
ঘরে একমাত্র নাতি প্রিন্স।বয়স অনুমানিক ছয় সাত বছর।নানাকে ছাড়া একদন্ড তার ভালো লাগতো না।নানাও নাতিকে খুব ভালবাসতেন,আদর করতেন।সারাদিন ব্যবসায়ীক কর্মকান্ড সেরে যতটুকু সময় পেতেন ঘরে ফিরে গিয়ে শুধু নাতিকেই সঙ্গ দিতেন।নাতির হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যে হিমসিম খেয়ে যেতেন।নানা এ বিষয়টা খুব এনজয় করতেন কারন ব্যক্তি জীবনে সূচিবায়ুওয়ালা এই নানা তার ব্যবসায়ীক স্থান ছাড়া আর কোথাও সময় ব্যায় করতেন না।অনেক ব্যবসায়ীক নাইটক্লাব,বন্ধু বান্ধব সহ দেশ বিদেশ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন,জীবনকে উপভোগ করছেন।একমাত্র প্রিন্সের নানা আফজাল সাহেব এর ব্যাতিক্রম।যিনি জীবনের সবটুকু সময় তার ব্যাবসাস্থলে দিয়েছেন যা এখনো তাই করে যাচ্ছেন।
স্বাধীনের পরবর্তী সময় আশির দশকে ব্যবসা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত ব্যবসাকে তেমন একটা লাভজনক স্থানে নিয়ে যেতে পারেননি।মানুষের প্রতি অঘাত বিশ্বাস তার ব্যবসার জন্য কাল হয়ে যায়।বিশ্বাস ঘাতক কর্মকর্তাদের কারনে বহুবার ব্যবসায় ধষ নামে আবারো আল্লাহর অসীম কৃপায় ব্যবসা দাড়িয়ে যায়।তারপরও বিপর্যয় কাটেনি।প্রচুর দেনায় ন্যুয়ে পড়েছে তার ঘার।এরমধ্যে চলে এলো কাল নাগিনী ভাইরাস “করোনা”।যা পুরো পৃথিবী-পৃথিবীর মানুষের জীবন যাপনকে উলোটপালোট করে দেয়।
প্রিন্সের মা রান্নাঘরে কাজের মেয়েকে রান্নায় সহযোগীতা করছেন।প্রিন্স এ যাবৎ কখনোই রান্না ঘরে যায়নি কিন্তু আজ গেলো।নানাকে কয়েকদিন দেখতে না পেয়ে হাফিয়ে উঠেছিলো সে তাই তার মাকে না জিজ্ঞাসা করে আর থাকতে পারলো না।কাজের অবস্থায়ই প্রিন্সকে রান্না ঘরের আসতে দেখে মা বললেন।
-কী হয়েছে? তুমি এখানে আসছো কেন?
-আমি জানতে চাচ্চি নানুজি কোথায়?তোমাকে যতবারই বলি, তুমি বলো এইতো কাল আসবে!!অথচ নানা আর আসে না!!তুমি-মিথ্যে বলছো নাতো ?
শিশুমনের এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বলবেন মা!সত্যিইতো তাকে আর কত বার মিথ্যে বলবে।সত্যতো একদিন প্রকাশ পাবেই।তার কথা শুনে মা হাতের কাজ রেখে দৌড়ে তাকে বুকে চেপে ধরে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু ঝরালেন।কিছুক্ষণ বুকে রেখে তার আড়ালেই একহাতে নিজের চোখের জলমুছে ছেলের মুখোমুখি হয়ে বললেন।
-মিথ্যে নয় বাবা,সত্যিই তোমার নানু ফিরে আসবেন।
-তাহলে আসছে না কেন?কী হয়েছে নানুজির?
ঠিক সেসময় মোবাইল ফোনে রিং বেজে উঠে।রান্না ঘরেই মোবাইলটা ছিলো।মোবাইলের সামনে রিসিভ করতে গেলেন।তার বুক ধরফর করতে থাকে।ছোট ভাইয়ের ফোন!না-জানি কোন খবর আসে!কাপা হাতে ফোনটি কানে লাগিয়ে কাপা ঠোটে হ্যালো বললেন।
-হ্যালো, কী অবস্থা এখন? আব্বু জেগে আছেতো?
-জেগে আছে তবে,
-তবে কি?
-না ভয়ের কিছু নেই, ডাক্তার বললো ঢাকায় নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।
-তাহলে তাই করো ভাই ।
-না,দেখি ডাক্তাররা কালকে ফাইনাল ডিসিসন দিবেন বলেছেন-তুমি টেনসন করো না সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ্।
প্রিন্স তার মায়ের কাছে আসে।মা কে বলল-
-কার সাথে কথা বলছো মা? মামার সাথে?
-হুম
-আমাকে দাও আমিও কথা বলবো।
ফোনটা কানে লাগিয়েই মামাকে নানার কথা জিজ্ঞাসা করে।মা আর মামার কথপোকথনে ততক্ষণে প্রিন্স নানু না ফিরে আসার ঘটনাটা বুঝে ফেলে।
-নানুজি এখন কোথায়? নানুজিকে একটু দাওনা আমি কথা বলবো?
-না,মামা। তোমার নানুজি এখন ঘুমাচ্ছে এখন কথা বলা যাবে না।তুমি টেনসন করোনা তোমার নানুজিকে নিয়ে কালকেই বাসায় চলে আসবো।
-সত্যি বলছো?তিন সত্যি বলো?
-হুম তিন সত্যি।দাও ফোনটা মাকে দাও।
-হ্যালো দেখা যাক আল্লাহ ভরসা।আর তুমি দুলাভাইকে বলে রেখো ঢাকা নিতে হলে কোন হাসপাতালে নেবো সব ব্যবস্থা যেনো সে করে রাখে।রাখছি।ডাক্তার ডাকছেন।
ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলেন সায়মন।ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন,বাহির থেকে করে আনতে।সায়মন বাহির যাওয়ার গেইটে এসে অনেক লোকের ঝটলা দেখলেন।লোকজনের ভীরের মাঝে এক বেওয়ারিশ মায়ের লাশ পড়ে আছে।লোকজনের কাছ থেকে সায়মন জানতে পারলো- এ লাশটি নিতে অনেকক্ষণ হলো কেউ আসেনি বা করোনায় মারা যাওয়া এ লাশটির কোন আত্মীওস্বজন এখনো খুজে পাওয়া যায়নি।
সায়মনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো-ভাবছেন-এ কি করে সম্ভব! তারওতো কোন না কোন ছেলে মেয়ে আছে ।নিজ সন্তানরা এতোটা পাষাণ হয় কি করে!!।হয়,এ করোনাকালে এমন অসংখ্য অমানবিক ঘটনা ঘটছে।
সায়মন একটি প্যাথলজিক্যাল সেন্টারে তার পিতার টেস্টগুলো জমা দিয়ে রিপোর্টের অপেক্ষায় বসেছিলেন ওয়েটিংরুমে।ওয়েটিংরুমে বিশাল টিভিতে দেখাচ্ছিলো সারা বিশ্বসহ আমাদের দেশে করোনার হিংস্র থাবার আপডেট রিপোর্ট।তার চোখ পড়লো টিভি স্কিনের একটি বিশেষ নিউজে- যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান করোনায় চিরতরে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
অবাক হলেও সত্যি হাজারো কোটি ডলারের মালিক হলেও শেষ পর্যন্ত অক্সিজেনের অভাবে মৃত্য বরণ করেছেন আরো অনেকে।সে সময় কারো টাকা থাকলেও অক্সিজেন পাওয়া ছিলো অনেকটা ভাগ্যের ব্যপার।তখন পুরো বিশ্ব ছিলো অক্সিজেন সংকটে।বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
এই এক করোনায় মানুষকে জানান দিয়ে গেলো- এই পৃথিবীর কে তার আপণ কে তার পর।করোনা মানুষ মানুষের মাঝে এতোটা দূরত্ব সৃস্টি করেছে যে,একজন করোনা রোগীকে দেখলেই মানুষ ভাবতো- সে এক অভিশপ্ত; জীবন্ত লাশ।তার কাছে যাওয়া যাবে না তাকে ছোঁয়াও যাবে না।করোনা ভাইরাসটিকে নিদিষ্ট বেষ্টনীতে আটকে রাখতে সৃস্টি হয়েছিলো তথাকথিত লকডাউন যা বিশেষ করে সেসময় বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষদের অন্নমুখে বেচে থাকা ছিলো দায়।পুরো পৃথিবীটাকে নিয়ে গিয়েছিলো শত শত বছরের পিছনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে।ফলে ঘর থেকে বের না হওয়া মানুষজনে অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি ফিরে পায় তার স্বাভাবিক রূপ।বনের পশুর বিচরণ ছিলো অবাদ-স্বস্তিকর।করোনা এতোটাই ক্ষমতাবান ছিলো যে,অবশেষে মসজিদ মন্দির গীর্জা সকল প্রার্থণালয়ের দুয়ার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ট জীব মানুষ।
যাই হোক এর মধ্যে রিপোর্ট এসে গেছে।কাউন্টটারে গিয়ে সায়মন রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখালেন।ফের চলে এলেন বাবার কাছে।বাবার খুব কাছে যাওয়া নিষেধ-ছোঁয়া নিষেধ।আজ প্রায় অনেকদিন হলো আফজাল সাহেবের কোন জ্ঞান নেই।অচেতন অবস্থায় শুধু মাত্র অক্সিজেনের জোরে বেচে আছেন।গ্লাসের বাহিরে দূর থেকে সায়মন এবং আফজাল সাহেবের স্ত্রী শুধুই চোখের জল ফেলেন।
তার কয়েকদিন পর৴৴
মোবাইলে সায়মন তার বোন সূরাইয়ার সাথে কথা বলছে।ডাক্তারদের বোর্ডমিটিংয়ের সিদ্ধান্ত জানতে পেরে সায়মনের চোখে যেনো অন্ধকার দেখছেন।পিতৃহারা শোক যেনো এখনিই মনে উথলে উঠেছে।
৴আপু আব্বুকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে নতুবা আব্বুকে আর…।
বলে কেদে ফেলেন ছোট ভাই সায়মন।এদিকে বোন সূরাইয়া নিজেকে সামলে নিলেন অনেক কষ্টে।সাহস দিলেন ভাইকে।
সায়মন হাসপাতাল থেকে নিজেদের একটি গাড়ীতে অক্সিজেন লাগানো অচেতন অস্থায় বাবাকে উঠিয়ে দ্রুত নিজ বাসায় এসে বোনকে সাথে নিলেন।মা ছিলো তার সাথেই।দ্রুত গাড়ীটি রওয়ানা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।সাথে যাওয়া সবার শরির ছিলো স্বাস্থ নিরাপত্তার সকল পরিধেয় বস্তু।
গাড়ী দ্রুত চলছে।যখনি জ্যাম একটু লাগে তখনি সায়মন একবার বাবার দিকে তাকায় আবার বাহিরে থেমে থেমে পাওয়া জ্যামের গাড়ীগুলোর দিকে।মন কেবল আনচান করতে থাকে।
বিপদ এলে বিপদ যেনো আরো ঝেকে বসে।এতো দিন যে রোডে জ্যাম ছিলো না অথচ আজ সেই রোডেও প্রচুর জ্যাম।গাড়ীর ভেতরে অসুস্থ আফজাল সাহেবের পাশে কাজের মেয়েটি বসে কোরান শরীফ পড়ছেন।মা,সায়মন,সূরাইয়া,নাতি প্রিন্স সবাই যেনো এক অজানা ভয়ের মাঝে আছেন।
করোনার কারনে লকডাউনের এরিয়া বাদ দিয়ে ঘুরে ফিরে তাদের গাড়ীটি এখন ফেরিঘাটে-ফেরি পারাপারের অপেক্ষায়।এর মাঝে চলে যায় বেশ কিছু সময়।রাত এখন অনেক হয়ছে অথচ তারা এখনো পদ্মার এপারেই। আল্লায় জানে ফেরি আসে কখন!পুরো দেশ লকডাউন না হওয়ায় ফেরিঘাটে গাড়ীর সংখ্যাও কমছিলো না।হুজুগের বাঙালীর মনে ভয় ছিলো কখন আবার পুরো দেশেই কঠোর লকডাউন দিয়ে বসেন সরকার।
সূরাইয়া জ্যামের এ অবস্থা দেখে খুব টেনসনে পড়ে গেলো।ঐ দিকে সূরাইয়ার স্বামী ডাঃ নীরব ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন স্পেশালিষ্ট হিসাবে কর্মরত আছেন।তার সাথে সূরাইয়ার কথা হয়েছে।
মুলত তার আব্বুকে নিয়ে তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যাচ্ছেন।যদি ঢাকা মেডিক্যাল রাখেন তাহলে রাখবেন নতুবা পাশেই জামাইয়ের ভাড়া বাসায় রাখবেন।তবে জামাইয়ের সিদ্ধান্ত হলো শশুরকে তার নিজ বাসায় রাখবেন।কারন করোনার এ মহামারীতে হাসপাতালগুলোর যে বেহাল অবস্থা এখানে রেখে তাকে করোনার সুচিকিৎসা করানো সম্ভব নয়।বরং নিজ বাসায় নিয়ে গেলে আরামে তার সেবা সবায় ঘুরে ফিরে করতে পারবেন।জামাইয়ের সিদ্ধান্ত সায়নকে বললে সায়মন সায় দিয়ে বোনকে বলেন।
-যে ভাবে ভালো হয়।
না!গাড়ী এক চুলও এগুচ্ছে না।এরমধ্যে একটি ফেরি এসে কিছু গাড়ী পারাপার করলো।সায়মন গাড়ী থেকে নেমে লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলো প্রায় তিনঘন্টা পর সেই ফেরিটি এসেছিলো।
ফেরির সাহায্যকারী ঘাটের বোর্ডটিতে উঠে রেলিং ধরে সায়মন রাক্ষসী পদ্মার রূপ দেখছেন।রাতের পদ্মা যেনো আরো ভয়ংকর।শো শো বাতাস আর ঢেউয়ের গর্জন যেনো প্রমাণ করে কতটা ভয়ংকর এই পদ্মা নদী।দুই পাড়ের কতো মানুষকে করেছে ঘর বাড়ী ভিটে হারা তার আর ইয়েত্তা নেই।
সায়মনের এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না।বাবাকে কতক্ষণে ঢাকায় নিয়ে যাবেন সেই চিন্তায় অস্থির।ঠিক সেই সময় পদ্মার মাঝ হতে আসা সূচারু একটি তীব্র আলো চোখের পলক দিয়ে গেলো।তার আশে পাশের অনেককে বলতে শুনা গেলো ফেরি আসছে।সায়মন একটু স্বস্তি পেলো।সে তাদের গাড়ীর দিকে যেতে যেতে লাইনে থাকা গাড়ীগুলো দেখলেন।তার আগে বহু গাড়ী।মনে হয় এই ফেরিতেও যাওয়া হবে না।সে তার মাথাটা খাটালেন।কি করা যায়।হঠাৎ কে যেনো এসে তার পিছনটায় স্পর্শ করে।সায়মন পিছন ঘরে এক পাগলকে দেখতে পেলো।
-দে? কি দিবি দে???
সায়মন দেরি না করে পকেটে ছিলো পাচশত টাকা তাই দিয়ে দিলেন।টাকাটা সায়মনকে ফেরত দিয়ে পাগল বললেন।
-এই কাগজ তোর কাছেই রাখ!এটা চাই নাই-নে নে। যা তুই ঐপাড়ে যা …..কিন্তু…তারপর! তারপর আর আমি জানি না-জানি না ইত্যাদি বলে নিমিশেই দৌড়ে এ স্থান হতে প্রস্থান নিলেন।
সায়মন টাকাটা হাতে নিয়েই তার গাড়ীর দিকে যাচ্ছিলেন।পথে গাড়ীগুলোর লাইন কন্ট্রোলের লোকের সাথে দেখা।
-ভাই…
লোকটি অনেক ব্যস্ত তবুও সায়মনের সাথে কথা বলছেন।সায়মন লোকটির হাতে গুজে দিলেন কিছু টাকা।ঠিক সেই সময় সূরাইয়ার ফোন আসে।
-হ্যালো-তুমি কই জলদি আসো।বাবা চোখ খুলেছেন- কথা বলার চেস্টা করছেন।
লোকটি তাকে জিজ্ঞাসা করল।
-কি হয়েছে?
-গাড়ীতে আব্বুর অবস্থা বেশী ভালো না।একটু জলদি করবেন, প্লিজ।
-কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।ফেরি আগে ঘাটে ভীরুক তারপর আপনার গাড়ী স্পেশাল ভাবে আমি নিয়ে যাবো।ভালো কথা,কি গাড়ী?
– মাইক্রো।
-আরো ভালো হলো সহজেই নিয়ে যেতে পারবো।আপনি যান।চিন্তা করবেন না সময় মতো আমি ব্যবস্থা করব।
সায়মন গাড়ীতে এসে তার বাবার কাছে বসলেন।সূরাইয়া তার বাবাকে খুব নরম করে বলছেন।
-আব্বু,তুমি না সায়মনকে খুজছিলে..এইতো সায়মন এসেছে।
দুবার বার বলার পর একটু চোখ খুললেন আফজাল সাহেব।সায়মনের সাথে শুধু ইশারায় কথা বলার চেস্টা করছেন আর খুব ধীরে কাপা কাপা হাতে পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে সায়মনের দিকে দিলেন।সায়মন কাগজটা হাতে নিয়ে পকেটে রাখলেন।
-আব্বু তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? তুমি চিন্তা করো না।তুমি ভালো হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ্।
ছেলের কথা শুনে আফজাল সাহেবের মুচকি মুখে হাসির প্রলেপ।আফজাল সাহেব ভাবলেন-ছেলেকে নিরাশ করে লাভ কি!সেতো জানেন,দুনিয়াদারী করতে গিয়ে কত পাপ করেছেন।কত মানুষের হক মেরেছেন,কত শ্রমিক বেতনাদি না পেয়ে তার ফ্যাক্টরী হতে কেদে বের হয়েছেন।কতজন তারই কারনে এখনো জীবন যাপনে খুব কষ্টে আছেন।তার এ অসুস্থবস্থায় তার চোখে এসব যেনো দৃশ্যকারে প্রতিনিয়ত ভাসছে।
হঠাৎ মানুষে কোলাহল শুনতে পেলো সায়ম।ফেরি ঘাটে এসেছে।ঠিক সেই সময় ফেরির সেই লোকটি দৌড়ে এসে ড্রাইভারকে গাড়ী ডাইনে ঘুরিয়ে সিরিয়াল থেকে বের হতে বললেন।লোকটি একের পর এক বাশি বাজাতে বাজাতে গাড়ীটিকে ফেরিবোডের কাছে নিয়ে দ্বিতীয় নাম্বার সিরিয়ালে রাখালেন।স্বস্তি পেলেন সায়মন।লোকটিকে আরো পাচশত টাকা দিয়ে বললেন দোয়া করবেন ভাই।
ফেরি চলছে পদ্মার ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে।রাত প্রায় ভোরের অপেক্ষায়।সায়মনের চোখে ঝিমুনি আসছে।চোখে মুখে পানি ঢেলে ঝিমুনি কন্ট্রোল করতে সয়মন অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশে রাখা পানির বোতলটি নিতে গিয়ে চোখ পড়ে সিলিন্ডারের কাটার দিকে।চমকে উঠলেন সায়মন।সর্বনাশ অক্সিজেনইতো শেষের পথে।এখন উপায়!! ঐপার গেলে অক্সিজেন সংগ্রহ করা সম্ভব কি? খুব টেনসন আর ভাবনায় পড়ে গেলেন সায়মন।সায়মন সূরাইয়াকে জানালে সূরাইয়াও সিলিন্ডারের কাটা দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন।ভাইকে বললেন।
-তুমি এটা কি করলে একটা অক্সিজেন বাড়িয়ে আনলে না?
-আমি বুঝতে পারিনি,ভুলে গেছিলাম আব্বু যে অক্সিজেন ছাড়া বাচতে পারবে না।
দুজনের মনে গভীর শোকের ছায়া।মাকে এখনো কিছু বুঝতে দিচ্ছেন না।সূরাইয়া তার ডাঃ স্বামীকে ফোন দিয়ে বিষয়টা বললেন।সেও বলছেন-স্বয়ং ঢাকাতেও অক্সিজেন সংকট।প্রচুর অর্থের বিনিময়ে হলেও একটি বাড়তি সিলিন্ডার পাওয়া যাবে না।
সায়মন তার যত বন্ধু বান্ধব আছেন একে একে সবাইকে ফোন করছে।কারো কাছ থেকেই তেমন কোন শুভ সংবাদ পাচ্ছেন না।আর যদি পাওয়াও যায় তবুও এই অল্প সময়ের মধ্যে মাওয়া ঘাটে সিলিন্ডার বহন করে নিয়ে আসাটাও যেনো অসম্ভব।সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।ইতিমধ্যে গাড়ীতে যারা ছিলো তারা সবাই বিষয়টি জেনে ফেলেন।কাজের মেয়েটির কোরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ বেড়ে গেল।সবার বুকে চাপা কস্ট বহমান।তাদের নীরবে চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরছে।
একটা সময় ফেরিটি ঘাটে এসে পৌছাল।ড্রাইভার গাড়ীটি যত দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে টান দিলেন।জ্যামের কারনে গাড়ী আর চলছিলো না।গাড়ী জ্যামে আটকে আছে পার হওয়া ঢাকা মুখী ঘাট বরাবর রাস্তায়।
এদিকে আফজাল সাহেবের হাত পা বেশী নড়াচরা শুরু করছে।তার নিশ্বাস ঘনঘন উঠা নামা করছে।সবায় যে যার মতন দোয়া দরূদ পড়ছেন।এক সময় পুরো অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়।সায়মন মাথা নীচু করে মোনাজাতে স্রস্টাকে ডাকছেন।রাত পেরিয়ে ভোরের উকিঁ।দূর মসজিদ হতে ভেসে আসছে-আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম……ততক্ষণে আফজাল সাহেব চলে গেলেন না ফেরার দেশে।।
দৃশ্যপট;
সায়মন পদ্মাসেতু দেখতে এসেছেছিলেন।ফজরের আযানের পূর্বেই সে উপস্থিত হন পদ্মাপাড়ে, পদ্মার অপরূপ রূপ দর্শনে।ঠিক এ সময় মসজিদে মসজিদে ফজর নামাজের আযানের ধ্বনি ধ্বনিত হতে থাকে। সায়মনের মনে পড়তেই তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে।ঠিক এমনি এক ফজরের আযানের সাথে সাথে তার পিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।আজ হঠাৎ মনে পড়লো পিতার দেয়া সেই কাগজের কথা যা তার আব্বুর শেষ বিদায়ের কিছুক্ষণ পূর্বে আফজাল সাহেব তাকে দিয়েছিলেন।সায়মন সেই কাগজটি তখন না পড়েই মানিব্যাগে রেখেছিলেন।পদ্মাসেতুর পাড়ে এসে মানিব্যাগ থেকে সেই কাগজটি বের করে পড়ছিলেন ।
“দুদিনের পৃথিবীতে আমি আর থাকছি না-তোমরা আমার শ্রমিকের পাওনাদি যা ছিলো- তা ওদের হক,ওদের হক ফিরিয়ে দিও- তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো।
চিরকুটটি পড়ার সময়ই সায়মন পিতৃহীন স্মৃতির অধ্যায়ের ক্ষণের মাঝে তলিয়ে যান এবং হঠাৎ অসংখ্য হর্ণের শব্দে সায়মন যেনো বাস্তবে এলেন।
আজ সায়মনের সবিই হয়েছে টাকা পয়সা ধন দৌলত সব।সময়ের সাথে পরিবর্তন এসেছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থারও।এই পরিবর্তনটা যদি আরো আগে হতো সঠিক সময়ের আগেই ঢাকায় পৌছে যেতে পারতেন তখন হয়তো সায়মন আজ পিতৃহারা হতেন না।মনের কষ্ট মনে চাপা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে পদ্মার ঢেউ আর সেতুর উপর অসংখ্য গাড়ীর অবাদে চলাচল দেখছেন।
-সমাপ্ত
২৫ জুন ২০২২ দেশের বৃহত্তম বহুমুখী পদ্মাসেতুর উদ্বোধন যার দৈর্ঘ ৬.১৫(২০,২০০ ফুট)।পদ্মাসেতুকে প্রথম দর্শনে এক নজর দেখতে উৎসুক মানুষের ঢল।কেউ গাড়ীতে কেউ পায়ে হেটে পদ্মা সেতু দেখতে চলে এসেছেন।পদ্মা সেতু দেখতে এসে সর্বানাশা রাঁক্ষুসী পদ্মা নদীতে হারানো স্বজনদের স্বরণ করছেন অনেকে-অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন-আহারে এই পদ্মার উপর সেতুটি যদি আরো আগে তৈরী হতো!!আজ আমাদের স্বজন হাঁরাতে হতো না।
১৮টি মন্তব্য
নার্গিস রশিদ
খুব দুঃখ লাগলো পড়ে। ব্রিজ যখন হল দুঃখ ঘুচুক। শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
পড়লাম সুন্দির লিখেছেন ভাইজান
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাই।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
বাস্তবতার কাছে মানুষ কতো অসহায়!
কত জন হয়তো ভাবছেন, সে সময় পদ্মা সেতু থাকলে হয়তো
আমার বাবা, কেউ আমার মা, কেউ আমার ভাই, কেউ আমার স্বজন
মারা যেতো না।
সুন্দর লিখেছেন।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
মনির হোসেন মমি
যাষ্ট আফসোস করা।তবে নিয়তিই হলো বাস্তবতা।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
হালিমা আক্তার
কঠিন এক বাস্তব চিত্র সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। পদ্মার ওপারের মানুষগুলো জানে, পদ্মা সেতুর প্রয়োজনীয়তা। রাক্ষুসে পদ্মা সর্বনাশ কম করে নাই। আমার অনেক আত্মীয়ের বাড়ি এখন পদ্মার বুকে স্রোতের ঢেউ গোনে।
শুভ কামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি
হুম । অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সব গল্পের শেষাংশ যে মধুর হয় এবং ফিরে পাওয়া যায় এমন না।
তদ্রূপ এ গল্পটা এমন অনেক দুঃখ, আফসোস আর স্বজন হারানোর ব্যথা।
এ ব্যথা অনন্তকাল বুকে পুষে রাখতে হবে যারা হারিয়েছে তাদের আপনজন।
হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি।
আর এ ব্যথায় সবাই ব্যথিত হবে না!
কি অদ্ভুত জীবন আমাদের।
কখন কোথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বলা ও বুঝা মুশকিল।
এটুকু বলব বেশ বেশ লিখেছেন, দাদা।
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় ভাইটি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আহা! নিদারুণ নিদারুণ! আরও পড়তে হবে ভাই!🌹
মনির হোসেন মমি
হুম ধন্যবাদ আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
পদ্মা পারাপারের যাতনা লাঘব হয়েছে স্বপ্নের সেতুটি নির্মাণ হয়ে। আর যেন কারো বুক খালি না হয় নৌকা/স্পিড বোট ডুবে, অথবা এম্বুলেন্স গুলো মুমূর্ষুদের বাচানোর জন্য যেন দ্রুত ছুটে যায় এপার-ওপারে। সর্বনাশা পদ্মানদী নিমিষেই পাড়ি দিয়ে মানুষ গুলো পৌঁছে যাক একে অন্যের কাছে।
গল্পটা পড়ে মন খারাপ হলো। আসলে যার যেটা প্রয়োজন সেই বুঝে পাওয়ার তীব্রতা কেমন।
শুভ কামনা 🌹🌹
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ বড় আফা।।
জিসান শা ইকরাম
করোনা কালে জীবনের কঠিনতম রুপ দেখেছি আমরা।
দেশের হাসপাতালের অব্যবস্থার কথা কি আর বলবো।
পদ্মার ফেরী ঘাটে যে এমনি ভাবে কত জীবন ঝরে গিয়েছে তার হিসেব নেই। আমরা বরিশালের জনতা ফেরীর বিরম্বনার কথা জানি।
আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব হয়েছে।
ভালো পোস্ট,
শুভ কামনা
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইজান।
রিতু জাহান
একদম জীবন্ত যেনো সবকিছু। আমরা দক্ষিণের মানুষ জানি কতোটা আশীর্বাদ নিয়ে পদ্মা সেতু আমাদের জীবনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, থাকবে ইনশাআল্লাহ।
আমারও যে কতো কতো স্মৃতি ঘাট ঘিরে!
অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম মনির ভাই,,
শুভকামনা রইল,, ভালো থাকুন সব সময়।
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
নিয়মিত হওয়াটা এখন বড় দুসময়।যাই হোক দোয়া করবেন।
ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।