ঈদের দিন এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিচ্ছি আমরা অনেকগুলো পরিবার।

গল্পের এক পর্যায়ে একজন জানালেন দেশে তাঁর আত্মীয়ের কথা। পনের বছরের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় এক মায়ের কথা। ছেলেটি এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। আমার ছেলেটি দু'বছর বাদে পনের হবে। মায়ের মন। ভেতরটায় খামচে ধরলো যেন কেউ। জিজ্ঞেস করি, কেমন করে হল এক্সিডেন্ট ? বললেন, মোটর সাইকেল চালাচ্ছিল ঝড়ের বেগে।রাস্তার পাশের আইল্যান্ডে ধাক্কা লেগে উল্টে ছিটকে পড়ে বহুদূরে। হেলমেট অন্যকথাও গড়িয়ে যায়। মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে যায়। আমি এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে বলি, পনের বছরের ছেলেকে মোটর সাইকেল কিনে দিলো ! তিনি বললেন, এটিই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল আমার আত্মীয়ের।

আমার এখনো পরিস্কার মনে আছে বিশ বছর আগে আমি যখন এই নিউইয়র্কে নতুন, তখন আমার একটি প্লাস্টিকের পিগি ব্যাংক ছিল। সেটাতে আমি পয়সা জমাতাম। বাইরে গেলে পানি কিনে খেতে চাইতাম না। ভাবতাম, বাংলাদেশী টাকায় চল্লিশ টাকা ! থাক্‌না, বাসার দিকেই তো যাচ্ছি, গিয়েই খাবো না হয়। এহেন কৃচ্ছতা সাধনের দিনে একদিন ছোটভাইয়ের চিঠি আসে__ " রিমি,তুই আমাকে একটি মোটর সাইকেল কিনে দিবি ? দাম ... এতো লাখ "। টিনএজ একমাত্র ভাই। আমার তো আর আব্‌দার করার কেউ নেই। চিঠি পড়ি একবার, দুইবার, বারবার। চোখ ভিজে আসে। সেই ছোটবেলা থেকেই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে যাকে আমি এটা সেটা কিনে দিতাম। হোস্টেলে ডায়নিং এর পয়সা বাঁচিয়ে একবার বঙ্গবাজার থেকে শার্ট কিনে দিয়েছিলাম জন্মদিনে। আর এখন তো বিদেশে থাকি ! আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিলো। রাতের আঁধারে একা একা ক্লোজেট থেকে পিগি ব্যাংক বের করে আনি নিঃশব্দে। এতদিনের তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় গুনি। মাত্র তিনশো ঊনচল্লিশ ডলার ! এ যে ওর চাহিদার ধারে কাছেও নয়। সমস্ত রাত নির্ঘুম কেটে গেলো। ইশ্‌ , যদি দিতে পারতাম ! কামালকেও বলা যাচ্ছে না। আত্মসন্মানের ব্যাপার। সেই রাতে আমি ছোটভাইয়ের প্রতি অন্ধ স্নেহ, মায়া আর ভালোবাসায় পুড়ে গিয়েছিলাম একাকী, বহুবার।

দুপুরে খাবার টেবিলে কামাল জানতে চাইলো চিঠির কথা, কি লিখেছে ? এবার একটু ভরসা পেলাম। সাহস সঞ্চয় করে বললাম। সব শুনে সে বলল, " ওকে এই সময়ে মোটর সাইকেল কিনে দেওয়া মানে, ওর ক্ষতি করা। পুরো পরিবারের সর্বনাশ ডেকে আনা।" বিস্তারিত বুঝিয়ে বলল। আমার দীর্ঘ একটি রাতের দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার নিমেষেই উবে গেলো। এই সহজ সত্যটি একবারও মনে আসেনি। অন্ধ মমতা আমাকে অন্ধ করে রেখেছিলো। সেইদিন থেকে বুঝতে শিখেছিলাম, অন্ধভাবে মায়া, মমতা দেখিয়ে কোন অন্যায় কিংবা ভুলকে প্রশ্রয় দিতে নেই।

আমি আমার সন্তানদের বেলায়ও এ বিষয়ে কঠোর এবং সচেতন।

রিয়াসাতের যখন ৭/৮ বছর, স্কুল থেকে ফিরবার সময় একদিন চিপস খেতে চাইলো। চিপসটি ঝাল এবং নোনতা বলে তাঁর দাদুর কড়া নিষেধ এটি খাওয়ার ব্যাপারে। এতটুকুন ছেলে আমার। বলে, দাদু তো দেখবে না ! আমি কড়া ভাষায় জানিয়ে দেই, যেটা দাদু নিষেধ করেছে, সেটা আমি কোনভাবেই তোমাকে দিতে পারবো না। আমার সন্তানরা ওইভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাঁদের দাদু কোন বিষয়ে "না" বলেছে তো আমরা সবাই সেই "না"তেই থেকেছি। আবার একই ভাবে আমি কোন বিষয়ে "না" বলেছি তো তাঁদের বাবা এবং দাদুও সেই "না"তেই অটল থেকেছে। কখনোই অতি আল্লাদ দিয়ে কেউ বলেনি, "থাক না দিলে কি হবে, কিংবা একদিন খেলে কিছু হবে না "। অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে আমি তাঁদের বেয়াড়া হয়ে উঠবার সুযোগ করে দিতে চাইনি।

বেশীরভাগ টিনএজ ছেলেদেরই সম্ভবত একটি মোটর সাইকেল কিনবার স্বপ্ন থাকে। একটি বয়সে তাঁরা স্বপ্ন দেখে বাইক চালিয়ে ঝড়ের বেগে উড়ছে। স্বপ্নের দেশে যাচ্ছে। জীবন কি আসলেই এমন স্বপ্নময় ? জীবনের পথ আঁকাবাঁকা। কাঁটা বিছানো। কষ্ট করে একটি একটি কাঁটা তুলে সে পথ চলতে হয়। এই ভিনদেশে অনেক অবিভাবককেই কাছ হতে দেখেছি, তাঁরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সন্তানদের সঠিক পথটুকু চিনিয়ে দিতে। জানিনা, আমরাও চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। বাকিটুকু সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম।

"ফারদিন হুদা মুগ্ধ নামের সবে এস এস সি পাশ করা ছেলেটিকে ক'দিন আগে তাঁর বাবা পাঁচলক্ষ টাকা দিয়ে মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। এখন আবার নতুন আরেকটি দরকার। পায়নি বলে বাবা-মা'কে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা " __ খবরটি দেখেছি। ভীষণ পীড়াদায়ক, অস্বস্তিকর। ভাবায় বটে !

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ