স্বামী-স্ত্রী'র মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি হল দিনভর। বন্ধু হিসেবে আমাদের অনুরোধ জানানো হল নিষ্পত্তির জন্যে। সন্ধ্যার কিছু পরে যাই বাড়িটিতে। দরজা খোলেন স্ত্রী। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। চোখ ফোলা। বুঝা যাচ্ছে, প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন। লিভিংরুমের জিনিষপত্র তছনছ, ছড়ানো ছিটানো। শিশু দু'টি আতংকিত চেহারায় সোফার একপাশে গায়ে গা ঘেঁষে বসে। বিবাদের বিষয়বস্তু এক এক সময় এক এক রকম। ছোটখাটো কথা কাটাকাটি চরম রুপ ধারন করে তখনই, যখন সেই সময়টাতে স্ত্রী বারংবার স্বামীকে মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ বলতে থাকে। স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁকে মিথ্যে বলে বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে বলেছে স্বামী এদেশে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু এসে দেখে সব ভুয়া। আমরা স্বামীটির দিকে তাকাই। এবার সে মুখ খোলে। উল্টো যুক্তি__ আমি না হয় মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ। তোমার পরিবার লোভী, বিদেশে আসার লোভে খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়েছে রাতের আঁধারে।
এমনটি প্রায়ই হয় পরিবারটিতে। এখন আর এপার্টমেন্টের অন্য কোন প্রতিবেশী সেইসব বিরোধ নিস্পত্তি করতে এগিয়ে আসে না। শুনেছি ইদানিং পুলিশ ডাকাডাকি হয়। ইতিমধ্যে তাঁদের কড়াকড়িভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ পরিণতি শেষ অবধি কি হবে, জানা নেই।
......
আমার বিদেশের প্রথমদিকের সময়গুলোতে সবে ডাক্তারি পাশ করা দূর সম্পর্কের এক বড়ভাই মাঝে মাঝে চিঠি লিখত। ঘুরেফিরে চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, "যে করেই হোক আমেরিকান সিটিজেন পাত্রী দেখে দাও। পাত্রী যেমনই হোক সমস্যা নেই। আমাকে বিদেশে যেতেই হবে, উচ্চতর পড়াশোনা করতেই হবে, নরমাল এম বি বি এস দিয়ে আজকাল কিচ্ছু হয় না।" এই ভিনদেশে আমি নিজেই তখন নতুন, পাত্রী খুঁজবো কোথায় ! অবশেষে একদিন শুনি সত্যিই তিনি বিয়ে করেছেন। পাত্রী বাংলাদেশী আমেরিকান। ডাক্তার সাহেবদের জন্য পাত্রীর অভাব হয় না। এদেশে এলেন দ্রুততম সময়ে। আমরা খুশি হই। ভাবি, মানুষ আসলেই মন থেকে কিছু চাইলে সৃষ্টিকর্তা তাঁকে ফিরিয়ে দেন না। বছরখানেক বাদে পরিবারটির আমন্ত্রণে তাঁদেরই বাসায় দু'দিনের জন্য বেড়াতে যাই অন্য রাজ্যে। এখানে ওখানে ঘুরাফেরার সময়টাতে দেখি ছোটখাটো বিষয়ে হুটহাট লেগে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। স্বামী কথায় কথায় স্ত্রীকে মূর্খ, অশিক্ষিত বলে ধমকাচ্ছে। স্বল্প পড়াশোনা জানা স্ত্রী'টি আমাদের সামনে ভীষণ অপমানিত বোধ করতে থাকেন। সে-ও স্বামীকে শিক্ষিত লোভী বলতে ছাড়েননি। অতঃপর সেই বিবাদ এক পর্যায়ে অকথ্য ভাষায় রুপ নেয়। আমাদের সে বেড়ানো সুখকর ছিল না। কাউকে অসুখী দেখার মাঝে কোন সুখ নেই।
......
কাল হঠাৎ একটি মেসেজ এলো ফোনে __ "একটু হেল্প করতে পারো ? একটি রুম খুঁজছি, সাহানা "। আমি চম্কে উঠি। এতদিন পর ! আমার পুরনো কলিগ। নাম্বারটিতে ফোন করি। জানলাম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে দু'বছর হয়। ওদের বিয়ে হয়েছিল ফোনে। অনেকদিন পর জানলো, স্বামীর এদেশে বৈধ কাগজপত্র নেই। বড়লোক বাবা নিজ খরচে, নিজ চেষ্টায় এদেশে পাঠিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ সাহানাকে। কিন্তু এখানে আসার পর আরও চমক। আগে জেনেছিল শ্বশুর মারা গিয়েছে। এখানে আসার পর জানলো শ্বশুর আসলে সংসার করছে অন্য নারীকে নিয়ে। অর্থাৎ ব্রোকেন ফ্যামিলি। আরও অনেক কাহিনী। এত মিথ্যে মেনে নিয়ে তো আর সংসার হয় না ! সেই থেকে একলা পথ চলা বড়লোক বাবার শিক্ষিত কন্যাটির।
পৃথিবীটা অসাধারন সুন্দর একটা জায়গা। মিথ্যে কিংবা লোভ, দু'টিই কুৎসিত। সত্যের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, সুখের কিছু নেই। বিদেশ মানেই রাশি রাশি সুখ নয়। কখনো কখনো গোটা একটি জীবন দহন, ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৬টি মন্তব্য
ইকরাম মাহমুদ
মিথ্যের একজোড়া পাখার চেয়ে সত্যের একটা পালকও অনেক কিছু।
রিমি রুম্মান
অল্পতেই সুন্দর বলেছেন।
শুভকামনা রইলো।
ব্লগার সজীব
আপু একটি আস্ত জীবন যার সাথে কাটাতে হবে, তার সাথে মিথ্যে এবং লোভী হয়ে সম্পর্ক করা উচিৎ না। বিদেশে থাকার, যাবার লোভে এমন অনেকেই করেন। অনেকেই আছেন যারা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়ে আজীবন অসুখী জীবন কাটান। কিছু ভেংগে যায়।
আপনার এই লেখায় অনেক কিছুই শেখার আছে।
রিমি রুম্মান
বিদেশে না এলে জীবনের বিচিত্র এই অংশটুকুন দেখা হত না, জানা হত না।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল।
রুম্পা রুমানা
বাস্তবতা বড় কঠিন । সুখী হওয়া অতো কি সহজ । অনেক কঠিন , অনেক ।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। বাস্তবতা আসলেই অনেক কঠিন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মিথ্যের উপর গড়া ভীত সব সময়ই নড়বড়ে থাকে। যতো রুঢ়ই হোক সত্যটাই শান্তি এবং স্বস্তি দেয়।
জীবনের ছোট ছোট গল্প শুনতে ভালো লাগে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। মানুষ দিক নির্দেশনা পায়।
আবারও বলি, আপনার লিখার আড়ালে ম্যাসেজ থাকে, যা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে।
আজকের লিখা থেকে মনে করি যারা পড়বে সবাইই সত্যাগ্রহী হবে। -{@
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যে উৎসাহিত হই লিখতে। চারিপাশে কত কি দেখি ! সময় পেলে লিখতে চেষ্টা করি। বাস্তবতা, জীবন এসব আসলেই গল্প উপন্যাসের মতন সহজ, সুন্দর নয়। তবুও আমাদের ভাল থাকা অনেকাংশে আমাদের নিজেদের উপরই নির্ভর করে। লোভ কিংবা মিথ্যা জীবনকে আরও জটিল করে তোলে।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল।
ছাইরাছ হেলাল
সুখ সোনার হরিণ, এত সহজে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেবে তা ভাবা ঠিক না,
লোভ শান্তির পথে অন্তরায় বরাবরই।
রিমি রুম্মান
আমাদের চারিপাশটা সুন্দর রাখা কিংবা সুখের করে রাখা অনেকাংশেই আমাদের উপর নির্ভর করে। মিথ্যে কিংবা লোভ জীবনকে জটিল করে তোলে।
ভাল থাকুন। নিরাপদ থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
আফসোসের কথা বিদেশের এতকিছু জানানোর পরেও এখনো অনেকেই কোন খোঁজখবর না করেই বিয়ে দিচ্ছেন, করছেন।
তবে সংসারে এতসব অশান্তির কারন শুধু এটুকু নয়, আরো অনেক বলেই মনে হয়।
পৃথিবীটা সুন্দর, আমরা এমনটা দেখতেই ভালোবাসি।
রিমি রুম্মান
মিথ্যের উপর যে পথ চলা শুরু, সে পথ কখনোই মসৃণ নয়। যে কোন কারনেই অশান্তি নেমে এলে একে অপরকে সেই অবিশ্বাস আর মিথ্যেটুকুন মনে করিয়ে দেয়। আর এতে জীবন আরও বিষিয়ে উঠে।
নীলাঞ্জনা নীলা
সোনার হরিণের পেছনে ছোটে সবাই। মেয়েদের বাবারা পাত্র খোঁজে বিদেশী। আবার ছেলেরা পাত্রী খোঁজে বিদেশী।
তার পরিণতিতে কতো কিছু যে ঘটে যায়। এসব কতো যে দেখেছি। তাও হুঁশ হয়না।
লোভের পরিণতি ধ্বংস। আর মিথ্যের উপর ভিত্তি করে কোনো সম্পর্ক টিকে থাকেনা।
দাম্পত্য জীবনে অশান্তির সৃষ্টি হয় এই মিথ্যে থেকেও।
বাঁধনে বাঁধা থাক সুন্দর সম্পর্ক। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
রিমি রুম্মান
এই বিদেশে না এলে কত কি জানা হত না। দেখা হত না মানুষের জীবনের এই জটিল অংশটুকু।
ভাল থেকো প্রবাসে, নীলা’দি।
নীলাঞ্জনা নীলা
তুমিও ভালো থেকো রিমি আপু।
ইঞ্জা
আমরা বাঙ্গালী বিয়ে অর্থে মিত্যার আশ্রয় নিই, ছেলে মেয়ে কম পড়ালেখা তাহলে তাদের কমছে কম ডিগ্রী ধারী করে দাও, ছেলে বিদেশে গেছে তাকে ওখানকার সিটিজেন বলো কিন্তু আমরা চিন্তা করিনা ভবিষ্যতে যখন জানবে তখন কি হবে আর আপনিই পরিণতির কিছু সত্য চিত্র তুলে ধরেছেন, তবুও আমাদের শিক্ষা হবেনা। 🙁
রিমি রুম্মান
চারিপাশে এমন কত ঘটনা দেখি। সত্যটা জানার পর একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ থাকে না আর। অবিশ্বাস আর সন্দেহ নিয়েই কাটে বাকিটা সময়। বিবাদ হয়তো হয়েছে অন্য কারনে, কিন্তু কথায় কথায় সেই পুরনো মিথ্যা আর ধোঁকাবাজির জন্যে কথা শুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ইঞ্জা
সহমত
মৌনতা রিতু
আমরা চারবোন। আমার ফুফাত ভাই ওর বন্ধুর জন্য একবার প্রস্তাব আনল, ছেলে পরিবেশ বিষয়ের উপর গবেষনা করছে। জার্মানে ছিল।এখন বুলগেরিয়াতে আছে। ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। আব্বা প্রথমেই বলে দিল, মোটেও না। ঐ ছেলে সারাদিন, বই নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। মেয়ে কি টাকা আর চার দেয়ালের সাথে কথা বলবে !”
রিক্তার জন্যও এসেছিল। আব্বা কখনোই কারো ব্যপারেই রাজি হয়নি। আব্বা বলত,” জীবনটক দুই দিনের ও না আবার অনন্তকালের ও না। এখানে একটু সুখ অনেক বড়”। এই তো চলে যাচ্ছে। তবে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে। তাই পৃথিবীর সব প্রান্তেই যখন তখন ফোনের স্কিনে তাদের দেখা যাচ্ছে।
আর সুখ আসলে দেশে হোক কি বিদেশে হোক, কোথাও না থাকলে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
রিমি রুম্মান
আমার আব্বাও বিদেশ থাকে এমন পাত্র শুরুতেই নাকচ করে দিতে দেখেছি, তা সে যত যোগ্যতাসম্পন্নই হোক না কেন। কিন্তু কপালের লিখন খণ্ডাবে কে ? আমরা দু’জন একই দিনে একই সাথে প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখি।
ব্লগার সজীব
কত দিন পরে এত কষ্ট করে একটি পোষ্ট দেই, আমার লেখা আপনি পড়েন না 🙁 ;(
রিমি রুম্মান
আহা রে , আমার নজরে আসলে তো পড়ি। কোন কারনে পিছনে পরে গিয়েছে হয়তো । সরি।
ক্রিস্টাল শামীম
বিদেশ মানেই রাশি রাশি সুখ নয় এই কথাটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আর একটা সত্য এই সমাজকে বদলে দিতেপারে। নিয়ে আসতে পারে কল্যাণের দিকে।
রিমি রুম্মান
এইসব ভুল ভ্রান্তি গুলো নিয়ে আরও বেশি বেশি লেখা উচিত। এতে হয়তো কেউ না কেউ সচেতন হবে।
ভাল থাকুন। শুভকামনা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
পৃথিবীটা অসাধারন সুন্দর একটা জায়গা। মিথ্যে কিংবা লোভ, দু’টিই কুৎসিত। সত্যের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, সুখের কিছু নেই। বিদেশ মানেই রাশি রাশি সুখ নয়। কখনো কখনো গোটা একটি জীবন দহন, ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা।
আর পরাধীনতার মাঝে সূখ বলতে কিছু থাকে….. -{@
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন, সুখে থাকুন।
শুভকামনা।