সৈয়দপুর শহরেই হত্যা করা হয় ১৭৭জন রেলকর্মী, ৪১৩জন মাড়োয়ারী আর ১৩জন সাহিত্য
সংসদের সাংস্কৃতিকর্মীদের। ১৯৭১ এর এপ্রিল মাস ছিল এ শহরের হত্যাযজ্ঞের মাস।
সবচেয়ে বেশী বাঙ্গালীদের  স্বপরিবারে হত্যা করা হয় এই মাসে। মুক্তি যুদ্ধ
চলাকালে শহরের আশে পাশে গ্রামগুলোতে ভিটেমাটি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকবাহিনীর দোসররা।
‘ লড়কে লেঙ্গা ’ পাকিস্থানকে রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব তারাই পালন করেছিল লুটপাট, অগ্নিসংযোগ
ও নিরপরাধ বাঙ্গালী হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যতই এগিয়ে আসছিল ততই
তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল শেষ দিকে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল এবং পার্বতীপুর থেকে বহু বিহারী এসে এই
শহরে আশ্রয় নেয়, কারন পাশের সেনাছাউনির সহায়তায় তারা অনেকটা নিরাপদ বোধ করে।
মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস এই শহরের মত অরক্ষিত শহর সারা বাংলাদেশে আর ছিল না। শহরের অবরুদ্ধ
বাঙ্গালীরা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ পালিয়ে যেতে সমর্থ হন আবার কেউ কেউ মৃত্যু বরন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে কয়েকশত বাঙ্গালীকে সৈয়দপুর হাই স্কুল মাঠে জড় করা হয়। সেখানে তাদের
আটকে রাখা হয়। দিনের বেলা এয়ারপোর্ট তৈরীর কাজে লাগানো হত। কাজ দ্রুত করানোর জন্য চাবুক
চালাত। এই সব নির্যাতিত অনেকেই আজ ও বেঁচে আছেন। যারা ফিরে এসেছেন তারা দেখেছেন তার
সংসার নেই , কারও কারও বাড়ি পুড়ে ছাই, কারও বাড়িতে ছোপ ছোপ রক্ত। কেউ কোন স্বজনের লাশ
পান নাই। তারা কি আজও বেঁচে আছে? থাকলে কোথায় আছে? এখনও অপেক্ষা তাদের।
আকতার -- এখন বয়সের ভারে নূজ্য। আমি তার কাছে তার ৭১ এর স্মৃতি শুনবার জন্য গেলাম।
তিনি বললেন - আজ তো সময় দিতে পারব না আমি এক্ষুণি সীমান্ত ট্রেন ধরব।
আমাকে খুলনা যেতেই হবে। তিনি ভীষন ব্যাস্ত। তিনি চলে গেলেন। কথা হল তার দ্বিতীয় স্ত্রী যার
কেউ নেই, মুক্তিযুদ্ধে তিনি সবাইকে হারিয়েছেন, সব হারিয়েছেন। সৈয়দপুর পাওয়ার প্লান্ট
থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসার পর সুস্থ্য হলে তার সাথে আকতারের বিয়ে হয়।
এখানকার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে খুলনায়। সেই মেয়ে থাকে খুলনার কোন এক গ্রামে।
সেখানে বেড়াতে যায় আকতারের পড়শী অর্থাৎ সেই মেয়ের মা-বাবা। তারা খুঁজে পেয়েছে সেখানকার এক
লোককে যে দেখতে আকতারের ছেলের মত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই ছেলের বয়স ছিল ৫ বছর। আর
যে ভদ্রলোকের পোষ্য এই ছেলে সে বলেছে এই ছেলে তার পালক ছেলে। ৪/৫দিন পর
ফিরে আসে আকতার। না সে পায়নি। এই বাবার আকুলতা আমরা কিভাবে পুরন করব? কে জবাব দেবে?
এপ্রিল মাসে ১৪ তারিখে সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে সাব ডিভিশনাল ইঙ্গিনিয়ার
হাউজিং সেটেলমেন্টের স্ত্রী দুই সন্তানের জননী সুরাইয়া বেগম সহ প্রায় ছয় শতাধিক মহিলাকে জড়
করা হয়েছিল। এপ্রিলের ১১ তারিখে সুরাইয়া বেগমের স্বামী শহীদ ফজলুর রহমান, তার ভাই
এম,বি,বি,এস প্রথমবর্ষের ছাত্র রফিকুল ইসলাম, তার ভাগিনা দশম শ্রেনীর ছাত্র আনোয়ার
হোসেন, মালী রুহুল আমীন সহ মোট চারজনকে ধরে নিয়ে গুম করে দেয়।
শহীদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমান তৎকালীন আহসান উল্লাহ্ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ
করে সৈয়দপুরে আসেন চাকরীসূত্রে। তার অবাঙ্গালী ড্রাইভার এর বিশ্বাসঘাতকতায় তাকে তার
বাঙ্গালীপুর এর সরকারি বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গুলি করে হত্যা করে লাশ গুম
করা হয়। তবে জনশ্রুতি আছে যে তাদের লাশ অন্যান্য শহীদদের সাথে গণকবর দেয়া হয়।
অথচ গণপূর্ত গৃহ-সংস্থান অধিদপ্তরে যোগদানের পর তার তত্বাবধানে ঢাকার মহম্মদপুর,
মীরপুর,রাজশাহীর সাপুরা উপ-শহরের বিহারি/অবাঙ্গালীদের কলনীগুলি তৈরি হয়েছিল। সর্বশেষ শহীদ
হবার আগে পর্যন্ত তার তদারকিতেই সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এর মেরামত ও সম্প্রসারণের কাজ শেষ
হচ্ছিল।
১৩জুন ১৯৭১। ‘ মানুষ মানুষের জন্য এই সত্য সেদিন মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিল। সৈয়দপুর
থেকে চিলাহাটির পথে হলদিবাড়ি পৌছে দেবার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। তার আগে প্রানের
বিনিময়ে বানিজ্য হয়েছিল। সহায় সম্পদ নিয়েও তৃপ্ত হয়নি মানুষ রূপী হায়েনার দল।
ট্রেনের চারটি বগিতে ওরা ৪১৩জন উঠেছিলেন বাঁচার আশায়। সৈয়দপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার
মুহূর্তে ওরা পিছনে ফেলে যাওয়া স্মৃতির কথা ভেবে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন। ভাবতেও পারেননি কয়েক
মিনিটের মধ্যে মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করবে। সৈয়দপুরের অদূরে গোলাহাটায় এসে ট্রেনের চাকা থেমে যায়।
আচমকা খোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পরে নিরস্ত্র মানুষগুলির উপর। মুহূর্তেই ট্রেনের বগী ও তার
আশ পাশের মাটিতে নেমে আসে রক্তের ধারা। বিশ্বাসের চরম মূল্য নিল বিশ্বাসঘাতকেরা।
ওরা বাঙ্গলার পবিত্র মাটিতেই শহীদ হলেন। ওদের জীবনের বদলে পাওয়া স্বাধীনতা আমরা ভোগ
করছি।
সেই বধ্যভূমি থেকে বেঁচে আসা কয়েকজন মানুষের একজন তপন কুমার দাস। শুনব তার নিজের মুখে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
(চলবে)

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ