-সিগারেটের ছাই ও একটি জোড়া লাগা প্রেম-

রাত দুইটা বাজে। ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ ভেসে আসছে। জালানা দিয়ে হালকা চাঁদের আলো ঘরের টেবিলটার উপর আছড়ে পরে রুপালী রং ধারন করল। টেবিলের উপর সিগারেটের একটা প্যাকেট রাখা আছে। শাপলা ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেল ওর। বিছানায় থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিল টেবিলটার উপর। অন্ধকারে হাতরে খুজল সিগারেটের প্যাকেটটা। না পেয়ে টর্চলাইট জালাল। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখল একটাও সিগারেট নেই তাতে। সন্ধ্যার সময় এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিল। তাতে ২০ টা সিগারেট ছিল। এখন একটা সিগারেটও নেই। কখন যে শেষ হয়ে গিয়েছিল নিজেও মনে করতে পারছেনা শাপলা। একটা শার্ট কোন মতে গায়ে পেঁচিয়ে বাইরে আসল। সব দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় মানুষের ছায়াও দেখা যায় না। ঘুম আসছে না শাপলার। একটা সিগারেট না খেতে পারলে মাথাও পরিস্কার হবেনা আর ঘুমও আসবেনা। পরের দিন সকালে দুই প্যাকেট আর সন্ধ্যায় দুই প্যাকেট সিগারেট কিনল শাপলা। প্রতি প্যাকেটে ২০ টা সিগারেট।

**********************************

সন্ধ্যায় কচিং থেকে বাসায় ফিরল শাপলা। একটা বাসায় একা একা থাকে। যদিও তাতে খরচ বেশি হয়। ওর একা থাকতেই ভাল লাগে। আপন মনে সিগারেট টানতে পারে, কারো সমস্যা হয়না, বাধা দেওয়ার কেউ থাকেনা।

শাপলা সিগারেট টানার সময় একটা খেলা খেলে প্রতিদিন, ছাইগুলো দিয়ে টেবিলের উপর দারুন নকশা আকে। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। শাপলা সবচেয়ে ভাল আকতে পারে কাকের আর বাদুড়ের ছবি।

শাপলা সিগারেট টানছে আর আপন মনে ম্যাচের কাঠির সাহায্যে টেবিলের উপর ছবি আকছে। প্রথমে একটা কাকের ছবি আকল, ভাল হয়নি। এবার আকল একটা বাদুড়ের ছবি। টেবিলের উপর চমৎকার দেখাচ্ছে বাদুড়ের ছবিটা। একদম বাস্তব মনে হচ্ছে। সিগারেটের ছাই দিয়ে ছবি আকা শাপলার শখ নয়, বরং অভ্যাস। রাতের সব কাজ শেষ করে, একটা সিগারেট টেনে ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুমানর আগে টেবিলের উপরে জমে থাকা ছাইগুলো পরিস্কারও করলনা। মাঝ রাতে কিছু একটার শব্দ পেয়ে শাপলার ঘুম ভেংগে গেল। শব্দ পরিস্কার ভাবে শোনার আগেই থেমে গেল। শাপলা আবার শুয়ে পড়ল। চোখে একটু ঘুম ঘুম আসছে এমন সময় আবার শব্দটা শুনতে পেয়ে উঠে বসে পড়ল। পরিস্কার ভাবে শোনার চেষ্টা করল শব্দটা। শাপলা শব্দ শুনে বুঝতে পারল উড়ন্ত বাদুড়ের পাখার শব্দ। শাপলা গ্রামের বাড়িতে রাতের বেলা বাদুর উড়তে দেখেছে কিন্তু শহরে কোনদিন তা দেখেনি। শাপলা জালানা দিয়ে বাইরে তাকাল। দেখল একফালি চাদের আলোয় চারপাশ পরিস্কার দেখাচ্ছে। শাপলা একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে শুরু করল। এবার শব্দটা খুব জোরে শোনাতে লাগল। শাপলা জ্বালানা দিয়ে আবার উকি মারল। দেখল, বাইরে একটি বাদুড় উড়ে বেড়াচ্ছে। চাদের রুপালী আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা শাপলার কাছে অদ্ভুত মনে হল। ভাবল, বাদুরটা শহরের দালান কোঠার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে কেন? আসে পাশে কোথাও ফলগাছ নেই যে ফল খেতে আসবে! হতে পারে বাদুরটা হয়ত পথ হারিয়ে ফেলেছে। শাপলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। হঠাৎ ধুপ করে একটা শব্দ পেল। চোখ মেলেই অন্ধকারে টেবিলের উপর কালো কাপড়ের টুকরার মত দেখতে পেল। চাদের হালকা আলোয় অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। শাপলা উঠে লাইট জালিয়ে দেখল, টেবিলের উপর একটি বাদুর নড়াচড়া করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাদুরটা জালানা দিয়ে উড়ে চলে গেল। শাপলা জালানাটা আটকে দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে শুরু করল। হঠাৎ খেয়াল করল টেবিলটা একদম পরিস্কার, একটুও সিগারেটের ছাই নেই। অথচ রাতে সিগারেটের ছাই না পরিস্কার করেই ঘুমিয়ে পরেছিল শাপলা। একটা বাদুরও আকাছিল ছাই দিয়ে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা শাপলা। ভয়ে ঘুম আসছেনা ওর। তাই সিগারেট ধরাচ্ছে আর একভাবে টেনে চলছে যাতে ভয় কম লাগে। একটু একটু তন্দ্রা আসে শাপলার। আবার চোখ খোলা রেখে তাকানোর চেষ্টা করে। বাইরে কাকের কা কা শব্দ শোনা গেল। কিন্তু জালানা খুলে বাইরে তাকানোর মত সাহস নেই শাপলার। হঠাৎ বুকে যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায় শাপলার। ব্যাথাটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শাপলা দুই হাত দিয়ে নিজের বুক চেপে ধরে। চিৎকার করার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। হঠাৎ দেখল বন্ধ জালানাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। ছায়ার মত বড় একটা বাদুর ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। আস্তে আস্তে বাদুরটা শাপলার কাছে এগিয়ে আসছিল। শাপলা ঝাপসাভাবে দেখছিল সবকিছু। হঠাৎ খাট থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল ও। একপর্যায় বাদুরটা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। শাপলা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। পুলিশ শাপলার লাশটা ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠাল। দুইজন লোক লাশ কাটার দায়িত্ব পালন করছে। দুজনেরই মুখ বাঁধা, চেহারা দেখা যায় না। একজন লাশ কাটছে। অন্যজন অর্থাৎ লাশ কাটার সহকারী দাড়িয়ে আছে লাশ কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে। প্রথমজন বলছে, লাশের ভিতরেতো দেখছি কিছুই নেই।
দ্বিতীয় জন অর্থাৎ সহকারী চমকে উঠে বলল, কিছুই নেই মানে? প্রথমজন বলল, ছাইয়ে ভরা, সব সিগারেটের ছাই। দ্বিতীয় জন বলল, মনে হয় সিগারেট খেত ছেলেটা। প্রথমজন দ্বিতীয় জনকে ফুসফুসটা দেখিয় বলল, দেখেছ লাঞ্চের অবস্থা, অর্ধেক পুরে গেছে, বাচবে কি করে? দ্বিতীয়জন বলল, লিভারের কি অবস্থা? প্রথমজন লিভারটা পর্যবেক্ষন করে দেখে বলল, কাল হয়ে গেছে, হয়ত লিভার ফাংশনে সমস্যা ছিল।
দ্বিতীয়জন বলল, হার্টের কি অবস্থা?
প্রথমজন বলল, হার্টটা ভাল আছে ঠিকই কিন্তু একদম শুকিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেল শাপলার। বুক ধরবর করে কাপছে। ঢকঢক করে তিন চার গ্লাস পানি পান করল। একটু স্বাভাবিক হয়ে বাইরে তাকাল। দেখল, মিষ্টি রোদ উঠেছে, একদল কাক কা কা শব্দে বিল্ডিংয়ের এ ছাদ থেকে ও ছাদে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ১০ টা বাজে। শাপলা ভাবল, কি সব স্বপ্ন দেখলাম সারারাত। সিগারেটের প্যাকেটে ৬ টা সিগারেট অবশিষ্ট ছিল। জালানা দিয়ে ছুরে মেরে ফেলে দিল। টেবিলের উপরের বাদুড়ের ছবি আকান আছে ছাই দিয়ে। সব ছাই পরিস্কার করে বাইরে ফেলে দিল। পুরানো প্রেমিকার ফোন নাম্বার টা খুজে বের করল, যে প্রেমিকার সাথে দীর্ঘদিন কোন কথা হয়নি। ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে, একটা ভুল বোঝা বুঝির কারনে। সেই থেকে সিগারেটে খাওয়া শুরু করেছিল শাপলা। এখন শাপলা বুঝতে পারছে মানুষের জীবনে প্রেমের বিকল্প সিগারেট হতে পারেনা। সিগারেট বা নেশা মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে আর প্রেম জীবন গড়তে পারে। ফোন করল শাপলা,

:হ্যালো জুই।
:হ্যা, আপনি কে বলছেন?
:আমি শাপলা।
:এতদিন পরে কি মনে করে?
:আমি আবার আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চাই।
:সম্পর্ক কি সেলাই মেশিন নাকি যে যখন দরকার ব্যাবহার দরকার না হলে ফেলে রাখলাম।
:আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম এটা ঠিক, তাই বলে তুমি আমাকে ভূল ভাংগানর চেষ্টাও করলে না।
:তুমি যেমন জেদি ছিলে আমি তেমনি ছিলাম।
:আমারতো এখন জেদ ভেংগে গেছে, তোমার কি ভাংবেনা।
:দেখ শাপলা আমি বিয়ে করে ফেলেছি। আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেনা।

লাইনটা কেটে গেল।
শাপলা আবার অনেকবার ফোন করার চেষ্টা করে। কিন্তু জুই রিসিভ করছেনা।
শাপলা বাসাটা ছেড়ে দিয়ে একটা নতুন মেছে উঠল যেখানে কেউ সিগারেট খায়না। পড়াশুনায় মনযোগ দিতে শুরু করল। যখন কিছু ভাললাগেনা, পেপার পত্রিকা পড়ে, গল্প উপন্যাস পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটায়।

হঠাৎ একদিন জুইয়ের ফোন আসল।
:হ্যালো জুই, কেমন আছো?
:হ্যা আমি সবসময়ঈ ভাল থাকি, আর তোমার কাছে ফোন করেছি প্রেম আলাপ করতে নয়, তোমার দেয়া উপহার গুলো ফেরত দিতে চাই। কাল চারটার সময় পার্কে চলে এসো।

পরের দিন দুইটার সময় পার্কে গিয়ে বসে রইল শাপলা। অপেক্ষা করতে লাগল জুইয়ের জন্য। অনেকদিন পর দেখা হবে। ভাবতেই ভাল লাগছে শাপলার। চারটা বেজে গেছে কিন্তু জুইয়ের আসার নাম নেই। শাপলা ফোন করল। কিন্তু ফোনও সুইচ অফ দেখাচ্ছে। শাপলা তারপরেও অপেক্ষা করছে, ফোন করছে কিন্তু ফোনের সুইচ অফ দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিন্তু জুইয়ের আসার কোন লক্ষন নেই। জুইয়ের ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। শাপলা পার্ক থেকে বেরিয়ে হাটতে শুরু করল, সোজা বাসায় যাবে ও। হঠাৎ জুইয়ের ফোন আসল।

:কি ব্যাপর তুমি চলে যাচ্ছ কেন? দাড়াও এখনই আসছি আমি।
বলেই ফোনটা কেটে দিল জুই। একটু পরেই জুই শাপলার সামনে এসে দাড়াল আর বলল চল পার্কের ভিতরে গিয়ে বসি।
দুজনেই কিছুক্ষন চুপ চাপ থাকার পর জুই বলল, তোমাকে ৪ টায় আসতে বলেছিলাম, ২ টার সময় আসলে কেন?
শাপলা মাথা নিচু করে বসে আছে। আস্তে বলল, এমনি। জুই বলল, ওই যে দোতলা বাসাটা দেখছনা, আমরা এখন ওটায় থাকি। তুমি আসার পর থেকে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছিলাম।
শাপলা কোন দিকে তাকাল না। কিছুক্ষন দুজনে চুপ থাকার পর জুই আস্তে করে বলল, শাপলা তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও। শাপলা যেন চমকে উঠল জুইয়ের কথা শুনে। ও গভীর দৃষ্টিতে জুইয়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। জুই একটু মুচকি হেসে বলল, আমার বিয়ে হয়নি।
একটা লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, পার্ক থেকে সবাই বেরিয় যান, গেট আটকে দেব। পার্কের সবাই পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত বারটার পরে ঘুমিয়ে পরল শাপলা। একজন ডাক্তার এসে শাপলার শারিরীক অবস্থা পরিক্ষা করছে। ডাক্তার বলল, ছেলেটার কোন রোগ খুজে পাচ্ছিনা। হার্টটাও যথেষ্ট সুস্থ মনে হচ্ছে।
শাপলার আনন্দময় জীবনের সূচনা ঘটল, আবার।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ