জীবনের খরতাপ – ৩

আজিম ২৩ জুলাই ২০১৪, বুধবার, ০৪:৫৩:১১অপরাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১৯ মন্তব্য

দেশের প্রতিটা গ্রামের মত এখানেও সবুজের সমারোহ। যতদুর চোখ যায় শস্যের ক্ষেত, মাঝে মাঝে দেখা যায় দু’একটা বিরাট গাছ। দুরের পথিক গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে, গা’টা জুড়িয়ে নিয়ে শুরু করে আবার পথ চলা। মানুষের সাথে দু’টো কথাও হয় গাছের ছায়ায় বসে মানুষের। পরিচিতি হয়, জানাজানি হয়, হয় সম্পর্কও। হিন্দুতে হিন্দুতে হয়, হয় হিন্দু মুসলমানে ও।

রতনগঞ্জ নাম গ্রামটির। এর বুক চিরে চলে গেছে হাইওয়ে রাস্তা আর একপাশ দিয়ে খরস্রোতা নদী কপোতাক্ষ। এখানেই বাড়ী আনিসের নানার। সে অনেক বছর আগেকার কথা। একাত্তর শুরু হয়নি তখনও।

ঠিক মাতব্বর না হলেও আনিসের নানা মৌলভী ফরিদউদ্দিন ছিলেন মোটামুটি গ্রামের একজন প্রভাবশালী। খুব যে জমিজমার মালিক ছিলেন উনি তা নয়, তবে ব্যবহার ছিল তাঁর অত্যন্ত ভাল। আর মিথ্যা কথা তিনি বলতেননা মোটেও। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সাথে তার ছিল সদ্ভাব। মানুষ তার উপর ভরসা খুঁজে পেত, যা না পেত মাতব্বরের উপর। আসরের নামাজের পর তাঁর একজন হিন্দু বন্ধুর ঘাড়ে হাত রেখে হাঁটতেন তিনি, কথা বলতেন হাইওয়ের ধারে কোন গাছের নীচে বসে।সত্য কথা বলতেন, সৎভাবে চলতেন, কেউ পরামর্শ চাইতে এলে সৎ এবং ভাল পরামর্শটাই দিতেন।

এসমস্ত গুনই তার কাল হয়ে দাঁড়াল একাত্তরে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাত্তার মিয়া ফরিদউদ্দিনকে দেখতে পারতেননা দু’চোখে মূলত: মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি করত বলে। গ্রাম থেকে কিছু দুরে একটা ক্যাম্প করে একদিন পাক আর্মীরা। সখ্য গড়ে তোলেন মেম্বার ওদের সাথে এবং যথারীতি মুক্তিযোদ্ধা নিধন শুরু করেন। কিন্তু ফরিদউদ্দিনের ছেলেরা তো মুক্তিযোদ্ধা নয়, কীভাবে তাঁকে হেনস্তা করা যায় এই চিন্তায় বিভোর থেকে হঠাৎ একদিন মনে হয তার যে, মৌলভীর তো  সুন্দর একটা মেয়ে আছে। যেই ভাবা সেই কাজ, আর্মী নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার নাম করে একদিন ধরিয়ে দেয় পাষন্ডটা আনিসের মা মমতাজ বেগমকে।

মিলিটারীদের পা ধরে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে অনেকদুর চলে গিয়েও যখন ছাড়িয়ে আনতে ব্যর্থ হলেন আদরের মমতাজকে, তখন ওখানেই অঞ্জান গয়ে পড়ে রইলেন মৌলভী ফরিদউদ্দিন। গ্রামের মানুষের সহায়তায় বাড়ী ফিরে এলেন বটে, তবে বিছানা নিলেন তিনি। পালা করে মানুষ তাঁর সেবা করে গেছেন দিনের পর দিন। অবশেষে সপ্তাহখানেক পর আবার ভাল হয়ে গেলেন তিনি যখন সুসংবাদটা এলো যে, মিলিটারীরা পরাজিত হয়ে ক্যাম্প উঠে গেছে এবং অসম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজঘরে তুলে নিতে চেয়েছেন আদরের মমতাজকে বৌ করে।

জীবনে যতদুর মনে পড়ে এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেননি মৌলভী ফরিদউদ্দিন। তবুও কেন পরম করুনাময় খোদা তা’লা তাকে এতবড় আঘাত দিলেন ভেবে পাননা তিনি। জানেন খোদা মানুষকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু নিজ কন্যার এরকম অবস্থা দিয়ে খোদা তাকে পরীক্ষা করলেন? মনে মনে বলেন, জানিনা খোদা, তোমার মহিমা জানা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সবসময় খোদার কাছে চেয়েছেন তিনি খোদা যেন তাকে ছেলে অথবা মেয়ে, যা-ই হোক না কেন, একটি অতি সুসন্তান দান করেন, যে সন্তানের বদৌলতে তার বেহেস্ত-প্রবেশ সহজ হয়। আরো কামনা করেন, সন্তানটি যেন ভাল ও সৎ কাজ করে সবসময়, সেসমস্ত কাজের সুনাম যেন ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে।

মমতাজকে উদ্ধার করে তাঁর হবু জামাই কমান্ডার শহীদ যখন তার সামনে উপস্থিত হন এবং তার পাঁ ছুয়ে সালাম করতে উদ্যত হন, উল্টে তিনি-ই তাকে সালাম করতে যান। একমাত্র মেয়েকে উদ্ধার করার কারনে তিনি পাগল হয়ে পড়েন এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। কিন্তু পারবেন কেন মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী এবং শক্তিমান এই কমান্ডারের সাথে? পরম শ্রদ্ধার সাথে শহীদ উঠিয়ে বসিয়ে দেন তাকে। প্রস্তাব তো দেওয়াই ছিল। মমতাজই বাবাকে একপাশে ডেকে বলেন, বাবা দেরী করবেননা, কাজী ডাকেন এখনই। ওর এবং আমাদের এখনই চলে যেতে হবে, বিশেষ করে ওর যে অনেক কাজ। না, দেরী করেননি মৌলভী সাহেব শূভকাজে এবং আনন্দের পর আবার কিছুটা শোকের আবহের মাধ্যমে বিদায় জানান মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই কমান্ডার শহীদকে। অনেক পরে মমতাজ বেগম শুনেছিলেন, এরপর তার বাবা ওখানেই হাত তুলে মোনাজাত করেছিলেন, আল্লাহ্ আমার আশা একটি সুসন্তান তুমি দান করো আমাদের।

ডা. সঞ্চিতার বাসায় বসে এসবই ভেবে চলেন মমতাজ বেগম। চোখের পানি ফেলে অতি আদর করে এখানে নিয়ে এসেছে সঞ্চিতা ওঁকে। রেখেছে নিজের কাছে, শাশুড়ি হলেও একেবারে নিজের মা মনে করে ও ওঁকে। আরো আছেন সঞ্চিতার খালা। বয়স্ক দু’জনে গল্প করে কাটান ওঁরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেরই সঞ্চিতার কোয়ার্টারে থাকেন ওঁরা।

ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই আনিসের সুবাদে এক আধবার গিয়েছিল সঞ্চিতা রতনগঞ্জে মমতাজ বেগমের বাড়ী। কথা হয়েছে তাঁর সাথে, আবেগের নীরব আদান-প্রদান হয়েছে, ওটুকুই তখন। মেডিক্যালে পড়ার সময়ও যখনই বাড়ী যেত সঞ্চিতা, যেতে ভুলতনা মমতাজ বেগমের বাড়ী। নিজের মা না থাকায় উনি-ই যে হয়ে উঠেছিলেন তার মা।

বড় একরোখা আনিস, এটা জানত সঞ্চিতা। আর এই একরোখাকেই কীভাবে যেন মনের সবটা-ই উজাড় করে দিয়েছিল ও! এমনই যে, মেডিক্যালে পড়ার দীর্ঘ সময়টাতেও এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি ও আনিসকে। বরং যত দিন গেছে, তত আরো বেশী করে আকর্ষনটা গভীর হয়েছে ওর প্রতি। আনিস তখন জেলে কোটাবিরোধী আন্দোলনে এক উগ্র ম্যাজিষ্ট্রেটকে লাঞ্ছিত করার কারনে।সঞ্চিতার অবস্থা তখন এমন যে, সবসময় আনিসের জন্য তার মধ্যে একটা অস্থিরতার ভাব কাজ করে। আনিসকে না পেলে কোনমতেই তার চলবেনা। মানসিকভাবে পযুর্দস্ত হয়ে পড়েছে ও অনেকটা। কিন্তু উপায় কী! বাইরে থাকলে তবুও হোত, কিন্তু আনিস যে অন্তরীন।

এরকম অবস্থায় আনিসের মা মমতাজ বেগমের স্মরনাপন্ন হয় ‍সঞ্চিতা। জানে, এই একটাই পথ খোলা আছে তার সামনে। সবই খুলে বলে তাঁকে, সেই কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে আনিসের ভ্যানে চড়ে বাড়ী যাওয়া এবং আর সবই। মমতাজ বেগম ভীষন চিন্তায় পড়ে যান, বলেন এ কী করলে মা তুমি! যেরকম ছেলে আমার, তোমার কথায় সাড়া দেয়নি, সমাধান হবে কী করে, ভেবে তো আমি আসলেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। চুপচাপ বসে থাকে দু’জনই, অনেক অনেকক্ষন।

সঞ্চিতাই বলে ওঠে একসময়, মা আমি আপনাকে নিয়ে জেলখানায় গিয়েই কাজটা সমাধা করতে চাই।

কিছুটা যেন চিন্তামুক্ত হলেন মা সমাধানের একটা সম্ভাব্য পথ পেয়ে। বলেন, দেখ মা, সম্পুর্ন চিন্তামুক্ত কিন্তু হতে পারছিনা আমি। আনিস আমার প্রথম সন্তান, জীবনে প্রথম ওর মুখেই ‘মা’ ডাক শুনি আমি। আর ও যখন একান্ত-ই শিশু, কতই আর বয়স তখন ওর, মাত্র সাত, সেই তখন থেকেই ও আমাদের অন্ন জুগিয়ে যাচ্ছে অতি কষ্টকর শ্রম করে। জেলখানায় তোমার সাথে আমাকে দেখে এবং তোমার উদ্দেশ্য সফল করতেই আমার আসা, এজন্য যদি ও দু:খ পায়, তবে সেটা হবে আমার জন্য অতি হৃদয় বিদারক। আমি কেমন করে আমার এই অতি সুসন্তানকে ব্যথা দিব মা! ঝরঝর্ করে কেঁদে ফেলেন তিনি, বলেন আমার এই সন্তানের শিশুকালের শ্রমের কথাগুলো যখনই আমি মনে করি, কান্না সামাল দিতে পারিনা মা, তুমি মনে কিছু কোরনা।

কেঁদে ফেলে সঞ্চিতাও। স্বপ্ন তার ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে সেজন্য নয়, মা-র কান্না দেখে, নীরব কতখনি বোঝাপড়া থাকলে একজন মা তার সন্তান সম্পর্কে এতো উচ্চ ধারনা পোষন করতে পারে তা দেখে। চিন্তাক্লিষ্ট মার সামনে আর কিছুক্ষন থেকে স্বপ্নভঙ্গের বিধ্বস্ততা নিয়ে উঠে চলে আসার জন্য উদ্যত হয় ও।

দাঁড়াও সঞ্চিতা, বলে ওঠেন মা। আনিসের দিকটাও আমি চিন্তা করি মা।তোমার কথায় আমার মনে হয়েছে, রাজনৈতিক কাযর্ক্রমে ওর যাতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়, সেজন্যই ও কোন অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চায়না। তবে তুমি যে বাধা, এটা হয়তো আর ভাবেনা ও, এরকমও তো হতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে তো সেরকম যোগাযোগ নাই দীঘর্দিন, তাইনা!

এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো মা যে, বলেন মমতাজ বেগম, আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি সেটা বলো, আর আমরা দীঘর্দিন একসাথে থেকেছি, যা-ই বলো আমাদের মধ্যে একটা প্রখর বোঝাবুঝি কিন্তু আছে মা। কোনদিন জ্বরের তোড়ে সারারাত বিছানায় পড়ে থাকলে আমার আনিস সারারাত জেগে আমার শিওরে বসে থেকেছে, কপালে বুলিয়ে গেছে হাত, কখনও বা পানি ঢেলেছে মাথায়। সকাল হয়েছে, আমি মৃদু বকেছি সারারাত ওর জেগে থাকার জন্য। ও বলেছে যদি তোমার কিছু লাগে মা, এজন্য না সরে আমি এখানে বসে ছিলাম। আবার ওর সৎবাবার ছেলেটাকে ও খুব ভালবাসত। একদিন ছেলেটা আমার সাথে একটা বেয়াদবী করেছিল। এজন্য ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে বসে আনিস। আমার খারাপ লেগেছিল। ও সেটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে ওকে। এ-ই হচ্ছে আমার আনিস মা। রাজনীতি ওর ধ্যান-ঞ্জান! অথচ আমার মনে হয়, ওকে যদি আমি রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলি অথবা কমপক্ষে ও যদি বোঝে যে, আমি চাইনা ও রাজনীতি করুক, তবে ছেড়ে দেবে ও রাজনীতি। কারন ও জানে, মা অন্যায় কোন সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবেনা। আর মা যে-সিদ্ধান্ত দিবে, জেনে-শুনেই সেটা দিবে এবং সেটা আমায় মানতে হবে।
আমার আনিস কখনও কোন খারাপ কাজ করেনি এবং খারাপ কোন কাজের সাথে ও কোনদিন জড়িত নয়, ছিলনা এবং থাকতে পারেনা। এই বিশ্বাসটা আমার আছে, ও জানে বলেই আমার যেকোন কথা ও কোনদিন অস্বীকার করেনা, মেনে নেয়।

একটু থেমে আবার বলেন তিনি, ঠিক আছে মা চলো, যাবো আমরা জেলখানায়। আমার আনিস ভাববেনা যে, আমি তোমাকে ওর সাথে বাঁধার জন্য জোর করতে এসেছি।

জেলখানায় শুভপরিনয়ের কথা শক্তভাবে যখন পাড়ে সঞ্চিতা আনিসের কাছে, কিছুক্ষনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায় আনিস। সঞ্চিতার চোখ ফলো করে কিছুটা দুরে দাঁড়ানো মাকে দেখতে পায় ও তখন। বুঝে যায় সবকিছু। বুঝে নেয় মত দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই ওর। ঘটনা ঘটতে দেরীটা হয়না তখন আর।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ