আমাদের এলাকায় ১৯৭১ এ পাক হানাদার বাহিনী এসেছিল ২৭ এপ্রিল। আব্বা এবং বড় পাঁচ ভাই আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা কর্মী ছিলেন।৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ' তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ......... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ' - এই ডাকা উজ্জীবিত হয়ে তৎকালীন থানার মাঠ, বর্তমানে মিনি স্টেডিয়ামে প্রতিদিন বিকেলে মুক্তিপাগল জনতার প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়।শতশত জনতা বন্দুক, বাঁশের লাঠি, তীর ধনুক, তলোয়ার, হাতে বানানো অন্যন্য দেশী হাতিয়ার নিয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহন করতো। প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত ডামি রাইফেল এবং কুচকাওয়াজের জন্য ব্যান্ড এর ড্রাম, বিউগল ইত্যাদি আমাদের বাসায় রাখা হতো। আব্বা আওয়ামীলীগ এবং বড় পাঁচ ভাই ছাত্রলীগের অত্যন্ত সক্রিয় নেতা কর্মী ছিলেন।
পাক সেনাদের আক্রমন অবধারিত ভেবে আমরা সবাই শহরের পশ্চিমে প্রবাহিত ছোট্ট বাসন্ডা নদীর ওপারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। শহরের বাসা ব্যবহৃত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কাজে। ২৭ এপ্রিল আমাদের শহরে পাক হানাদার বাহিনী এসে শহরের প্রায় ৮০ ভাগ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়। রাতে আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি হতেও হেটে রিফিউজির মত শত শত মানুষের সাথে দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বড়িতে আশ্রয় নেই। এরপর নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায়ই আশ্রয়স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। শহরের আমাদের বাসা ভেঙ্গে স্থানীয় শান্তি কমিটি এবং রাজকারদের মধ্যে আটভাগ করে দেয়া হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, অন্য আর একটি রাজাকাররা ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল
শহরের যেহেতু থাকার কোনো বাড়ি নেই, স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতার পরেও ৭৪ সন পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল আমাদের। গ্রাম হলেও ওটা পৌরসভারই একটি অংশ।
৭২- ৭৪ এই তিন বছরে গ্রামে থাকায় সম বয়সী আত্মীয় এবং আশে পাশের কয়েকজনের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। চাচাত ভাই দুলাল, বাড়ি সংলগ্ন যাদুর ছেলে (আব্বার বড় চাচাতো ভাইকে যাদু ডাকতাম) মোজাম্মেল, পাশের বাড়ির নবাব, আয়নাল, আফজাল সহ বেশ বড় একটি নিবিড় বন্ধুত্বের বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। স্কুল এর সময়টি বাদ দিয়ে প্রায় সারাক্ষণই বিভিন্ন খেলাধুলা, আড্ডায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মাতোয়ারা থাকতাম।
নবাব একদিন হঠাৎ করেই মোজাম্মেলকে দেখে গানের সুরে বলা আরম্ভ করলো ' হালিমুইন্না তিন কুইন্যা রুন্নি ভাজা।' এর অর্থ কি তা আমরা জানিনা না, যে বলেছে সেই নবাবও জানে না। তবে বলার সুর আমাদের সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। আমরাও মোজাম্মেলের চারদিকে ঘুরে ঘুরে এটি বলা শুরু করলাম। প্রথম প্রথম মোজাম্মেল এটিকে উপভোগই করতো। কিন্তু ওকে দেখলেই আমরা এটা বলতামই বলতাম একাধিকবার। ক্রমে এই কথা শুনতে শুনতে মোজাম্মেলের মন খারাপ হতে শুরু করলো। এরপর মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতো। আমরাও দিগুন উৎসাহে এটি আরো বেশি বেশি বলতাম। ওরা কান্না দেখে মজা পেতাম। একটি সময়ে মোজাম্মেল আমাদের এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলো। আমি অবাক হতাম এতে মন খারাপের কি আছে!!
আমার বিদ্যালয় জীবনের ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস বন্ধু মাসুদ হঠাত আমাকে ডাকা শুরু করলো ' গদাই লস্কর।' ওর দেখা দেখি প্রায় সবাই গদাই লস্কর ডাকা শুরু করলো। এর অর্থ কি তা মাসুদ সহ আমরা কেউই জানতাম না। আমাকে দেখে সবাই এই নামেই ডাকা শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার খারাপ লাগা শুরু হলো। এক সময় এই ডাক শুনলেই প্রচন্ড অপমানিত হতে শুরু করলাম। আমার মুখ রাগে ক্ষোভে হতাশায় লাল হয়ে যেতো। চোখে পানি টলটল করতো। অন্যরা বিপুল উৎসাহে মুখের কাছে মুখ এনে বলতো- এই দেখ দেখ গদাই লস্কর কান্দে।
ইচ্ছে হতো ওদের হাত পা কেটে বোম্বাই মরিচ, লবন লাগিয়ে দেই। আচ্ছা মত দা দিয়ে কুপিয়ে এদের মেরে ফেললে শান্তি পেতাম- এমন অবস্থা হতো আমার মনের ওই ডাক শুনে। বুঝতে পারতাম যে মোজাম্মেলও তো আমার মত কষ্টে জর্জরিত হয়েছে ওকে যখন বলতাম আমরা। গদাই লস্কর ডাক শুনলেই আমার মধ্যে যে ক্রোধ জমা হতো তা লিখে প্রকাশ করতে অক্ষম আমি।
এই বড় বেলায়ও কি কিছু কিছু শব্দ শুনলে আমার এমন ক্রোধ হয়? হ্যা হয়।বিভিন্ন শব্দের অর্থ এবং প্রয়োগ যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই সেই সমস্ত শব্দ আমার ব্রেইনে তীব্র ভাবে দহনের সৃষ্টি করে। ইচ্ছে করে তাদের মাংশ দিয়ে বারবিকিউ করে কুকুরকে খাইয়ে দেই।তাঁর আগে শরীর থেকে মাংশ খুলে নেয়ার সময় দুই হাতে আচ্ছামতো কাঁটা মাংসে বোম্বাই মরিচ, লবন ডলে দেই।
কি সেই শব্দ?
কাপুরুষ,
অমানুষ,
মিথ্যুক,
সময়ে মানুষ পাল্টায়, অনেক চিন্তা ভাবনা বিনাশ হয়।তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুভূতি অবিনাশীই থেকে যায়।
২০টি মন্তব্য
তৌহিদ
আমি যা নই সেসব শব্দ ব্যবহার করে কেউ আমাকে ডাকলে রাগ হয় বৈকি! ইয়ার্কি করে বন্ধুরা অনেক সময় অনেক নামে ডাকে কিন্তু একটা লিমিট ক্রস করলেই তা মন খারাপের কারন হয়ে দাঁড়ায় একসময়। আপনার ক্ষেত্রে এবং আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
আপনার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছেন। লক্ষ মানুষের এই ত্যাগই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। শ্রদ্ধা জানাই আপনাদের।
শুভকামনা ভাই।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা, যা নই সেসব বললে অবশ্যই রাগ লাগে।
আপনার আব্বাও বীর মুক্তিযোদ্ধা, ওনার প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইজান।
রেজওয়ানা কবির
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুখে আর পড়ে জানা। সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই সম্মান। আপনার পরিবারের সবার এই অবদান সত্যি অতুলনীয়। ভালো থাকবেন ভাইয়া। শুভকামনা ।
জিসান শা ইকরাম
আপনার জন্য শুভ কামনা,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনাদের পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ অনস্বীকার্য॥ পাছে লোকে কতকিছুই বলে। রাগ হয় জেদ হয় কুটিকুটি করতে ইচ্ছে করে।
তারপরও বলি, কিছু লোক বলার জন্যই। তাদের কাজই বলা আপনাকে ডিস্টার্ব করা। ভেউ ভেউ এ মজা নেয়া শিখতে হবে। তা না হলে ভালো থাকা যাবে না।
শুভ কামনা ভাই।🌹🌹
জিসান শা ইকরাম
অন্যকে আঘাত করে এমনি ভাবে ইচ্ছাকৃত বলা কোন ভাবেই উচিৎ না।
এ বিষয়ে বারবার শতর্ক করার পরেও বলা একধরনের সাইকোরা এসব করে।
শুভ কামনা।
পপি তালুকদার
পরিবারের সকল সদস্যদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল।কিছু লোক নিজের মতো করে সব ভাবে তাতে কান দিতে নেই।নিজে কি, কি করতে চাই সেই ভাবে কাজ করে যাওয়া টাই বুদ্ধিমানের কাজ।সময় সব ঠিক করে দেয়।ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভ কামনা।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
ঐ শব্দগুলির তীব্রতা বুঝার অনুভূতি যদি শব্দগুলির থাকতো
আমার মনে হয় লজ্জা ঢাকতে একদিন সকলের
অগোচরে অভিধান থেকে হারিয়ে যেত।
ভীষণ মুগ্ধতায় শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রেখে গেলাম অন্তহীণ।
সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
নিরন্তর শুভ কামনা আপনার জন্য।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
স্মৃতি সতত সুন্দর এবং মধুর।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
অনেকদিন পরে আপনাকে সোনেলায় দেখে খুবই ভালো লাগছে।
নিয়মিত লিখুন।
শুভ কামনা।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইয়া, দোয়া করবেন। শুভ কামনা অবিরাম।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মুক্তিযুদ্ধে আপনার পুরো পরিবারের অবদান অবিস্মরণীয়। জেনে খুব ভাল লাগলো দাদা ভাই। সবার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো। একটা বিষয় বারবার উচ্চারিত হলে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা যত ভালো হোক খারাপ হোক এটা আমার মতামত। সবকিছুরই মার্জিন থাকা দরকার। ঢোল বেশি বাজালে ফেটে যাবেই । অনেক অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম। বিষয়টি অন্যরকম ছিল বলে খুব ভালো লাগলো লেখাটি।
আশা করি সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছেন। নিরন্তর শুভকামনা রইলো। শুভ রাত্রি
জিসান শা ইকরাম
মার্জিন অতিক্রম করা কোনো ভাবেই উচিৎ না।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
মুক্তিযুদ্ধের অবদান আপনাদের পরিবারের, এটা আমি জেনেছিলাম বন্যা ফুপি পোস্ট থেকে।
তবে, আমাকে এরকম অন্য নামে ডাকলে, ওর গালে চড় বসায় দেই। যেটা দেখে বন্ধুরা সাহস পায় না। এমন নামও নেই।
জিসান শা ইকরাম
আমি চর দিতে পারিনা, এখানেই সমস্যা। তবে ইচ্ছে হয় এদের গায়ের চামড়া ছিলে লবন মাখিয়ে দেই।
ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
স্বপ্ন নীলা
আপনার লেখাটি সময় নিয়ে এবং ভীষণ যত্ম নিয়ে পড়লাম। এ কি লিখেছেন আপনি !! এই এতটুকু লেখাতে যেন উপন্যাস তৈরি করে ফেলেছেন। আমি এই লেখার ভেতর ডুব দিয়ে যেন সেই মুক্তিযুদ্ধের যন্ত্রনাকর দিনগুলোই দেখতে পাচ্ছিলাম–এমন অন্তর দিয়ে এখন আর তেমন কেউ লেখে না।
মুক্তিযুদ্ধে আপনার পরিবারের যে অবদান তার জন্য শ্রদ্ধাসহ স্যালুট জনাই। যতটুকু পরে আমার কাছে মনে হয়েছে যে খালুজানের অবদান এখানে সবচেয়ে বেশি। কারণ খালুজান লিডারশীপে থাকার কারণেই ভাইয়েরা উৎসাহিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে— এখানে একটি কথা বলতেই হবে যে সেই সময়ে খালাম্মার অবদানকে কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যাবেই না। আমার মন বলছে যে খালাম্মাই তার পুত্রদেরকে মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে পেছন হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং সেইসাথে মনের ভেতর অনেক টেনশনও নিয়েছেন তিনি–খালাম্মাকে আমি একটা স্যালুট দিবই দিব —
অনেক কষ্ট করেছেন সেই ছোট বেলায়—আমাদেরকে অতীত হতে শিক্ষা নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একই ধরণের কষ্টকর কথা বলে কাউকে বুলিং করলে সেই শিশুতো কষ্ট পাবেই— এই বুলিংও এক ধরণের নির্যাতন। এইযে আপনি সেই ছোট্ট বেলাতেই অন্যের কষ্টগুলো বুঝতে পারতেন এটার ভেতর সমানুভূতি লুকিয়ে আছে। আপনার এই লেখা হতে আমি স্বার্থপরের মত অনেক কিছুই শিখে নিলাম। শুভকামনা রইল নিরন্তর
জিসান শা ইকরাম
দেশে খুব কম পরিবারই আছে, যে পরিবারের চার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা।
ভবিষ্যতে এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছে আছে।
মন্তব্য দিতে এসে তো পোষ্ট সমান মন্তব্য করলেন। এত সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম।
সোনেলায় নিয়মিত আসছেন বলে অত্যন্ত ভালো লাগছে।
নিয়মিত আসুন এখানে, আপনার লেখার মাঝে অনেক কিছু শেখার আছে।
সর্বদা সুস্থ থাকুন।
শুভ কামনা।