এ্যান্টিরেপিং মুভমেন্ট (পর্ব-৩)

আজিম ২৭ আগস্ট ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৪১:২১অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১২ মন্তব্য

পুরোনো একটা জমিদারবাড়ী। বাড়ীর সামনের দিক শ্যাওলা আর অন্যান্য ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। শতবর্ষেরও আগে থেকে জমিদারবাড়ী গুলির প্রতাপ-প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের পর। আগে জমিজমার কোন কাগজ ছিলনা, যার জোর বেশি, সে দখল করে রাখতো জমি। ১৮৯৩ সাল সম্ভবত:, তখন জমির কাগজপত্রের প্রাথমিক কাজগুলি শুরু হয়, এসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন হয় এবং তখন থেকেই কমতে থাকে জমিদারদের প্রতাপ। তারপরেও অর্ধ্বশত বছর বাড়ীগুলিতে নামেমাত্র জমিদারগন অথবা তাদের আত্মীয়স্বজনরা বাস করতো। ক্রমে তারা আর বসবাস না করার ফলে বাড়ীগুলি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে, দেখাশুনা করার লোকের অভাবে বাড়ীগুলিতে শ্যাওলা পড়তে থাকে, বিভিন্ন রকমের লতাগুল্মে ভরে ওঠে বাড়ীগুলি। অনেক হিন্দুপ্রধান এলাকায় বাড়ীগুলোতে বসবাস কওে এখনো কিছু দরিদ্র হিন্দু পরিবার। কিন্তু জমিলাদের এই এলাকা হিন্দুপ্রধান নয়। তাই এখানকার এই জমিদারবাড়ীতে কেউ বাস করেনা। নির্জন এই বাড়ীটিতেই চলে জমিলাদের প্রশিক্ষণ।
বাড়ীটার ভেতরে অনেকগুলি কক্ষ। প্রশিক্ষণে অবশ্য এতো ঘর লাগেনা ওদের। সদস্য তো মাত্র পাঁচজন। প্রশিক্ষণ অর্থাৎ পাঁচজন ওরা একে অন্যকে প্রশিক্ষণ দেন এবং নেনও। জমিলা ওদের হেড।
রাবেয়ার সাথে সেদিন জামিলার অনেক কথা হয়েছিল। তারা সংগঠিত হবেন এবং পাষন্ডদের উপর আঘাত হানবেন, চরম আঘাত। আর এজন্যই প্রশিক্ষণ দরকার। কথা হয়েছিল তারা উভয়ে নিজ নিজ এলাকায় পাঁচজন এক হবেন। নিজেদের খুব আপনজন, যারা অত্যন্ত কষ্ট অনূভব করেন ঘটনাগুলোর জন্য, কিছু একটা না করতে পারার যাতনা মনে পোষণ করেন যারা, যারা গোপনীয়তা রক্ষা করবেন বলে বিশ্বাস করা যায় এবং সর্বোপরি বিপদে নুইয়ে পড়বেননা, এধরনের মেয়েদের বাছাই করতে হবে। প্রশিক্ষণটা আসলে কিছু করার ইচ্ছাটা দৃঢ়ভাবে জাগিয়ে তোলা, লালন করা আর গরুর মাংসের হাড্ডি কাটার দা’র দুই পাশ দিয়েই আঘাত করার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়া। কোন্ পরিস্থিতিতে এপাশ না ওপাশ, কোনটা ব্যবহার করা লাগে ঠিক নাই, তাই দুই পাশ দিয়েই আঘাত করার পদ্ধতি অনুশীলন করছেন ওরা।
প্রথম দিন জামিলা কান্নাজড়ানো কন্ঠে ওদের বলেন, দেখেন আপা, আপনারা যদি মনে করেন আমি আপনাদের আমার স্বার্থে ব্যবহার করছি, তবে আসবেননা। তবে আমাকে আমার মেয়ের উপর যে চরম অন্যায় আর অপমানজনক অত্যাচার হয়েছে এবং শেষে তাকে খুন করা হয়েছে, তার প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। ডান হাতে ঐ দা’টা মাথার ওপর তুলে ধরে জ্বলন্ত চোখে বলে যান জামিলা। যদি কেউ না থাকেন, তবে কমপক্ষে আমার প্রতিশোধ গ্রহনের আগ পর্যন্ত এগুলি প্রকাশ করবেননা। তাহলে যে আমার প্রতিশোধ নেয়া হবেনা আপা।
মিলির বান্ধবীর অল্পবয়সী এক খালা আছেন ওদের মধ্যে, রাবিনা। মিলিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, দিন-রাতের তাৎপর্যপূর্ণ একটা সময় মিলি থাকতো ওর সাথে। চোখ ভিজে যায় রাবিনারও। জামিলার মতো করে দা উঁচিয়ে তিনিও বলে ওঠেন অনেক কিছু, বুঝিয়ে দেন এখান থেকে কেউ সরে যাওয়ার নন।
সমস্বরে আর সবাই বলে ওঠেন, আমরা মিলিকে অত্যন্ত ভালবাসি। আমরা জীবন বাজি রেখে আপনাকে প্রতিশোধ নেয়াবো, আমরাও নেব। শুধুমাত্র আপনাকে প্রতিশোধ নেয়ার কাজে সাহায্য করতে এখানে আসিনি আমরা আপা। এ যে আমাদেরও প্রতিশোধ। এ প্রতিশোধ না নিলে আমরাও যে শান্তি পাবোনা। এই পাঁচজন একইসাথে এগিয়ে যাব আমরা। আপনি কোন দ্বিধা করবেননা, যখন যা করা লাগবে, অকোপটে বলবেন সব। পাঁচহাতে পাঁচটা অস্ত্র, দা একইসাথে ডানহাতে শূন্যে তুলে ধরলেন ওরা, শুরু হলো মুভমেন্ট।
রাবেয়াদের এলাকায় ওরকম কোন জমিদারবাড়ী নাই। নির্বিঘেœ প্রশিক্ষণ এখানে সম্ভব নয়। তাই বলে বসে থাকবে কেন ওরা? একমাত্র সন্তান, অবলা, কথা-বলতে-না-পারা বোবা মেয়ে রুকু’র উপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিশোধ যে নিতেই হবে মা রাবেয়াকে। রুকুর প্রিয় বান্ধবী আছে দু’জন আর দু’জন রুকুদের আত্মীয়পর্যায়ের। এদের বিশ্বাস্ততার কোন অভাব নেই। রুকুর বান্ধবী দু’জনের অভিব্যক্তি বিষয়টা অতি স্পষ্টভাবে জানান দেয়। আর আত্মীয় দু’জনই উল্টো রাবেয়াকে সর্বদা তাড়া দেন প্রতিশোধ গ্রহনের।
রাবেয়ার স্বামী দিনমজুর হাশেম আলীর একটা ভ্যান কেনার কথা চলছিল অনেকদিন ধরে। অন্য মজুরদের সাথে হাশেম আলীও চলে যেতেন দেশের অন্যান্য জায়গায় যেখানে ২/১ মাস ধরে কাজ করা যায়। সেসমস্ত জায়গায় কাজ করে ওরা কিছু কিছু করে টাকা জমান। হাশেম আলীও জমিয়েছিলেন। জমা করে রাখতেন তিনি একটা ভ্যান কিনবেন বলে। টাকা প্রায় হয়ে এসেছিল, তখনি ঘটে তার অতি প্রিয় রুকু’র জীবনে সবচেয়ে বিভৎস ঘটনা।
অনেক চিন্তা করে ওরা প্রশিক্ষনের একটা জায়গা পেয়েছেন। দুই মাইল দুরে নদীর ধারে একটা শশানঘাট আছে। আশেপাশে কিছু ঝোঁপঝাড়ও আছে। বিশেষত: সন্ধ্যার পর ওখানে একটা পোকাও থাকেনা, কোনো বাড়ীঘরও নাই আশেপাশে। ভ্যান কেনার তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তটা আসে তখনি। কোনো কোনোদিন বিকেলের দিকে ওরা চলে যান শশানঘাট এলাকাটায়। সন্ধ্যার আঁধার যখন স্পষ্ট হয়, সেই সময়টাতে নেমে পড়েন ওরা ভ্যান থেকে। ঝোঁপঝাড়ের সরু পথ ধরে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেন ওরা। সামনে থাকেন রাবেয়া। ডান পা’টা একটু ভাঁজ করে, বাম পা কোনোরকম ভাঁজ না করে টেনে টেনে, শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে বাঁকিয়ে ডান হাতে উদ্ধত তলোয়ার নিয়ে দৃপ্তপদে এগিয়ে চলেন তিনি শশানের দিকে, পেছনে বাকী চারজন।
এভাবে একশান নিয়ে চলেন কেন কাকী? রুকুর এক বান্ধবী প্রশ্ন করে।
এভাবেই চলতে হবে মা প্রতিশোধের আকাংখাটা জাগিয়ে রাখার জন্য।
হাঁ কাকী, তবে প্রতিশোধের ইচ্ছা আমাদের মন থেকে কখনো মুছে যাবেনা। আমরা দেখেছি, অঘটনটার পরে রুকুর অভিব্যক্তি। বোবা মেয়েটা অত্যাচারের যখন বর্ণনা দিতে থাকে, ওর অভিব্যক্তি সহ্য করতে না পেরে আমি সরে গিয়েছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও আমি কিন্তু তখনি করেছি, প্রতিশোধ নেব, নেবই। কল্পনা করেছিলাম নিজকে রুকুর জায়গায় বসিয়ে। দু’চোখ ছাপিয়ে পানি আসে মেয়েটির চোখ দিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে ও, হাঁটতে হাঁটতে আর কথা বলতে পারেনা।
রুকু’র অবিবাহিত এক খালাও এই টীমের সদস্য। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী মহিলা। ঘটনার পরই হাঁসুয়া নিয়ে একাই শয়তানটাকে কেটে ফেলতে গিয়েছিলেন। বলেন, আপনারা তো আমাকে যেতে দিলেননা সেদিন। নাতো এতোদিন কী ও বেঁচে থাকতো আর! আমি তাকে ঠিকই মেরে ফেলতাম সেদিন, প্ল্যান ছিল কল্লা কেটে ফেলব।
তোমাকেও যে পেতামনা আর আমরা। রাবেয়া বলেন।
ম্লান হাসেন উনি। আমাদের রুকু যদি কথা বলতে পারতো, বোবা না হতো, তবে এত রাগ হতোনা আমার। এরচেয়ে অপমানজনক অত্যাচার আর হয় বলে আমি জানিনা। এমন এক অসহায়, যে কথা বলতে পারেনা, তার উপর পাশবিক অত্যাচারের কথাগুলো বলারও যার ক্ষমতা নাই। এরকম এক ফুল...
উনিও আর কিছু বলতে পারেননা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোনমতে বলেন, ওর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মৃত্যু আমার কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার আপা।
এভাবেই এগিয়ে চলে ওদের প্রশিক্ষণ, প্রতিশোধের স্পৃহা জাগরূক রাখা আর গরুর মাংসের হাড্ডি কাটার দা ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। (ক্রমশ:)

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ