অবিনাশী মন

মুহাম্মদ শামসুল ইকরাম পিরু ২৮ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ০৯:৫৮:২৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

আমাদের এলাকায় ১৯৭১ এ পাক হানাদার বাহিনী এসেছিল ২৭ এপ্রিল। আব্বা এবং বড় পাঁচ ভাই আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা কর্মী ছিলেন।৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ' তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ......... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ' - এই ডাকা উজ্জীবিত হয়ে তৎকালীন থানার মাঠ, বর্তমানে মিনি স্টেডিয়ামে প্রতিদিন বিকেলে মুক্তিপাগল জনতার প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়।শতশত জনতা বন্দুক, বাঁশের লাঠি, তীর ধনুক, তলোয়ার, হাতে বানানো অন্যন্য দেশী হাতিয়ার নিয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহন করতো। প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত ডামি রাইফেল এবং কুচকাওয়াজের জন্য ব্যান্ড এর ড্রাম, বিউগল ইত্যাদি আমাদের বাসায় রাখা হতো। আব্বা আওয়ামীলীগ এবং বড় পাঁচ ভাই ছাত্রলীগের অত্যন্ত সক্রিয় নেতা কর্মী ছিলেন।

পাক সেনাদের আক্রমন অবধারিত ভেবে আমরা সবাই শহরের পশ্চিমে প্রবাহিত ছোট্ট বাসন্ডা নদীর ওপারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। শহরের বাসা ব্যবহৃত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কাজে। ২৭ এপ্রিল আমাদের শহরে পাক হানাদার বাহিনী এসে শহরের প্রায় ৮০ ভাগ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়। রাতে আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি হতেও হেটে রিফিউজির মত শত শত মানুষের সাথে দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বড়িতে আশ্রয় নেই। এরপর নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায়ই আশ্রয়স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। শহরের আমাদের বাসা ভেঙ্গে স্থানীয় শান্তি কমিটি এবং রাজকারদের মধ্যে আটভাগ করে দেয়া হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, অন্য আর একটি রাজাকাররা ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল

শহরের যেহেতু থাকার কোনো বাড়ি নেই, স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতার পরেও ৭৪ সন পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল আমাদের। গ্রাম হলেও ওটা পৌরসভারই একটি অংশ।

৭২- ৭৪ এই তিন বছরে গ্রামে থাকায় সম বয়সী আত্মীয় এবং আশে পাশের কয়েকজনের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। চাচাত ভাই দুলাল, বাড়ি সংলগ্ন যাদুর ছেলে (আব্বার বড় চাচাতো ভাইকে যাদু ডাকতাম) মোজাম্মেল, পাশের বাড়ির নবাব, আয়নাল, আফজাল সহ বেশ বড় একটি নিবিড় বন্ধুত্বের বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। স্কুল এর সময়টি বাদ দিয়ে প্রায় সারাক্ষণই বিভিন্ন খেলাধুলা, আড্ডায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মাতোয়ারা থাকতাম।

নবাব একদিন হঠাৎ করেই মোজাম্মেলকে দেখে গানের সুরে বলা আরম্ভ করলো ' হালিমুইন্না তিন কুইন্যা রুন্নি ভাজা।' এর অর্থ কি তা আমরা জানিনা না, যে বলেছে সেই নবাবও জানে না। তবে বলার সুর আমাদের সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। আমরাও মোজাম্মেলের চারদিকে ঘুরে ঘুরে এটি বলা শুরু করলাম। প্রথম প্রথম মোজাম্মেল এটিকে উপভোগই করতো। কিন্তু ওকে দেখলেই আমরা এটা বলতামই বলতাম একাধিকবার। ক্রমে এই কথা শুনতে শুনতে মোজাম্মেলের মন খারাপ হতে শুরু করলো। এরপর মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতো। আমরাও দিগুন উৎসাহে এটি আরো বেশি বেশি বলতাম। ওরা কান্না দেখে মজা পেতাম। একটি সময়ে মোজাম্মেল আমাদের এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলো। আমি অবাক হতাম এতে মন খারাপের কি আছে!!

আমার বিদ্যালয় জীবনের ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস বন্ধু মাসুদ হঠাত আমাকে ডাকা শুরু করলো ' গদাই লস্কর।' ওর দেখা দেখি প্রায় সবাই গদাই লস্কর ডাকা শুরু করলো। এর অর্থ কি তা মাসুদ সহ আমরা কেউই জানতাম না। আমাকে দেখে সবাই এই নামেই ডাকা শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার খারাপ লাগা শুরু হলো। এক সময় এই ডাক শুনলেই প্রচন্ড অপমানিত হতে শুরু করলাম। আমার মুখ রাগে ক্ষোভে হতাশায় লাল হয়ে যেতো। চোখে পানি টলটল করতো। অন্যরা বিপুল উৎসাহে মুখের কাছে মুখ এনে বলতো- এই দেখ দেখ গদাই লস্কর কান্দে।

ইচ্ছে হতো ওদের হাত পা কেটে বোম্বাই মরিচ, লবন লাগিয়ে দেই। আচ্ছা মত দা দিয়ে কুপিয়ে এদের মেরে ফেললে শান্তি পেতাম- এমন অবস্থা হতো আমার মনের ওই ডাক শুনে। বুঝতে পারতাম যে মোজাম্মেলও তো আমার মত কষ্টে জর্জরিত হয়েছে ওকে যখন বলতাম আমরা। গদাই লস্কর ডাক শুনলেই আমার মধ্যে যে ক্রোধ জমা হতো তা লিখে প্রকাশ করতে অক্ষম আমি।

এই বড় বেলায়ও কি কিছু কিছু শব্দ শুনলে আমার এমন ক্রোধ হয়? হ্যা হয়।বিভিন্ন শব্দের অর্থ এবং প্রয়োগ যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই সেই সমস্ত শব্দ আমার ব্রেইনে তীব্র ভাবে দহনের সৃষ্টি করে। ইচ্ছে করে তাদের মাংশ দিয়ে বারবিকিউ করে কুকুরকে খাইয়ে দেই।তাঁর আগে শরীর থেকে মাংশ খুলে নেয়ার সময় দুই হাতে আচ্ছামতো কাঁটা মাংসে বোম্বাই মরিচ, লবন ডলে দেই।

কি সেই শব্দ?
কাপুরুষ,
অমানুষ,
মিথ্যুক,

সময়ে মানুষ পাল্টায়, অনেক চিন্তা ভাবনা বিনাশ হয়।তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুভূতি অবিনাশীই থেকে যায়।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ