একরাত চোরের সাথে

খসড়া ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, সোমবার, ০২:১৩:১৪অপরাহ্ন বিবিধ ২০ মন্তব্য

পুর্বের লেখাটি পড়ুন এখানে :  একদিন হাসির দিন

সারা রাত ট্রেনে জার্নি করে গত সকাল ৭টা ৩০এ রংপুর স্টেশনে এসে নেমেছি। সেখান থেকে গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ি। গত রাতের কথা গত পোস্টে আছে। আজ তারপরের রাতের কথা। আগেই বলেছি আমাদের বাড়িতে এখনও কারেন্ট যায় নাই। ভুল বললাম, শুধু বাড়িতে নয় গ্রামেই কারেন্ট আসে নাই। আমাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। গ্রামে কোন চোর ডাকাত নেই। আছে শুধু গরু চোর। যারা গরু চুরি করে,তারা মুক্তিপনের বিনিময়ে সেই গরু ফেরৎ দেয় । এটা একটা সিন্ডিকেট,এটাও আমাদের গ্রামে খুব কম মানুষের সচেতনতার কারনে।
আমাদের গ্রামের বাড়িটা ইউ সেপের।
আমরা ভাই-বোন মোট আটজন।আর ভাবী দুলাভাই মিলে ষোলজন। ভাইবোনদের অনেকের ছেলে মেয়ের বিয়েশাদি হয়ে একেকটা পরিবার মোটামুটি এক গ্রাম লোকের সমান হয়েছে। আমি যখন বাড়িতে এসে পৌঁছালাম তখনও দুই বোনের তার পরিবারসহ আসা শুধু বাকি আছে। গত রাতের শোয়ার বিভ্রাট আর সারাদিনের অযথা ব্যাস্ততার কারনে মহিলা মহল ( বিশেষ করে বউগুলি) ঘোষণা দিল, --আজ তারা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে।

কথা বলতে তো কেউ কম যায় না, দুই একজন মিন মিন করে যাও একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে সাথে সাথে ঝকঝক করে উত্তর এসেছে--"নবাবের মত তো খালি অর্ডার দাও, একবার আড্ডা দেয়া বাদ দিয়ে রান্নাঘর সামলাও দেখি, শোবার সময়ও তোমাদের নবাবী, আমাদের বাপের বাড়ি গেলে তোমাদের সাথে এই ধরনের আচরণ কেউ করে? নিজেরা বেরাচ্ছে বেড়াতে এসেছে আর আমরা এসেছি কামলা খাটতে।" এই কথা শুনে আমরা আমজনতার মত চুপ করে গেলাম। শুব না শুব না ভেবেও পরে যদি জায়গা না পাই সেই ভয়ে বিছানা দখলের চেষ্টায় চললাম।

যথারীতি আমি আমার পরিবারের সাথে, ওদের মাঝে ঠেলে ঢুকলেই জায়গা হয়ে যায়। বাচ্চাগুলি বড় লক্ষি একেবারে জাপটে ধরে থাকে। আমাদের সাথে আছে জামাই,মেয়ে,ছেলে,ছেলেরবউ, নাতি, নাতনী। আগেই বলেছি দেশের বাইরে অবস্থান করা আমাদের ছেলে মেয়েগুলিও এবারে সব আমাদের সাথে।

সারাদিন হৈচৈ করেই কেটে গেল। ক্লান্তি বিহীন হাহা হিহি করে করে রাতে আমরা খুব ক্লান্ত। আর একটা কারন ,তা হল পুকুরের পানি ছেঁচে সারাদিন কাঁদা ঘেটে মাছ ধরে সবগুলি সত্যিই ত্যানা হয়ে গেছে। বারটার মধ্যে শুয়ে পরেছে সব। সবাই গভীর ঘুমে। আমার ছেলে টয়লেটে যাবে, বউ ঘুম ঘুম চোখে ছেলেকে নিয়ে বাথরুমে গেল। মনে মনে বললাম -বউটা বড় লক্ষি আমাকে ঠেললো না। যদিও জানি বউ আমার একা একা বাইরে টয়লেটে যেতে ভয় পায়।

বউ আমার ঘর থেকে বেড়িয়েই দেখল নারিকেল গাছের নিচে কে যেন? ওদিক দিয়েই টয়লেটে যাবে, তাই বউ এর সাহসের অভাব হল না।
নারিকেল গাছ পার হবার পর তার মনে হলো কে যেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে? ভাবলো আমাদেরই কেউ হয়তো!? আবার খটকা লাগল! তবে আমাকে দেখে লুকালো কেন?
হয়তো বাড়ির কাজের লোকদের দিয়ে কিছু আনিয়েছে বাচ্চারা, ছেলে পেলেরা বড় হয়েছে তারা হয়তো বিড়িটিড়ি খাবে। দাদা/নানা বাড়ির মজা। সব কিছু দেখতে নেই।
কিন্তু ওদেরতো কিছু বলার কথা আমার বউকে দেখে,কারন ওরা তো জানে আমার বউ ভিতুর ডিম! ওদের তো বউকে দেখে আওয়াজ দেয়া বা সামনে আসার কথা? আর বারান্দাতে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে আছে কি জন্যে।? বউ আবার উঁকি দিল- দেখে বাইরের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আর একজন-সন্দেহ হল।
তারপর বউ আমার ঠান্ডা। ছেলেটা ত্রাহি স্বরে 'মা মা' করছে, আর তার মা একটি শব্দতো দূরের কথা একটি চুলও নড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বউটা আমার ভয়ে কি অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি? উঠে দেখতে বেড় হলাম। দেখি বউ দাঁড়িয়ে আছে টয়লেটের দরজার সামনে। মিটমিট করে পাঁচ ও্য়াটের সৌরবাল্ব জ্বলছে টয়লেটে,পিচ্চি প্যান্ট হাতে নিয়ে মাকে ধরে চেঁচাচ্ছে। বুঝলাম বিড়াল দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে পাথর হওয়া আর কি? নড়তে পারছেনা এক চুলও । আমার পিচ্চি কাঁদছে,আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে পিচ্চিকে কোলে নিলাম। বউকে বললাম-- ভিতরের টয়লেটেই তো নিতে পারতে, বাইরে এসেছ কেন? কি দেখেছ? চল, তুমি যে ভয় পাও সেটা তো জানি ডাকলেই পারতে আমাকে বা বুবু/ভাবী। চলৎ ক্ষমতা রহিৎ হয়ে দঁড়িয়ে থাকা বউ আমার গোঁ গোঁ করছে। বলি-- কি হয়েছে ? আমাকে জড়ায় ধরে বলে-- নড়বে না, নড়বে না, চুপচুপ। এত শক্ত করে আমাকে ধরেছে যে পিচ্চিও অবস্থার বেগতিক দেখে শুরু করল চিৎকার।
এবার আমি পেলাম ভয়, কিছু না বুঝেই। এটা বুঝলাম ভয় সংক্রামক রোগ। ভয়ে আমি পারছি না নড়তে বা কোন শব্দ করতে । ভয়ে কাঠ শব্দটার একেবারে সঠিক ব্যবহার করছি ।
ছেলের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেয়ে বউ ফিসফিস করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কি বলবার চেষ্টা করলো কিছুই বুঝলাম না। দাদা/ভাবী দুই ঘর থেকে দুইজনই বেরিয়ে এসে বললো--- কি হয়েছেরে? পিচ্চিকে কোলে টেনে নিয়ে ভাবী বলল-- বাবা কি হয়েছে সোনা ?কোথায় কষ্ট? (আমাদের সবার বাচ্চার বড়মা আমারদের এই ভাবী)।
আমি ফিসফিস করে কিছু বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন শব্দই বের হোল না গলা দিয়ে। না পারলাম এতটুকু হাত,পা,মাথা নাড়াতে।
দাদা তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন “শুভ আর ফিরোজ শুয়ে পর, আর কতক্ষন বারান্দায় থাকবি।
ফিরোজ তার ঘরের বিছানা থেকে বলল “আমরা তো বিছানাতে। ভাইয়াটা কি হয়েছে।”
দাদা বললেন,”তবে বারান্দাতে কে?“
জামাই আমাদের কথা শুনে বের হল ওর ঘর থেকে। জামাইএর ঘরের দরজার পাশেই অন্ধকারে একটা দাঁড়িয়ে। জামাই ওটাকে দেখেই এই কেরে, কেরে, করে ওটাকে জাপটে ধরে চিৎকার শুরু করল-“চোর,চোর” বলে। সবাই হই হই করে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে এল। শুভ,ফিরোজ,জামাই,পলাশ মিলে বারান্দার দু’টাকে জাপটে ধরেছে । আর নারিকেল গাছের পিছনেরটা আমার সমনে দিয়ে দৌড়ানোর সাথে সাথে বিদুৎ খেলে গেল শরীরে,অনেকদিন পরে মনে হল আমি ফুটবল মাঠে পায়ে আমার বল পিছনে প্রতিপক্ষ, দৌড়,দৌড়। এ দৌড়ে জিততেই হবে। ধরলাম ওটাকে। কিন্তু সে পালাল, আমিও পিছনে পিছনে দিলাম ছুট। বাড়ির সবাই জেগে উঠলো, অন্যান্য বাড়ি থেকে সব এসে পরলো। শুভদের হাত থেকে ওই দুই চোরও পালাল। চোরের পিছন পিছন ছুটলো সবাই। আমি তো চোরের সাথে দাড়িয়াবান্দা খেলা শুরু করে দিয়েছি। চোর দাঁড়ায় তো আমিও দাঁড়াই চোর দৌঁড়ায় তো আমিও দৌঁড়াই। সবারই একই আবস্থা। চোর ওদের তারা করলে ওরা পালায় আর চোর দৌঁড়ালে ওরা দৌঁড়ায়। আমার চোর উঠল দেয়ালের উপর আর আমিও চোরের বাম পা ধরলাম চেপে। চোর পা টানে, আমিও ওকে টানি কিছুতেই ছাড়ি না। দাদা চেঁচাচ্ছে-- ছারিস না একটাকে অন্তত আটকা। আমিও প্রাণ দেব কিন্তু পা ছারবোনা পণ করে পা টেনে ধরে রেখেছি।হইহই করে বউ আমাকে সাহায্য করতে চলে এল, সংগে আরও কয়েকজন। বেগতিক দেখে চোর অন্য পা দিয়ে দিল এক লাথি আমার নাকে। চোরের পা ছেরে এবারে আমার নাক ধরার পালা। চোরতো পালাল, আর আমি নাক চেপে ধরে ‘আমার নাক, আমার নাক বলে কান্না শুরু করলাম। বাড়ির মহিলারা আমার নাক নিয়ে পরল। বউ এসে বলল "তুমি কেন চোরের পা ধরে মাপ চাইতে গেলে। চোর তো বার বার বলছিলো--- আমি মাপ করে দিয়েছি এবার পা ছাড়ুন।“ আমি কটমট করে ওর দিকে তাকাতেই চোখের সামনে থেকে নিরাপদ দূরে সরে গেল।
আর এদিকে মেজ দুলাভাই প্রথম থেকেই দরজা চেপে ধরে চিৎকার করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীন ভাবে “চোর চোর!!!!।“ চোর যেন তার ঘরে ঢুকতে না পারে তাই তিনি দরজা ঠেসে ধরে আছেন।

গ্রামবাসী চারটা চোরকেই ধরেছে। চোরগুলি ধরা পরবার পর দুলাভাই কে বললাম-- আর চোর,চোর চিৎকার করতে হবে না । চোর সবগুলিই ধরা পরেছে।---দুলাভাই চোখ পিটপিট করে আমাদের বলল “তোমরা এই ঘরে ঢুকলে কোন দিক দিয়ে?।“
তখন তিনি খেয়াল করলেন যে তিনি ঘরের দরজা নয় কাঠের আলমারি চেপে ধরে চিৎকার করছিলেন। এবার সবাই চোর ছেড়ে দুলাভাই কে নিয়ে পরল।
পিচ্চিগুলি রাতের তান্ডবে ভয় পেলেও পরদিন তারা চোর দেখে হতাশ হল। এরা চোর কেন? ওদের নাম চোর কেন? ওদের মা কোথায়? ওরা বাঁধা কেন? এত এত প্রশ্নবাণে জর্জরিত দাদা/ভাবী আদেশ দিলেন ---এই চোরগুলিকে ভাত খাইয়ে ৫০টা করে টাকা দিয়ে বিদায় কর। হাজার হলেও আজ ঈদ। ভাবী বললো এই চোর কোরবানীর মাংস নিয়ে যাস।
ওরা যাবার সময় বলে গেল ,লোভে পড়ে এসেছিল। ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে এসেছে তাই শুনে। ওরা আসলে চোর না।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ