ছোট গল্প**একটি সন্তানের স্বপ্ন**

আবু জাকারিয়া ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, রবিবার, ১০:২২:৩৭পূর্বাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১৪ মন্তব্য

**একটি সন্তানের স্বপ্ন**

সকালের মিষ্টি আবহাওয়া সাথে গরম চা বেশ মানানসই। প্রতিদিনই নাস্তার সাথে চাও তৈরী হয়।
চা খেতে খেতে গল্প চলতে থাকে। গল্পগুলো খুব স্বাধারন, বেশিরভাগই পুরানো দিনের প্রেমের গল্প।
"আচ্ছা, তুমি যদি আমায় না পেতে, তাহলে কি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে?" সুমি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে। ওর হাসি দেখতে স্বাধারন, তবে সুন্দর, কোন এক কাল্পনিক রাজকন্যার মত, কিন্তু রাজকীয় সাজসজ্জাহীন।
রবি মুচকি হাসে, বলে, কখনই না।
-"ভাগ্যিস চাকরীটা হয়ে গিয়েছিল তোমার। তা না হলে, বাবা অন্য কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন।"
-"সেই ছেলেটা নিশ্চিত আমার থেকেও ভাল হত।" রবি দুষ্টমী করে বলে।
"আরে যাহ! তা হয় নাকি!" কিছুটা লজ্জা পায় সুমি। ফর্সা গালে দুই বিন্দু ঘাম চিক চিক করে ওঠে ওর।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায় রবি। প্রায় ৮ টা বেজে গেছে। ১০ টায় অফিস আছে। সাড়ে নয়টায় বাসা থেকে বের হতে হবে। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ বিরক্ত লাগছে রবির কাছে। আজকের সকালটা দ্রুত চলে যাচ্ছে। সুমি বলে, গল্প করলে কাজ হবেনা, অফিসে যাবে, রেডি হয়ে নাও।
রবির ইচ্ছে করে সারাটা দিন সুমির সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিতে। কিন্তু চাকরী করলে কি আর নিজের ইচ্ছাকে প্রধান্য দেয়া যায়। তাহলেতো চাকরীটাই খোয়া যাবে।
রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলছে। শব্দে কান বসে যাওয়ার মত অবস্থা। রবি মটর সাইকেলটা বাইরে নামিয়ে আনল। খুব ময়লা জমে আছে। তাই পরিস্কার করতে হবে। একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে সাইকেলটা মুছতে লাগল রবি। মুছে চকচকে বানাতে হবে। তা না করলে যে খারাপ দেখাবে নতুন মটর সাইকেলটা। হঠাৎ একটি বিমান এসে রবির সামনে পড়ল। কাগজের তৈরী বিমান এটা। রবি বুঝতে পারল কোন ছোট ছেলেদের কাজ। বাড়ির গেটটি খোলা ছিল। একটি ৫-৬ বছরের ছেলে গেট দিয়ে বাড়ির ভীতর ঢুকল। কাগজের বিমানটা মটর সাইকেলের চাকার কাছে পড়ে আছে। ছেলেটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার ছুড়ে মারল। বাড়ির উঠোনে কাগজের বিমানটা উড়ানর পর ছেলেটা এসে রবির পাশে বসল। মটর সাইকেল পরিস্কার করার দৃশ্য দেখতে লাগল।
রবি নম্র গলায় বলল, তোমার বাসা কোথায়?
ছেলেটা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, নানা বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
-কোথায় তোমার নানা বাড়ি?
ছেলেটা হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাল।
ঠিক কোন দিকে দেখিয়েছে, বুঝতে পারল না রবি। ছেলেটা উঠোন জুড়ে কিছুক্ষন খেলা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
রবি ঘরে এসে গোসল করল, সকালের নাস্তা খেল। ততক্ষনে ৯ টা বেজে গেছে। আর আধা ঘন্টা পরেই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবে রবি। ততক্ষন সুমির সাথে গল্প করতে লাগল ও।
সুমি জালানা দিয়ে বাইরে তাকাল। বলল, ওই ছেলেটা কে?
রবি তাকিয়ে দেখল সেই ছেলেটা আবার এসেছে। একটা পেয়ারা গাছের ডাল ধরে ঝুলছে। পাতা ছিড়ে ছিড়ে খেলা করছে আপন মনে।
রবি বলল, চিনিনাতো। শুনেছি এখানে নানা বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সুমি চেয়ে চেয়ে কিছুক্ষন ছেলেটাকে দেখল। তারপর বলল, ছেলেটাকে দেখে কি মনে হচ্ছে যানো?
-কি?
-মনে হচ্ছে আমাদের ছেলে।
-ও তাই, একটা বাবু পেতে খুব ইচ্ছা করছে!
-আরে তুমি এত দুষ্ট কেন?
-কেন, দুষ্টমির কি করলাম?
-আমি কি তাই বলেছি?
-তাহলে?
-আমি বলেছি, ছেলেটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ছেলের মত। দেখ আমাদের উঠোনে এসে খেলা করছে।
-তার মানে আমাদের একটা বাবু চাই?
বলেই উচ্চ শব্দে হেসে ফেলে রবি।

রবি বাসা থেকে বের হল অফিসে যাবে বলে। ছেলেটা তখনও উঠোনে বসে খেলছে।
রবি বলল, কি ব্যাপার বাবু, তুমি বাসায় যাচ্ছোনা কেন?
ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, একা যেতে পারছিনা।
রবি বলল, ঠিক আছে, তাহলে এগিয়ে দিয়ে আসি তোমাকে।
রবি বুঝতে পারল ছেলেটার নানা বাড়ি আসে পাশেই হবে। তাই ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তায় হাটতে লাগল, বলল, তোমার বাসা কোন দিকে?
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকাল এবং বলল, মনে নেই।
রবি ছেলেটাকে নিয়ে একটা বিপদে পড়ে গেল। ভাবল, ছেলেটাকে বাসায় এগিয়ে না দিয়ে আসলে হারিয়ে যেতে পারে।
রবি আসে পাশের কয়েকটা গলি খুজেও ছেলেটার বাসার সন্ধান বের করতে পারল না। এদিকে অফিসের টাইম হয়ে গেছে, অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই ছেলেটাকে নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে এল রবি। সুমি ছেলেটাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার ছেলেটাকে দিয়ে আসলেনা?
-ওর নানার বাসা খুজেই পেলাম না, কিভাবে দিয়ে আসব?
-তাহলে এখন কি করবে?
-এখন আপাদত তোমার কাছে রাখ, দেখ কেউ খুজতে আসে কিনা।
-যদি কেউ খুজতে না আসে?
-তাহলে আমি অফিস থেকে এসে ওকে ওর নানার বাসা খুজে পৌছে দেব।
-আচ্ছা। মাথা নেড়ে সায় জানালো সুমি।
রবি ছেলেটাকে সুমির কাছে রেখে মটর সাইকেলে চেপে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

★★

রবি অফিসে চলে গেলে সুমি একা হয়ে যায়। একা একা বাসায় বসে থাকতে বরিং লাগে তার। কিন্তু আজ অন্তত একজন সংগি পেল সুমি।
সুমি ছেলেটাকে বলল, তোমার নাম কি বাবা?
-সান্ত। ছেলেটা উওর দিল।
-তুমি কি খেতে পছন্দ কর?
-চিপস।
সুমি সান্তকে নিয়ে কাছাকাছি একটা দোকানে আসল। সেখান থেকে চিপস কিনে দিল।
"আর কি খাবে?" সুমি প্রশ্ন করল।
"জুস।" শান্ত বলল।
সুমি এক প্যাকেট জুসও কিনে দিল।
-আর কি খাবে?
-আইস ক্রিম।
সুমি আইস ক্রিম কিনে দিল শান্তকে।
তারপর সব কিছু নিয়ে বাসায় আসল।
শান্ত প্রথমে চিপসের অর্ধেক খেয়ে ফেলে রাখল, তারপর জুস পুরোটা খেল।
কিন্তু আইস ক্রিম খেল না।
সুমি বলল, আইসক্রিমটা খেয়ে নাও শান্ত।
-না। খাবনা।
-কেন খাবেনা?
-খেতে ইচ্ছে করছেনা।
-আমি খাব?
ছেলেটা মাথা নেড়ে হা সূচক উওর দিল।

সুমি দেখল বাড়ির গেটের কাছে একটা লোক খেলনা নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
"খেলনা লাগবে তোমার?" সুমি প্রশ্ন করল।
-হ্যা। মাথা নেড়ে উওর দিল শান্ত।
সুমি শান্তকে একটা খেলনা গাড়ি কিনে দিল।
শান'ত গাড়িটা উঠোনে নিয়ে পো পো শব্দে চালাচ্ছে। সুমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

দুপুর হয়ে গেছে। সুমি শান্তকে চুলে শ্যাম্পু দিয়ে দিল, গায়ে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিল। গোসল করানোর পরে মাথার ভেজা চুল মুছে দিল, মাথা আচড়ে দিয়ে পরিপাটি করল।
সুমি শান্তকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসল। শান্ত খাবার প্রতি অনিহা দেখাল।
শান্তর সামনে খাবার প্লেট কিন্তু খাওয়ার দিকে মন নেই তার। খেলনা গাড়িটার চাকাগুলো হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে ও।
সুমি বলল, তোমাকে খাইয়ে দেব শান্ত?
শান্ত কথা বলছে না।
সুমি নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে লাগল শান্তকে। সুমি বলল, আমাকে কি ডাকবে বলতো শান্ত?
"কি ডাকব?"
সুমি কিছুক্ষন ভাবল।
তারপর বলল, আমাকে আন্টি ডাকবে, কেমন?
শান্ত মাথা নাড়ল, আচ্ছা।
কয়েক লোকমা খাওয়ার পর শান'ত বলল, আর খাব না।
বলেই উঠোনে গিয়ে খেলনা নিয়ে খেলতে লাগল শান্ত।

পেয়ারা গাছে কোথা থেকে একটা পাখি উড়ে এসে পড়ল। বেশ বড় একটা পাখি আর অদ্ভুত তার গায়ের রং। পাখিটা শান্তর চোখ এড়ালো না।

"ওটা কি পাখি আন্টি?" শান্ত প্রশ্ন করল সুমিকে।
-জানিনাতো বাবা।

পেয়ারা গাছটার একটা ডাল নিচে ঝুলে আছে। শান্ত ডালটা ধরে ঝুলতে শুরু করল। পাখিটা তা টের পেয়ে উড়ে চলে গেল। হঠাৎ শান্ত ধপ করে পড়ে গেল। সুমি দৌড়ে গিয়ে শান্তকে কোলে তুলে নিল।
"ব্যাথা পেয়েছে বাবা?"
"না।" মাথা নেড়ে উওর দিল শান্ত।

★★

বিকেল চারটায় ফিরে এল রবি। ছেলেটাকে এখনও এখানে দেখে অবাক হল ও।
বলল, কেউ খুজতে আসেনি ওকে?
সুমি মাথা নেড়ে জবাব দিল, না।
রবি বলল, ছেলেটাকে এখনই পৌছে দিতে হবে, ওর বাবা মা দুঃচিন্তা করছে।
"ওকে বরং আমাদের কাছে রেখে দিই।" সুমি হাসতে হাসতে বলল।
"পাগলের মত কথা বলনা, ছেলেটা সকাল থেকে আমাদের এখানে আছে, ওর আত্মীয় স্বজন এখন কত দুঃচিন্তা করছে বুঝতে পারছ?" রবি বলল।
"আজকে দিনটা আমাদের এখানে থাকুক ও, তারপর কাল সকালে পৌছে দেব ওকে।" সুমি বলল।
"তুমি যদি ওর মা বাবার অবস্থাটা বুঝতে পারতে, তাহলে এমন বলতে না।" বলেই রবি শান্তকে নিয়ে রাস্তায় বের হল। সুমি খেলনা গাড়িটা শান্তকে দিয়ে বিদায় জানালো।

রবি অলিতে গলিতে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছেলেটার নানা বাড়ির সন্ধান পেল। বাসাটা একেবারেও বেশি দুরে না, হেটে যেতে বেশি হলে ৮- ১০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু রবির সেটা এত বাড়ির মধ্যে খুজে পেতে অনেক সময় লাগল। শান্তর বাবা মা যখন শান্তকে পেল, তখন কেদে উঠল তারা।

★★

সান্তকে ফিরিয়ে দিয়ে সন্ধ্যার পরে বাসায় আসল রবি।
"ছেলেটার বাবা মাকে পাওয়া গেছে?" সুমি বলল।
-"হ্যা। বাসাটা বেশি দুরে না, হেটেই যাওয়া যায়।"
রবি বলল।
সুমির দুচোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
বলল, বলেছিলাম ছেলেটাকে আমাদের কাছে একদিন রেখে দিতে, তুমি শুনলে না।
রবি সুমির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, দুর বোকা কাঁদার কি আছে, ছেলেটা আমাদের না, অন্য মানুষের। রেখে দিলে তারা কত দুশ্চিন্তায় থাকত।

★★
শুক্রবার দিন। ছুটির দিন।
মোটামুটি খোশ মেজাজে আছে রবি আর সুমি। রবি বলল, শান্তকে দেখতে যাবে?
সুমি হকচকিয়ে বলল, সত্যি, আমাকে তুমি শান্তর কাছে নিয়ে যাবে?
রবি হাসল। বলল, হ্যা।
সুমি আস্তে আস্তে রবির কাছে এগিয়ে আসল। তারপর রবির চুলে আংগুল দিয়ে আচড় কাটল। বলল, তার আগে আমার একটা কাজ আছে।
"কি?" রবি প্রশ্ন করল।
"দোকান থেকে কিছু জিনিস কিনতে হবে।"
"আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আগে দোকানে যাওয়া যাক।"

সুমি আর রবি একটা স্বাধারন দোকানে আসল।
দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট চিপস, কয়েক প্যাকেট জুস, আর কয়েকটা আইসক্রিম কিনল।
সেগুলো নিয়ে শান্তকে দেখতে আসল ওরা।

কলিংবেল চাপল রবি। একজন বৃদ্ধ মানুষ দরজা খুলল। এই বৃদ্ধ মানুষটি হল শান্তর নানা। সেদিন শান্তকে দিতে এসে পরিচয় হয়েছিল। রবি আর সুমিকে ঘরের ভীতরে নিয়ে গেল সে।
সুমি বলল, আমি শান্তকে দেখতে এসেছি।
বৃদ্ধ লোকটি কিছুক্ষন চুপ করে রইল তারপর বলল, কিন্তু শান্ততো গতকাল ওদের বাড়ি চলে গেছে।

★★

বাসায় ফিরে এল রবি আর সুমি।
সুমি শান্তকে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে।
রবি বলল, মন খারাপ করনা, আমাদেরও একদিন সন্তান হবে।
সুমি আপন মনে স্বপ্ন দেখতে লাগল, একটি সন্তানের স্বপ্ন।

(বিঃদ্রঃ গল্পটি সংক্ষেপে আর কোন প্রকার সম্পাদনা ছাড়া লেখার কারনে, অসংগতিপূর্ন আর বানানে ভূল থাকতে পারে । সে জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আশা করছি সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ