একাত্তরে এক কঠিন ঐক্য আর জাতীয় চেতনাবোধ ছিল বাঙালীর মননে।
এই চেতনাবোধ আমাদেরকে ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে বাঙালী করে তুলেছিলো। চেতনাবোধের সে স্ফুলিঙ্গ আগুন ধরিয়েছিলো বাঙালীর মননে। যার ফলে প্রবল পরাশক্তির শতভাগ সমর্থন থাকার পরও পাকবাহিনীর ইজ্জত মুক্তিবাহিনীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল তাসের ঘরের মতো।

চেতনাবোধের সে জাদুস্পর্শ ছুঁয়ে গিয়েছিলো দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীর মননেও। ঐক্য আর চেতনাবোধের স্পর্শ এতোই অনুভুতিপূর্ণ ছিলো, যা দিয়ে বাঙালীরা বিদেশীদেরও জাগিয়ে তুলেছিলো। কঠিন ঐক্য আর দৃপ্ত শপথের জোরেই মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে বাঙালী জাতি ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন জাতি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়ায়।

কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের ডিসেম্বর আর একাত্তরের সেই ডিসেম্বর এর মাঝে যেনো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। একাত্তরে শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করে যুদ্ধ জিতেছি আমরা। শত্রুপক্ষ থাকলেও সেসময় ছদ্মবেশী প্রতিপক্ষ ছিল নগন্য। কিন্তু আজকের দিনে যেনো ঠিক তার উল্টো স্রোত বইছে। অনেক প্রগতিবাদী মুখোশের আড়ালে একাত্তরের চেতনাবিরোধী শক্তি লুকিয়ে আছে যারা ডিসেম্বরের অর্জনকে এড়িয়ে চলতে চায়। ১৬ই ডিসেম্বরের বিকেলের সেই পরাজয়ের গ্লানি তাদের আজও রক্তাক্ত করে। সুযোগ পেলেই তারা এখনো বাঙলাকে বাঙলাস্থান বানানোর স্বপ্ন দেখে।

যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হলেও মাত্র ৪ বছরের মাথায় প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে নব্য স্বাধীন জাতিটির ঘাড়ে চেপে বসে অনির্বাচিত সামরিক সরকার। শুরু হয় এদেশে দীর্ঘ অন্ধকারের যুগ। প্রায় ১৫টি বছর দেশটি তাঁদের নিয়ন্ত্রনে থাকে। নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তাঁরা ধর্মীয় অনুভুতিতে সুরসুরি দেয় এমন রাজনীতিতে উৎসাহ প্রদান, যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি করার সুযোগ, এমনকি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে খুনীদের তাঁরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে এদেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির লড়াই, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার লড়াই, শুভ ও অশুভের লড়াই, ধর্মপরায়নতা ও ধর্মান্ধতার লড়াই।
ওই সময়টাতে এই কুরাজনীতিতে পরে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এমন একটি প্রজন্ম বেড়ে ওঠে, যাদের মননে দেশপ্রেমের চেতনাকে বিলুপ্ত করে দেয়ার মানসে ধর্মীয চেতনার নামে কৌশলে ধর্মান্ধতার বিষাক্ত বীজ বপন করা হয়। গড়ে ওঠে একটি বিকলাঙ্গ সমাজ কাঠামো।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক সরকারকে বিতারিত করা হলে দেশের শাসনভার গ্রহন করে একটি নির্বাচিত সরকার। কিন্তু ক্রমেই ফুটে উঠে যে, তাঁরাও সামরিক সরকারেরই গর্ভজাত।

কিন্তু আজ দেরীতে হলেও আমাদের মধ্যে জাতীয় মূল্যবোধ জেগে উঠতে শুরু করেছে। আমরা শেকড়ের খোঁজ পাচ্ছি। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর হলেও আমরা পাকিস্তানের মাটিতে অযত্ন আর অবহেলায় 'গাদ্দার' নাম নিয়ে চতুর্থ শ্রেনির কবরে শুয়ে থাকা বাঙালী জাতির 'শ্রেষ্ট সন্তান' বীর শ্রেষ্ট মতিউর রহমানকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
আমরা জানতে পেরেছি কে সেই সাহসী বীর ফ্লাইং অফিসার ওয়ালীউল্লাহ, যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত থেকেও পাকিস্তানের আনুগত্য অস্বীকার করেছিলো। জানতে পেরেছি সাহসী বীর হওয়া সত্বেও এই স্বাধীন বাঙলাদেশে ওয়ালীউল্লাহ উইং কমান্ডার পদ প্রাপ্ত হয়ে অবসর গ্রহন করেন অথচ পাকিস্তানের একান্ত অনুগত থাকা আরেক বাঙালী অফিসার উইং কমান্ডার সাইদ আহমেদ বাঙলাদেশ সরকারের পূর্ণ সেক্রেটারির পদমর্যাদায় পৌছে অবসর গ্রহন করে। । এসব সম্ভব হয়েছিলো প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা এই দেশের শাসনতন্ত্র দখল করাতে। আজকের দিনে আমরা যেভাবে রাজাকারকে রাজাকার বলতে পারছি, একসময় স্বাধীন দেশে সে সাহসও কারো ছিলোনা। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদই প্রথম 'রাজাকার' শব্দটি তাঁর নাটকের মাধ্যমে প্রথম নিয়ে আসেন, তাও আবার পাখির বুলি হিসাবে ”তুই রাজাকার, তুই রাজাকার” বলিয়ে। সেজন্য তাঁর কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

অন্যদিকে এই স্বাধীন বাঙলাতেই পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা চেপে বসায় তাদের ব্যবস্থাপনায় যুদ্ধকালীন সময়ে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ধরিয়ে দেওয়া আব্দুস সামাদ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য “বীর প্রতীক” খেতাব পান। অথচ বীর বাঙালী জগতজ্যোতিকে খেতাব প্রদানের ঘোষনা দিয়েও খেতাব দেয়া হয়না। আব্দুস সামাদ ৩ মাস ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসাবে অনেক গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন সত্য কিন্তু তার থেকে বড় সত্য যে, সামাদের সাহায্য নিয়েই পাকবাহিনী রুমী, আজাদ, আলতাফ মাহমুদসহ প্রায় ৩২ জন সুর্যসন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছে তবুও সহযাত্রীদের খোঁজ দেয়নি।
গতকালও আমাকে এসব নিয়ে এক পাকপ্রেমির সাথে তর্কে লিপ্ত হতে হয়েছে। ঘরে-বাইরে, ডানে-বায়ে এখন প্রতিনিয়তই এমন বিতর্ক করে যেতে হয়। হয়তো করতে হতো না। কিন্তু ঘুমন্ত চেতনা যখন থেকে নিজের মধ্যে জেগে উঠেছে, তখন থেকে যে আর চুপ করেও থাকতে পারিনা। বর্তমানে আমার এই দেশে চুপ থাকা লোকের সংখ্যাই বেশি, যে কারনে দিনে দিনে স্বাধীনতাবিরুদ্ধ শক্তিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

কিন্তু এখন সময় এসেছে ডিসেম্বরের বিজয়গাথাঁ ছড়িয়ে দেবার। বিজয়ের আলোয় জাতিকে আলোকিত করার। কাজেই আর চুপ করে বসে থাকলে হবেনা। জাগতে হবে, জাগাতে হবে। ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে!

0 Shares

৩৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ