"দেশের জন্য আমি যা করছি, ও করতে চাচ্ছি, তা কেউ অনুধাবন করল না "
--- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করার যে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল, সেই নরখাদক, কলঙ্কময় নামটি হচ্ছে, মেজর ফারুক। মেজর ফারুক তার এই নারকীয় চিন্তাটি প্রথমে তার বৌ এর বড় বোন জোবায়দার স্বামী মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদকে জানিয়েছিল। ফারুকের বিবাহ বার্ষিকীর এক জাঁকজমকপূর্ণ রাতে সে তার গোপন চক্রান্তটা তার ভায়রা ভাইর সাথে আলোচনা করে।

অন্যদিকে শহরের অন্য এক প্রান্তে পরিবারের লোকজন নিয়ে নিশ্চিন্তে মনে বাইরে থেকে আসা মেহমানদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। সেই ফাঁকে চলছিল, দেশের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা। দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন, তাঁর প্রিয় বোনের স্বামী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সাথে। তিনি তখন বন্যা নিয়ন্ত্রিত, পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একটা দিক ছিল, উনি অনেক আলোচনায় পরিবারের লোকদের রাখতেন। তিনি ছিলেন যে কোনো আলোচনায় সহজ এবং সাবলিল। সেই আলোচনায় সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্ ও উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবার সাথে বন্যা নিয়ন্ত্রন নিয়ে কথা বলছিলেন।

বন্যা ধান ও অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তিনি সেরনিয়াবাতকে ভারত থেকে আমদানিকৃত ড্রেজারগুলো কালবিলম্ব না করে নদী খননের কাজে লাগানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কৃষকের উপখ্যান বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর জুড়ি ছিল না। আলোচনায় ক্ষণিকের মধ্য তিনি অভিজ্ঞ লোকের ন্যায়, দেশের মাটির সাথে গভীরভাবে মিশে আছে এমন এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পটভূমিতে ঐ সময়ের সঙ্কটকে সমাধান করার জন্য একটা ছক সাজিয়ে নিলেন। ততক্ষণে তাঁর তামাকের পাইপ থেকে বেরিয়ে আসা সৌরভে সমস্ত ঘরটা মোহিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ও ঘরভর্তি অন্যান্য শ্রোতাদের লক্ষ্য করে বললেন," আমি যখন ছোট তখন ড্রেজার কোম্পানিতে চাকরিরত বিলেতিদের সংগে নদীর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন এই উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোম্পানী তখন এসব ড্রেজার বার্জ বানিয়ে বার্মায় সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য সরিয়ে নিয়ে গেল। আর কোনোদিন সেগুলো ফিরে এল না। আমি যেখানে খেলতাম সেখানে এখন কোনো নদী নেই। কেবল চর আর চর, আর সে কারনেই আজ আমরা প্রতিবছর বন্যার শিকার হই।"

এ সময় তিনি অতীত থেকে সরে এসে বর্তমান ও ভবিষ্যত বাংলার বন্যা সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি বলতে লাগলেন," যুদ্ধ বিদ্ধস্ত, সম্পদ লুট হওয়া এক দেশ আমার, আমার তো ক্ষুধা পেটে বন্যা নিয়ন্ত্রনের পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তবে কিছু ড্রেজার ও মনে সেই মনোবল তো আছে। তোমারা দেখবে কীভাবে আমি নদীগুলোকে আঁচড়িয়ে ঠিক করে দেই। আমার জনগন তখন হাসিভরা মুখ নিয়ে ঘরে ঘরে সোনার ফসল ধান তুলবে। ঘরে অন্তত ধান, চাল থাকলে কোনো লোক আমার ভাতে মরবে না।" হঠাৎ তিনি একটু অন্য মনস্ক হয়ে বললেন," দেশের জন্য আমি যা করছি তা কেউ বুঝতে পারল না।" এই মন্তব্যটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অমীয় বাণী। তিনি ততক্ষনে তার সারা জনমের ভালবাসার প্রাণপ্রিয় বাঙ্গালীর সঙ্গে ভালবাসার যবনিকাপাত ঘটার কাছাকাছি চলে এসেছেন। তা তিনি টেরও পেলেন না। বাংলার জনগন তাকে বঙ্গবন্ধু নামে আখ্যায়িত করেছিল। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু সাধারণের মাঝে মিশে যেতেন প্রচন্ড একাত্মতায়। তিনি সব সময় বলতেন, " জনগনের ভালবাসার মধ্যেই আমার শক্তি নিহিত, আর আমার দুর্বলতা হচ্ছে এই যে , আমি তাদেরকে অতি মাত্রায় ভালবাসি।"

সহজ সরল বাঙালী পরিবারের মতই জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর
সহজ সরল বাঙালী পরিবারের মতই জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর

সাড়ে তিন বছর আগে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাদেরকে স্নেহ দিয়ে গুরুর মতো শাসন করে এসেছিলেন। যে কোনো অসুবিধা তিনি সহজ সরল ভাবে সমাধানের চেষ্টা করতেন। তিনি অদম্য উৎসাহ উদ্দীপনায় কাজ করতে লাগলেন। এবং সর্বসাধারনের মঙ্গল চিন্তায় তিনি এক সচিবালয় নির্মান করলেন। তিনি যেমন কেবল ড্রেজার দিয়ে বন্যা সমস্যার সমাধানের উচ্চাশা পোষন করেছিলেন, তেমনি সব কিছুতেই সরলতার আশ্রয় নিতেন। বঙ্গবন্ধু নিজে যেহেতু সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে ছিলেন, তিনি তার আশপাশের মানুষগুলোকেও সেইভাবে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তোষামোদ কারিরা তার চরম সর্বনাশই করে যাচ্ছিল। তবুও যারা সমালোচনা করেছিল, তারাও ভেবেছিল এবং বিশ্বাস রেখেছিল বঙ্গবন্ধু যে যাদুর নাম, সে সবই পারবে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত একটি দেশ, নামকে ওয়াস্তে বিদেশী সাহায্য নিয়ে উঠতে একটু সময় তো লাগবে। যারা বঙ্গবন্ধুর সাময়িক এই ব্যর্থতাকে দায়ী করে সমালোচনা করত, লোকদের কানের কাছে কুটমন্ত্র পড়েছিল, যারা ইতিহাস বিকৃত করেছিল তারা দেশের সেই দুর্দিনে সেনা ছাউনির তলে, মেজর ফারুক স্বর্গলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো জৌলুস আয়োজনে মজেছিল। 'শ'খানেক অতিথির এই আয়োজন অনুষ্ঠানে বসে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। তারা তাদের সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে ধানমন্ডির ৩২নাম্বার বাড়িটির দিকে।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম হয়। ঐ সংগ্রামে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষাধিক বাঙ্গালী পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়। বিংশ শতাব্দীর বিরাট এক মানব সৃষ্ট দুর্যোগ হলেও এরই মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীকারের পক্ষে মানবতার জন্য এক সর্বোত্তম বিজয় অর্জিত হয়। চরম বিপর্যস্ত কারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজেদের ভাগ্যকে গড়ার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর পুরো বাঙ্গালী জাতির আত্মদান বিশ্ববাসীর কল্পনাকে নাড়া দিয়েছিল। বাঙ্গালীদের অসংখ্য জীবন উৎসর্গের কোনো তুলনা মেলে না। সুদীর্ঘ দিনের লালিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে বাংলার বীর সেনারা উৎসর্গ করেছিল নিজেদের জীবন। বীর যোদ্ধা ও মনে প্রাণে প্রতিটা বাঙ্গালীর হৃদয়ের প্রিয় অনুভূতিতে অনুরঞ্জিত মমত্ব, ন্যায়বিচার, সামাজিক ঐক্য আর সাংস্কৃতিক দীপ্তির উপর ভিত্তি করে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সাধ ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হল ঠিকই। যার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে এক বুক সাহস নিয়ে কোনোরকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্তানিদের সামনে থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছিল, সেই সোনার বাংলা তার হাত ধরে আর গড়তে দিল না ঘাতকরা। সব উৎসর্গই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। স্বপ্ন পরিনত হল দুঃস্বপ্নে। বাংলাদেশ আবদ্ধ হল রক্তের ঋণে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে বিকৃত হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

এসব দালালরা ব্যাঙ্গ করে বলত, বঙ্গবন্ধু জীবিত কীভাবে ফিরে এলেন ! তিনি নাকি কারাগারে বেশ ভালোই ছিলেন! তাদের উদ্দেশ্য এই তথ্যটুকু," বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারারুদ্ধ অবস্থায় তাকে সম্পূর্ণভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আলাদা করে রাখে। পাকিস্তান বর্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতে পারছিলেন না। কোনোরকম খবরের কাগজ, চিঠিপত্র, টেলিফোন তাকে দেয়া হয়নি। রেডিও পর্যন্ত তাকে শুনতে দেয়া হয়নি। এমনকি জেলারের সাথেও তাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু জানতেও পারলেন না, তার প্রিয় দেশটাকে কীভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে। কীভাবে ৩০লক্ষ লোক নিহত হয়েছে ঐ বর্বরদের হাতে। পৃথিবী যেমন জানতে পারছিল না বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যে কী ঘটছে বা কি ঘটেছিল, তেমনি তিনিও জানতে পারেননি তার সহধর্মিনী ও সন্তানদের সাথে কি হচ্ছে।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ