তার আগে মালিক ছিল এক হিন্দু ব্রাম্মন। ব্রাম্মন জমিটা সুমাইয়ার চাচা জহিরুলের কাছে বেচে দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। সুমাইরার চাচা অনেকদিন জাবত বিদেশে থেকে আসছে, একজন ভদ্র লোকের সহায়তায় বিদেশে যেতে পেরেছিল সে। বিদেশে বসে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাই করে। সেই টাকা দিয়েই কিনেছিল জমিটা। ইচ্ছা ছিল একটা সুন্দর বাড়ি করা। কিন্তু বার বছরের মাথায় এসে সে ইচ্ছাটার বিলুপ্তি ঘটে হঠাৎ করেই। জমিটা বেচে দিলেন তিনি। বেচে দিলেন জব্বারের কাছে।
সুমাইয়ার স্পস্ট মনে আছে, যখন তার চাচা এই জমিটা কিনেছিল, তখন তার আব্বুকে বলা হয়েছিল, থাকার জন্য। এবং তার আব্বুকে জমির এক অংশ দিয়ে দেয়ারও কথা ছিল।
সুমাইয়ার সবচেয়ে দুঃখ লাগে তার চাচা সেই কথা রাখলেন না। আসলেই একটা প্রতারক তার চাচা জহিরুল। শুধু কেনার পর জমিটা দখলে রাখার জন্যই তাদের থাকতে দিয়েছিল তার চাচা।
সুমাইয়ার দাদার সামান্য পরিমান জমিছিল একটা নদীর পারে। সেখানেই ঘর তুলে থাকতো তারা। কিন্তু নদীর ভাংগনের কারনে সেই সম্বলটুকু নদীর পেটে চলে যায়। এবং সুমাইয়ার দাদা ভূমিহীন হয়ে পরেন। সেই ভূমিহীনতা দাদার বড় ছেলে জহিরুল কাটিয়ে উঠতে পারলেও, তার ছোট ছেলে মুহাম্মদ তা পারেনি।
সুমাইয়া মুহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কি হবে?
মুহিদ বলল, ঘাবড়ে যেওনা সুমাইয়া। আমি বান কেটে দেব।
সুমাইয়া তার স্বামী মুহিদের কথায় ভরসা করতে পারে। মুহিদ এর আগেও অনেক মানুষের বান কেটে দিয়েছে। সুমাইয়া তা নিজের চোখে দেখেছে। তাই মুহিনের উপর সে ভরসা করতে পারে।

সানি আর মনি উঠনে খেলছে। বিপদের দিনে খেলাধুলা পছন্দ নয় জামিলার। তবু ওরা ছোট মানুষ, বিপদ আপদের কিছু বোঝেনা, তাই বিরক্ত হয়না জামিলা।
সুমাইয়া আর মুহিব ঘরের ভীতর ঢুকল। জামিলা একটা মুর্গী জবাই করে রান্না করছে। নতুন জামাই এসেছে, যতোই বিপদ আপদ থাকুক, জামাইকেতো একটু আদর যত্ন করা উচিৎ। যদিও বেশি আদর আপ্যায়ন করার সামর্থ নেই জামিলার। তবে কয়েকটা ডিম পাড়া মুর্গী আছে, ক ক করে আর উঠোন জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই মুর্গী গুলোর মধ্যে যেটা বড়, সেইটা জবাই করেছে জামিলা। সুমাইয়া রান্না ঘরে গেল মাকে রান্নার কাজে সহযোগীতা করার জন্য।
মা বলল, কিরে সুমাইয়া, আমাকে বান মেরেছে কে, জামাই কিছু বলেছে?
সুমাইয়া মাংস কাটতে কাটতে বলল, বোঝনা তুমি?
জামিলা বলল, হুম বুঝিতো। জব্বার হারামিটার কাজ।
সুমাইয়া কোন কথা বলল না।

দুপুরে ভাত খাওয়ার পর মুহিব তার শাশুড়ি জামিলার বান ছাড়াচ্ছে। কাছে দাড়িয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখছে সুমাইয়ারা তিন ভাইবোন। (চলবে)

0 Shares

একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ