সুন্দরবনের উপকণ্ঠে মগ-ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ –১

সেই সময় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলে বর্গী তস্করেরা বর্ণনাতীত ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সলিমুল্লাহ্ তাঁর তারিখ-ই-বঙ্গাল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, ঐ সময় গঙ্গার পশ্চিম তীর থেকে বনেদি পরিবারের অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে আসেন গঙ্গার পূর্ব তীরে বসবাসের জন্য।

বিনয় ঘোস লিখেছেনঃ 'পর্তুগীজ দস্যু বণিক ও গোলাম-ব্যবসায়ীরা ইংরেজ কুঠিয়ালরা, ডাচ ও ফরাসি বণিকেরা পশ্চিম বাঙলার গ্রাম সমাজকে যখন ভাঙতে আরম্ভ করে, সেই সময় মারাঠা দস্যুরা নির্মমভাবে লুঠতরাজ করে সেই নিশ্চিত সমাজ জীবনকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গ্রামবাসীদের তারা নিষ্ঠুর অস্ত্রবলে যাযাবর উদ্বাস্তু দলে পরিণত করে ছাড়ে। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী একাধিক গ্রাম থেকে অসংখ্য ব্রাক্ষণ পণ্ডিত পরিবার তাদের পুঁথিপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে অনেক পুঁথি তাদের নষ্ট ও হয়। কায়স্থ বৈদ্যরা ও তাদের অনুসরণ করে পালিয়ে বাঁচে। পশ্চিম থেকে পুবে সেদিন যারা পালিয়ে আসেন তারা অনেকেই নতুন কোলকাতা শহরে এসে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। এভাবেই দানা বাঁধতে থাকে নতুন নতুন শহরের। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের সমাজের ভাঙ্গনের সংগে কোলকাতা শহরের নতুন সমাজ গঠনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এ জন্য ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর যতটা দায়ী, তার থেকে তদপেক্ষা বেশী দায়ী পর্তুগিজ- ডাচ- ইংরেজ মারাঠা বর্গীদের নিষ্ঠুর লুণ্ঠন ও তস্কর বৃত্তি।

১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ভাস্কর পন্ডুত কাটোয়ায় মহাসমারোহে দূর্গাপূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। এ পূজোর রসদ সংগ্রহের জন্য তিনি স্হানীয় জমিদার ও গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে ভেটও আদায় করেছিলেন। তখন গঙ্গারাম লিখেছিলেন এই পুঁথিখানাঃ ভাস্কর করিবে পূজা বলী দিবার তরে।

ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।।
এই মতে করে ভাস্কর পূজা আরম্বন।
এযা মির হবির বর্গি লইয়া করিল গমন।।প

পূজো হচ্ছিল ধুমধাম করে। এমন সময় মহানবমীর দিন সকালে রাতারাতি গঙ্গা পার হয়ে ছুটে আসেন আলীবর্দী খাঁ যেন পূজোয় কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে বর্গীরা। বর্গীরা সত্যি পিছু হটে সেবার। নবাবের সেনারা কাটোয়া থেকে কটক পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে বর্গীদের চিল্কা হ্রদ পার করে দিয়ে আসে। এভাবে আলীবর্দী খাঁ সেদিন বাঙলার মুখ রক্ষা করেছিল।

পর্তুগীজদের এই তস্কর বৃত্তির ঐতিহাসিক কারণ ও আছে। ইউরোপীয় বণিকদের মধ্য পর্তুগিজরাই সর্বপ্রথম ভারতে পা রেখেছিল। উত্তরকালে ইউরোপীয় ও অন্যান্য বণিক জাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা তস্কর বৃত্তিতে নেমে পড়ে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল দিয়ে তারা প্রবেশ করত সুন্দরবনের শান্ত সবুজ গ্রামের অভ্যন্তরে। আরাকান রাজ্যের উৎসাহে এসব অঞ্চলে লুণ্ঠন চালিয়ে আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে ধরে বন্দি করে জন্তু জানোয়ারের মতো তাদের বিক্রি করা হতো হাটে মাঠে ঘাটে। হুগলিতে বসত মানুষ ক্রয় বিক্রয়ের হাট। কলকাতাতেও মানুষ বেচাকেনার জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থান ছিল। বিনয় ঘোষ তার গ্রন্থে লিখেছেনঃ কোম্পানির আমলে গোলামের ব্যবসায় মুনফা বেশ লোভনীয় ছিল। ইংরেজদের আগে পর্তুগিজরা গোলামের ব্যবসায় বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিল। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে কোলকাতার কাছে বজবজ আখড়া পর্যন্ত অনেক জায়গায় নদীর ধারে ধারে পর্তুগিজ ও তাদের দোসর মগ বোম্বেটেরা গোলাম কেনাবেচার বাজার স্থাপন করেছিল। এই মগ ও পর্তুগিজদের প্রতিদ্বন্দী রূপে ইংরেজরাও দাস ব্যবসা ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়। মুনাফার লোভে অনেক রুচিবান শিক্ষিত ইংরেজদেরও মানবতাবোধ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়।

মূলত বাদশাহ আকবরের সময় থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী আরো কিছুকাল পর্তুগিজরা সপ্তগ্রাম অঞ্চলে এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ছিল যে, তাদের অনুমতি ছাড়া হুগলিতে কেউই বানিজ্য করতে পারেনি। তাদের অত্যাচারে দেশীয় নৌ বানিজ্য পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কবি মুকুন্দরাম পর্তুগিজদের আধিপত্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেঃ
ফিরিঙ্গীর দেশে খান বাহে কর্ণ ধারে
রাত দিন বয়ে যায় হার্মাদের মরে।।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ফিরিঙ্গিদের লাম্পট্যের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেনঃ যাহারা রাজদণ্ডে দন্ডিত, লোকালয়ে লাঞ্ছিত, কুকর্মপরায়ন বলিয়া স্বদেশে সর্বত্র ধিক্কৃত, চরিত্রহীন ভাবে পশুর ন্যায় অবনতিপ্রাপ্ত সেই সব নর রাক্ষসই ভারত যাত্রা অর্থাৎ বাঙলায় আসত।

 

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ