পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট সুন্দর এই শহরে আমার বাস। যা পরে আমাদের শহর হয়ে গিয়েছিল। নীল সমুদ্র, আর পাহাড় এর কোল ঘেসে রাশিয়ার এই ছোট্ট শহরটির নাম আশা। নাদিয়া তাকাসকোভার ছিপছিপে লম্বু নানির বর ছিল বাংগালী, নানির কাছে শুনেছি আশা শব্দটি বাংলা ভাষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসংগে পরে আসি।
18424091_1093956387376105_3356961457472638515_n-320x200
সামারের সেই দিনে অন্যান্য দিনের মত বিকেল পাঁচটার পরে এই ক্যামোমাইল ফুলের মাঝে শুয়েছিলাম আমি। সময় পেলেই এখানে এসে শুয়ে পরি বাই সাইকেল স্ট্যান্ড করে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বোধ হয়। হঠাৎ মুখের উপর কেমন গরম নিঃশ্বাস, এক ভিন্ন ধরনের সুঘ্রাণের মাঝে চোখ মেলে তাকাই, দেখি অনিন্দ সুন্দর এক উদ্বিগ্ন মুখ।
এই যে মিস্টার বেঁচে আছো তুমি?
ঘুম থেকে জেগে ফুলের মাঝে এমন সুন্দর মুখ দেখে কিছুটা বোকা বোকা হয়ে বলি, হ্যা বেঁচে আছি। কিন্তু তুমি কে?
= আমি নাদিয়া তাকাসকোভা। আমার সাইকেলের চেইন ছিড়ে গিয়েছে। ওই যে আমার সাইকেল পড়ে আছে। আমার কিছু জরুরী কাজ আছে, আমি তোমার সাইকেলটা নিয়ে গেলাম। আমি তোমাকে জানি, তুমি জিসান ভ্লাদিমির।
* আরে আমার সাইকেল নিয়ে যাবে মানে? আমি যাব কিভাবে?
= আমি তো তোমার অনুমতি নিয়েই নিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোমাকে বলে নিয়ে যাচ্ছি।
বলার সাথে সাথে সাইকেলে উঠে প্যাডেল চাপ। ধড়ফড় করে উঠতে উঠতেই সে ২০ মিটার দূরে। দৌড় লাগালাম,
* আমি তো তোমাকে অনুমতি দেইনি, তুমি এভাবে নিতে পারো না।
= আচ্ছা তুমি আরো এক ঘন্টা ঘুমাও, আমি এসে তোমার সাইকেল দিয়ে যাব, আগে আমার কাজটা হোক।
সাইকেল আর আমার দুরত্ব তখন ১০০ মিটার। এ কেমন মেয়েরে বাবা! হাসতে হাসতে ছিনতাই করে নিয়ে গেল আমার সাইকেল!
কি করবো আমি? নাদিয়ার সাইকেল এর দিকে তাকালাম, চেইন ছিড়ে আছে। বসে শুয়ে সময় কাটাচ্ছি আর আর ঘড়ি দেখছি। আসবে তো এক ঘন্টা পর?

দূরে সাইকেলের টুং টাং আওয়াজ। আমার দিকে তাকিয়েই বাম হাত উচু করে দিয়ে হাসি। লাল সাদা ড্রেস, সোনালী চুল এ অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তাকে। পরে জেনেছি লাল রঙ তার প্রিয়। কাছে এসেই-
= কি বলেছিলাম না এক ঘন্টার মধ্যে আসব? বিশ্বাস হল তো? তোমাকে মরার মত ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম। তোমার ঘুম এক ঘন্টার আগে ভাংতো বলে মনে হয়না। আমি না বলে নিয়ে গিয়ে আবার তোমার সাইকেল এখানে রেখে চলে গেলে তুমি তো বুঝতেই পারতে না আমি তোমার সাইকেল নিয়েছি। কিন্তু আমি অনুমতি নেয়ার জন্যই তো তোমাকে জাগালাম। না জাগালে একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে পরিচয় হত তোমার বলো? এখন আমাকে ধন্যবাদ দাও 🙂
* সুন্দরী মেয়ে! কার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তুমি? আর ধন্যবাদ কেন?
= আমাকে কি তোমার সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে না? আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম না তোমাকে? ধরো আমার মত একটা সুন্দরীর সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, তুমি কি আমাকে ধন্যবাদ দিতে না? সে ধন্যবাদ দাও আমাকে।
* আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি, ধন্যবাদ তোমাকে।
= হুম, চলো এবার, আমার সাইকেল তুমি নাও, আমি সাইকেল হাতে নিয়ে যেতে পারিনা। একটু দূরে গেলেই তাও পাহাড়ের ঢালু রাস্তা, তখন তুমি সাইকেলে বসেই যেতে পারবে 🙂
কথার সাথে মুখের যে হাসি, তাতে তাকে উপেক্ষা করার মত শক্তি আমার ছিল না।

নাদিয়ার সাথে পরিচয়টা এমন ভাবেই হয়েছিল। পরিচয়ের পরে বন্ধুত্ব এরপর প্রেম। স্বপ্নের মত দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিল। ওর নানি ছিল আর এক মজার মানুষ। জীবনের কঠোরতার মাঝেও তিনি সারাক্ষণ হাসি মুখে লেপটে থাকত। নাদিয়া আর আমার মাঝের টুকটাক মান অভিমান তিনিই ঠিক করে দিতেন।

তবে বছরে তিন চার বার তুমুল ঝগড়া হতো আমার আর নাদিয়ার। কতবার যে দুজনে দুজনকে ছেড়ে চলে গিয়েছি। একঘন্টার মধ্যে দুজনেই বুঝতাম, রাগের মোম গলে শেষ। তার বাসার সামনে আমার সাইকেলের চেইন পড়ে যেত দিনে কমপক্ষে ছয় সাতবার। আবার আমার বাসার দরজার সামনেই কে জানি ক্যামোমাইল ফুল রেখে যেতো। মাঝে মাঝে আমার সাইকেলের চাইন পড়েছে দেখে এগিয়ে এসে বলতো ' চেইন এত পড়ে কেন? চেইনের একটি ঘাট ফেলে দিয়ে চেইন আটকান, চেইন টাইট হলে আর পড়বে না।' আমি তো এমনই চাইছিলাম সে কিছু বলুক। এরপর কথায় কথায় আমরা ভুলে যেতাম আমাদের গতকাল কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল।
অথবা আমার বাসার দরজার সামনে ফুলের তোড়া নিয়ে চলে যেতাম তার বাসায়। জিজ্ঞেস করতাম, আপনি কি জানেন এই ফুল কে রেখে গিয়েছে আমার বাসার সামনে?
আমি কিভাবে জানবো? দেখেন হয়ত আপনার কোন মেয়ে অনুরাগী রেখে গিয়েছে কিনা? আপনার চারপাশে তো মেয়ের সমাহার।
এভাবে কথায় কথায় সময় বয়ে যেতো, আমরা ভুলে যেতাম ঝগড়া বিবাদ। বুড়ি নানি হেসে হেসে বলতো, একজনে অন্যজনকে ছেড়ে থাকতে পারো না, তাহলে ঝগড়া কেন করো? আসলে ঝগড়ার পরে কিছু একটি দিয়ে কথা শুরু করলেই হলো, সব মান অভিমানের ইতি।
তবে শেষবারের ঝগড়াটা ছিল ভয়াবহ এবং আমি আতংকিত হয়ে পরেছিলাম। এমন শীতল উচ্চারনে সে কখনো কথা বলেনি।
'আমি তোমার সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি জিসান।'
আমি জানি সে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবে না। আমিও পারবো না। সে একদিন পরেই ফুল দিয়ে যায় বাসার দরজার সামনে। আমিও যাই তার বাসার সামনে চেইন পড়া সাইকেল নিয়ে। সে বের হয়না, আমিও ফুলের তোড়া নিয়ে যাই না তার কাছে। অবশেষে নানিকে বলি' নানি আমার গন্তব্যে পৌছার যে পথ, সে পথই উধাও হয়ে গিয়েছে নিজে নিজে। গন্তব্যে যাব কিভাবে?
'পথ হারায়নি, খুঁজে নাও পথ। পথ তোমাকে কেউ খুঁজে দেবেনা' নানির জবাব।
' নানি, আমরা দুজনে গড়েছি স্বপ্নের কাঁচের ঘর, অথচ দুজনের হাতেই ইটের টুকরো, কেন আমরা এমন?'
' কাঁচের ঘর তো ভাল, পাথরের ঘর বানালেও হাতে যদি পাথর থাকে, তবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে, কেন করো তোমরা এমন? নাদিয়া কষ্ট পাচ্ছে, তুমি কষ্ট পাচ্ছ, আর আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছ দুজনে। যাও নাদিয়ার কাছে। মন খারাপ করে বেহালা বাজাচ্ছে।'

নাদিয়া উইল ইউ মেরী মি?
ইয়েস 🙂

___________
আশা
৩১ মে ১৮১৩ ইং

======================

আমি আমি না, আমি সে ও না-পর্ব ৬

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ