ওরা বসবে বলে এক প্লাটফর্ম থেকে নেমে রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটছে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ  হুইসেল বাজিয়ে মাথায় যেনো চাঁদের টিপ(বাতি) পরে সা সা করে এগিয়ে আসছে ট্রেন। অনি দ্রুত পাশের প্লাটফর্মে উঠলো। এ পাশের প্লাটফর্ম কিছুটা উঁচু হওয়ায় রূপার উঠতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সামনে ট্রেন, সময় বেশি নেই। অনি হাত বাড়িয়ে দিলো রূপার দিকে। রূপা ওদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজেই উঠার চেষ্টা করছে দেখে ধমক দিয়ে উঠলো অনি। কি হলো হাতটা ধরে উঠতে পারছো না? ট্রেন খুব নিকটে রূপা এবার ভয় পেয়ে অনির হাত ধরতেই অনি দ্রুত টেনে তুললো।

-হাত ধরছিলে না কেনো ? এখনই তো ট্রেনের নিচে চাপা পড়তে!
-পড়তাম তো পড়তাম তাতে আপনার কী?
-অহংকার নাকি রাগ! কিসের তো রাগ পুষে রেখেছো রূপা?

রূপা চুপ করে রইলো। একটাও কথা বললো না। শুধু অবচেতন মনে বলে বসলো এই হাতটা আরও কয়েক বছর আগে বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিলো আর আমার হাতটা সারাজীবন ধরে রাখার কথা ছিলো।

-রূপা তোমার মনে আছে ছোট বেলায় খালাম্মা আমাকে কী বলে ডাকতো?

এবার আর কিছুতেই নিজেকে শান্ত স্থির রাখতে পারলো না রূপা। এতো দিনের পুষে রাখা রাগ/ক্ষোভ ঝাড়লো রূপা। কর্কশ গলায় বলে উঠলো

-যে শব্দটা ছোট্ট বেলায় মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল। যে শব্দটা শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছিলাম। যে শব্দটাকে কেন্দ্র করে সংসার সাজিয়েছিলাম। তা ভুলে যাই কি করে? চেষ্টা করেছিলাম ভুলে যেতে কিন্তু পারিনি। প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেমে পড়া কেউ ভুলতে পারে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি কিছুই ভুলিনি, ভুলতে পারিনি।
-রূপা কী বলছো এসব? প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেম! কী বলছো তুমি?

-বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই কী বলছি আমি?

-আরে কি বুঝবো? আমি তো বলতে চাইলাম খালাম্মা  আমাকে জামাই বলে ডাকতেন, বলতেন তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবেন। এর এসব মজা করে বলতেন।

-মজা! মজা ছিলো এসব আপনার কাছে? মজা ছিলো বলেই বুঝি দূরে সরে গিয়েছিলেন আমার থেকে। কিন্তু আপনাদের এই মজার মাশুল সারাজীবন ধরে আমি দিয়ে যাচ্ছি। একবারও মনে হয়নি না আপনাদের এ রকম মজা আমার উপর কতোটা ইফেক্ট ফেলতে পারে

-রূপা দাঁড়াও দাঁড়াও, শান্ত হও। তুমি আমাকে ভালোবাসতে রূপা?

-সেটাই কী স্বাভাবিক নয় যখন জানতাম আমি আপনার বউ হবো! সবাই যখন আমাকে অনির বউ বলে ডাকতো তখন আপনাকে বর ভেবে আপনার প্রেমে পড়া কী খুব অস্বাভাবিক ছিল? আর যখন আমি আপনার প্রেমে পড়লাম ঠিক তখনই আপনি আমার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে নিজের সংসার সাজালেন। কী করে পেরেছিলেন বলুন তো?

-এখন বুঝলাম তোমার আমার সাথে যোগাযোগ না রাখার, আমার উপর রেগে থাকার কারণ। আচ্ছা বেশ আমি অপরাধী মানছি। এখন তুমি আমাকে বলো আমি কী করে জানবো তুমি আমাকে ভালোবাসতে? কখনো কী বলেছো আমাকে? তুমি তো আমার সাথে কথায় বলতে না কখনো। তুমি যে আমাকে অপছন্দ করতে সেটাই জেনে এসেছি এতো দিন। আমি তোমাদের বাড়িতে গেলে তুমি কখনো এসেছিলে আমার সামনে, বসেছিলে আমার পাশে? এতো গুলো বছর আমাকে অপরাধী ভেবে নিজেও কষ্ট পেয়েছো আর আমাকেও কষ্ট দিয়েছো

-আমাকে বলতে হবে কেনো? যেখানে আমার বাবা মা আপনাকে জামাই ডাকতো।
-রূপা আমি তো জানতাম ওরা মজা করতো। ওরা যে এ ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলো জানলে কখনোই তোমাকে ছেড়ে আসতাম না। আমিও তো তোমাকে ভালোবাসতাম।
-ভালোবাসতেন! আমি জানতাম আপনি আমাকে পছন্দ ই করতেন না।

-আমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসতাম। অথচ কেউ কাউকে বলতে পারিনি কখনো। এটাই বোধহয় ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! সৃষ্টিকর্তা আমাদের একে অপরের জন্য সৃষ্টি করেনি বলেই হয়তো আমরা আলাদা। নিয়তির লেখা মেনে নিতে হয়েছে। বিধির বিধান অস্বীকার করা যায় না রূপা।

রূপা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঠিকই তো সে কোনোদিন অনির সাথে কথায় বলতো না । তবে অনি কী করে বুঝবে যে সে অনিকে ভালোবাসে? এবার রূপার নিজের উপরই রাগ হলো সাথে লজ্জিতও। রূপা সরি বললো অনিকে।

-তুমি কেনো সরি বলছো রূপা? সরি তো আমার ই বলার কথা। আমারই উচিত ছিল তোমার সাথে কথা বলার। যা আমাদের কপালে নেই, যা হয়নি তা নিয়ে মন খারাপ করে কী লাভ?

-আপনি একদম সঠিক বলেছেন। অকারণেই শুধু শুধু এতো দিন রাগ পুষে কষ্ট পেয়েছি। হ্যাঁ নিয়তি যা চায়, যেমন করে চায় সেটাই আমাদের মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়া উচিত।

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ