তবুও বেঁচে থাকা

রিমি রুম্মান ২ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার, ০৮:৫৭:১৯অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৭ মন্তব্য

ক্ষোভে উত্তেজনায় শায়লা বলে চললো__ "এভাবে সংসার হয় না। হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত তুললো ? আমার বাবা-মা'ও কোনদিন গায়ে হাত তুলেনি। আমাকে ধাক্কা মেরে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিলো। আমি তো মারাও যেতে পারতাম, পারতাম না ?" জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আমার দিকে। আমি ধীর, স্থির কণ্ঠে বলি, "তুমি তাঁর মেজাজ খারাপ করেছিলে ?" শায়লার উত্তর, " আমার বাবা-মা তুলে কথা বললে আমি স্থির থাকতে পারি না, ওর বাবা-মা নিয়েও বলতে থাকি মুখে যা আসে তা।" আমি বুঝে নিলাম, এভাবেই বিবাদ জটিল থেকে জটিলতর দিকে এগিয়ে যায়।

 

সেদিন আবারো সেই রাগত স্বর__ " অনেক কিছুই মেনে নেয়া যায়। গায়ে হাত তোলাও মেনে নেয়া যায়। কিন্তু পরনারীতে আসক্তি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। নাহ্‌ আর একসাথে নয়। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে তুমি কি করতে ?" আমি উত্তর করি না। বাইরে ব্যাকইয়ার্ডে দৃষ্টি ফেরাই। শায়লার একমাত্র পুত্র আর একমাত্র কন্যা খেলা করছে বাইক নিয়ে। ছোট বোনটি বাইক থেকে পড়ে গেলো, ভাইটি পরম মমতায় হাত ধরে টেনে তুলল। কি অদ্ভুত মায়াময় দৃশ্য ! সৃষ্টিকর্তা রহমান-শায়লা দম্পতিকে দু'হাত ভরে দিয়েছেন। সুস্থ দু'টি সন্তান। আর কি চাই ! অনেকের তো অনেক অপূর্ণতাই থাকে। থাকে না ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি একাকি।

চা'য়ের কাপে চামচের টুংটাং শব্দে ফিরে চাই। শায়লা চা এগিয়ে দিতে দিতে বলে_" এবার আর কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। স্বামী রাগ করে সেই যে গেলো, তিনদিন বাড়ি ফিরেনি। এমন করে একটি সম্পর্ক আর কতদূর টেনে নিয়ে যাবো ? বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার কথা, ভবিষ্যতের কথা ভেবে নয়'টি বছর কাটিয়ে দিলাম। বিচ্ছেদের দিকে এক পা এগোলে তিন পা পিছিয়ে আসি। এবার ওদের সুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠবার কথা ভাবতে হচ্ছে। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নো ওয়ে। এটাই ফাইনাল। একজন উকিলের সাথেও কথা হয়েছে এ ব্যপারে।"

কথাগুলো বলার সময় রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ঝরে পড়ছিল যেন দু'চোখ বেয়ে। দিনের পর দিন অনিদ্রার শিকার প্রাণহীন চোখজোড়ায় চারপাশে কালো দাগ স্থায়ী হয়ে উঠেছে যেন। চা'য়ের কাপ হাতে বেলকোনীতে এসে বসি আমরা। কোন অযাচিত প্রশ্ন করি না। অন্যবারের মত উপদেশ কিংবা অনুরোধের ধার ধারি না। সূর্য তখন  খুব দ্রুতই টুপ করে হারিয়ে যায় দিগন্তের ওপাশে। সন্ধ্যা ঘনায়। নিরিবিলি এইদিকটায় হঠাৎ গাড়ির শব্দে নিচে রাস্তায় তাকাই। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর উস্কো চুলে উদ্ভ্রান্তের মত একজন নেমে এলো। গাড়ির শব্দে ব্যাকইয়ার্ড থেকে বা-বা বলে আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো দু'ভাই-বোন। জড়িয়ে ধরলো। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। আমি পৃথিবীর সবচাইতে তীব্র বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকি ! যেন কত জনম প্রতীক্ষার পর এই মিলন ! পিতার সাথে সন্তানদের মিলন।

শায়লা আমার দিকে তাকায়। আমি তাঁর দিকে। এই প্রথম শায়লার দু'চোখ বেয়ে অশ্রুজলের গড়িয়ে যাওয়া দেখি। যেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত। আমি উঠে দাঁড়াই। চলে আসবো বলে আলতো জড়িয়ে ধরি। ভারী নিঃশ্বাস কানে এসে লাগে। ছলছল চোখে এক পৃথিবী হতাশা নিয়ে শায়লা বলে, " তুমিই বলো, এদের আমি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করি কেমন করে ?"

আমারও নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। বাইরের মুক্ত বাতাসে এসে দাঁড়াই। সন্ধ্যার আকাশে একঝাঁক পাখি ডানা মেলে উড়তে উড়তে নীড়ে ফিরে যায়। পথের দু'ধারের ঝরাপাতা মাড়িয়ে আমিও ফিরি বাড়ি। আমাদের মাঝে অনেক মিল, তাই না ?

 

শায়লা'রা এভাবে নিজের সকল সুখ, আনন্দ বিসর্জন দিয়ে তিল তিল করে মরেও বেঁচে থাকে সন্তানদের কথা ভেবে। বিচ্ছেদের মত চূড়ান্ত কঠিন সিদ্ধান্ত'টি নিতে গিয়ে এক পা এগিয়ে গেলেও তিন পা পিছিয়ে আসে, সে-ও সন্তানদের কথা ভেবে। শায়লা'রা বারংবার হেরে গিয়েও বেঁচে থাকে।

 

স্বামী হিসেবে রহমান সাহেব ভালো না হতে পারেন, কিন্তু একজন বাবা হিসেবে ?

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ