যৌতুকের বলি ৮ম পর্ব

মনির হোসেন মমি ২৩ মার্চ ২০১৫, সোমবার, ০৪:১৫:৫৮অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

বিশ্বে মানব জাতির মধ্যে নারী জাতকে সমীহ কিংবা সম্মান দিয়ে কথা বলতে কারো কোন দ্বিধা থাকার কথা নয় কেননা নারী হলো প্রথমে আমাদের মা জাত পরবর্তীতে অবস্থার পরিপেক্ষিতে তার অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন।সম্পর্কে এ ভিন্নতর অবস্থার মধ্যে নারীর বিবাহ জীবনটি জীবনেরই একটি গুরুত্ত্বপূর্ন চরিত্র।এক জন নারী যদি সাবালক কিংবা অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সময়ে কিংবা যে সময়ে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন না কেনো আমরা অনেকেই ভূলে যাই, যে মেয়েটি আজ আত্ত্বার আত্ত্বীয়তার নারী ছিড়ে সম্পূর্ণ অজানা অদেখা কিংবা ভাবের আদান প্রদান না হওয়া অপরিচিত একটি ছেলের সাথে রাত -দিন কাটাতে আসছে যুগের পর যুগ আজীবন আমৃত্যু সেই ছেলেটি কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের ভাবা উচিত কোন আশায় কিসের মোহে কিসের নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে মেয়েটি আজ পুত্রবধু সেজে তাদের সংসারে এসেছেন কেবল কি সামাজিক দায় সারতে?অবশ্যই না একটি শক্ত বন্ধন সৃষ্টি করতে মেয়েরা পরের ঘরে যায় যেখানে ছেলে স্থির বলবদ তার পিতৃ গৃহে।
নব বিবাহিত মেয়েরা প্রথম প্রথম তার শশুড়বাড়ীর কাউকেই তেমন আপন করে নিতে পারেন না,তাদের কেবল মনে পড়ে তার পিতৃগৃহের কার্যকলাপ, মায়ের মমতা, পিতার স্নেহ, ভাইয়ের আদর। শশুড় বাড়ী যতই আপন হউক তার বেশ কিছু দিন মন বিষিয়ে থাকে শশুড় বাড়ীর প্রতি এবং ভাবতে থাকেন সর্বক্ষন যদি তার বাপের বাড়ী হতে কেউ একজন এসে তাকে নিয়ে যেত.....মন যেতে যায় বার বার বাপে বাড়ী।
হয়তো এই কারনেই মেয়েরা রাগ করলেই কথায় কথায় বলেন, বাপের বাড়ী চলে যাবেন।তবে সময়ের অতিক্রমে মেয়েদের জীবনে অনেক কিছুই বদলে যায় কিংবা বদলায়।পর এক সময় অতি আপন হয়ে যায়।ঠিক যেনো গৃহ কর্তা কোন গরু পোষেন সেই গরু প্রথম অবস্থায় কর্তার কোন অর্ডারই মানতে নারাজ কেবল হুংকারের পর হুংকার দিতে থাকে আর সেই গরু যখন কর্তা মানুষটির সাথে দীর্ঘদিন জীবন যাপন করে তখন সে ধীরে ধীরে কর্তার হুকুমে অভ্যাস্থ হতে থাকে,এক সময় কর্তা ছাড়া গরুটি কাউকে আর চিনে না।এটাই বাস্তব এটাই মায়া।তেমনি মেয়েদের বিবাহের পর অসহ্য অবিস্বাস ধীরে ধীরে চলে গিয়ে এক সময় স্বামী ছাড়া মেয়েরা আর কাউকেই তেমন চিনেন না,তেমন করে হৃদয়ের আসনে স্থান দেন না আর এটাই হচ্ছে স্রষ্টার সৃষ্টির মনুষত্ত্বের প্রকৃত উদাহরণ।

তাই ভাবতে হবে বুঝতে হবে অসহায়ে মেয়েরা কত কিছু ত্যাগের পর পরকে আপন করেন।সে জন্যই নারীদেরকে স্রষ্টা নিজেই মা জাতের আসনে বসিয়ে ভূয়োসি প্রশংসা করে তাদেরকে পুরষের চেয়েও বেশী সম্মান দিয়েছেন।কোন এক হাদিসে আছে যে,কার পায়ের নীচে বেহস্ত?বার বার তিন বারই বলেছেন মা মা এবং মায়েদের পায়ের নীচেই সন্তানদের বেহস্ত।
যাক মুল গল্পে আসি:...

শেষ পর্যন্ত পিতা আলমাছ তার একমাত্র কন্যাকে মোড়লের ছেলে আকমলের হাতে তুলে দিলেন।ফুলী পালকিতে চড়ে আপনকে পর করে পরকে আপন করতে চলে গেলেন শশুড় বাড়ী।স্বামী আকমলের পরিবারে, মা বাবা, বড় এক ভাই ভাবী তাদের ঘরে একটি চার পাচ বছরের কন্যা,এক বিয়ের বয়সী ননদী এবং এক কলেজ পড়ুয়া দেবর।
ঘরের দুএকজন খুশি হলেও মোড়লের মুখে হাসি অন্তরে বিষ।ছেলের বউ ঘরে তুলে সকল ঝামেলা শেষ করে থানার দাড়োগা,মোড়লের চামচা এবং দুজন পালোয়ানদের সাথে কথা বলছিলেন।প্রথমে দাড়োগার পাওনা বুঝে নিতে অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন।
-রশিদ সাহেব,আমি তাহলে আজ উঠি....।এমন অদ্ভুদ সুরে দাড়োগা চলে যাবার কথা বললেন যে তার কথার ভঙ্গিমায় মোড়লের বুঝতে বাকি রইল না যে সে কি চায়।
-হুম!ঐ চামচা,
মোড়লের মুখের দিকে কান পেতে দিল চামচায়,মোড়ল ফিস ফিস করে কি যেন বলতেই চামচায় নাউজুবিল্লাহ এক লফ্ফ দিলেন।
-ঐ হারামজাদা,তোরে যেটা কইছি সেটা কর...আছোতো বউ নিয়া সুখেই...দারোগা এখানে একা থাকে যে করে হউক পরী একটা জোগাড় করে দাড়োগার রুমে পাঠা...বুঝলি।গন্ডগোলের সময়তো পাক সরদারগো কম মাইয়া মানুষ আইন্না দেছ নাই,দিনে চারপাচ জনও আনছস...এহন পারবি না কেন?যা...যা বলছি তাই কর।
চামচায় মুখ ভার করে দারোগার জন্য মেয়ে মানুষের খোজে প্রস্থান নিলেন সাথে দাড়োগাও।
ফুলী কোন রকম যায় ঝামেলা ছাড়াই সংসারের দিন মাস পেড়িয়ে বছরে গড়াচ্ছেন।পাড়া প্রতিবেশীদের সে তার ভাল ব্যাবহার দিয়ে মন জয় করে নেন।গ্রামে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে।শুধু মোড়ল রশিদ মোল্লার কাছে ফুলী এখন এক অভিশাপ দুষমন,সে প্রথম প্রথম ভাল ব্যাবহার করলেও ধীরে ধীরে সে তার আসল চরিত্র প্রকাশ করতে থাকেন,ঝিকে মেরে বউকে বুঝানোর ছলে।রশিদ মোল্লার স্ত্রী অমায়িক ভালো মানুষ সে ফুলীকে খুব আদর করেন তবে ননদী,জাল ভাসুর দেবর এবং মোড়ল ফুলীকে সহ্য করতে পারেন না।আর আকমলের কথা আর কি বলব সেই যে বিয়ের আসরে মহানুভবতা ভাল মানুষের রূপ দেখিয়ে ছিলেন তা আরো বেড়ে গিয়ে পাচ ওয়াক্ত নামাজ সবার সাথে ভালো ব্যাবহার করতে শুরু করেন,পাড়ার লোকেরা অবাক হতো এই কি সেই আকমল যার ছিল লম্বা চুল ভর্তি মাথা,মাস্তানের মতো গলায় ইমিটেসনের মোটা চেইন,হাতে বেসলেট কানে দুল,মুখে ছিল অকথ্য ভাষা।
স্বামী আকমলও ফুলীকে বিয়ে করে যেনো পিতার চোখের বিষ হয়ে গেলেন।পিতা বিয়ের কয়েক দিন পর ছেলেকে সাফ জানিয়ে দেন মাসে অন্ততঃ পাচ হাজার টাকা তার হাতে দিতে হবে এখন সেই পরিমান টাকা কি ভাবে দিবেন সে তার কোন ব্যাবস্থাও দেখিয়ে দিলেন না বরং ছেলেকে হুশিয়ার করে দেন যদি টাকা দিতে না পারে তবে যেনো তারা অন্যত্র চলে যায়।এ সব কথা আকমল তার স্ত্রী ফুলিকে বলেননি পিতার সম্মানে হানি হবে বলে।সে নিজেই প্রায় প্রত্যাহ এক সকালে ঘর থেকে বের হন বাড়ী ফিরেন সন্ধ্যায়।যেখানেই যায় কাজের জন্য সেখানেই তাকে তিরস্কার করে...মোড়লের পোলায় আইছে কাম করতে,মোড়ল শুনলে আমাগো আস্ত রাখবো নাকি।যাও ভাই জেনে শুনে নিজের জানটা হারাতে চাই না।এ ভাবে চলে কয়েক মাস তারপর সে এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারল বন্ধুর ভাই কয়েকটি সৌদির ভিসা এনেছেন সে ইচ্ছে করলে সৌদি যেতে পারবেন।বন্ধুর পরামর্শে তার পিতাকে সে বলেন।

মোড়ল খুবই চালাক সে মনে মনে ভাবে এইতো সুযোগ ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে তারপর ফকিন্নির মাইয়ারে ঘর থেকে বের করুম।আকমলের কথা শুনে তার বাবা তাকে শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন।
-ঠিক আছে,..এখানে তুমি যখন কিছু কাজ করতেই পারবে না তবেতো অন্য কিছু করতেই হবে...তা বিদেশ যাবে টাকা দিবে কে?আমি এক পয়সাও দিবো না।
-তুমি না দিলে দিবে কে?
-কেন,তোর ঐ ফইকড়া শশুড় দিবে।
-তারতো এত টাকা দেবার সামর্থ নাই।
-চুপ,একদম চুপ হারাম জাদা,শশুড়ের পক্ষ হয়ে বাপের লগে তর্ক করে আবার।যা তোর বউকে বল...সে যেন তার বাপকে বলে।

মাথা নত করে ঘরে ঢুকে আকমল খাটে হেলান দিয়ে বসে ভাবছেন কি ভাবে টাকা সংগ্রহ করা যায়।সেই সময় ফুলী রান্না ঘর থেকে রুমে ঢুকেন।আকমলকে চিন্তিত দেখে সেও চিন্তিত তবে বাপ বেটার সব তর্ক শুনে সে নিজেকে পূর্বেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন হয়তো স্বামী টাকার জন্য তাকে চাপ দিবে কিন্তু না আকমল তা করেননি বরং উল্টো যখন ফুলী জিজ্ঞেস করেন,ফুলীর বাবাকে ফুলী কিছু বলবে কি না তখন সে বলতে বারন করেন ফুলীকে।ফুলী অবাক হয় আরেক বার কাকে সে এতো দিন খারাপ লম্পট মানুষ ভেবেছিলেন সেতো ফেরেস্তার চেয়েও বেশী ভালো মানুষ।
-আমি বিদেশ যাবো, মানে রশিদ মোল্লার ছেলে বিদেশ যাবে তার ভার বহন করবে শশুড়, কেনো।.....বাবার কি কিছু কম আছে নাকি।
-আপনার আব্বাতো দিতে রাজি নয় তাই আমার বাবাকে যদি বলে দেখতাম....।
-না!আমার অনুমতি ছাড়া তুমি তোমার আব্বুকে কিছুই বলবে না।টাকা আমার বাপই দিবে আর কি ভাবে টাকা আদায় করতে হয় সেটাও আমি জানি।এত সহায় সম্পদ খাবে কে বলো?সে কি কব্বরে নিয়ে যাবে নাকি তাছাড়া আমাদের যে কি পরিমান জমি আছে তা আমিও বলতে পারব না, গ্রামের যে পথ দিয়েই হাটি সেই পথই লোকে বলে আমাদের জমি।যাও তুমি তোমার কাজ সারো আমি দেখছি কি করা যায়.....এর মধ্যে হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো তার এক বন্ধু শহরে থাকেন অনেক পয়সাওয়ালা যখন পয়সা ছিলনা তখন এই আকমল তাকে শহরে যাবার পরামর্শ দেন এবং সাথে প্রায় এক লক্ষ টাকা এবং সহযোগিতা করার লোকের ঠিকানাও দেন।সে এখন অনেক মেইল ফ্যাক্টরীর মালিক।বৌকে ফের ডাক দেন।
-এই,,শোন আমাকে আমার কাপড় চোপর গুছিয়ে দাও আমি এক্ষুনিই শহরে যাবো।
কোন প্রশ্ন না করে ফুলী তার ব্যাগ গুছিয়ে দেন।শুধু ফুলীকে বলেই চলে ফেলেন শহরের উদ্দ্যেশ্যে আকমল।মা বাবা আর কাউকেই বলার প্রয়োজন বোধ করেননি।যাবার পথে ছোট ভাতিজি তার সামনে এসে দাড়য়।
-আমি শহরে যাচ্ছি তোমার জন্য কি আনব মামণি?
-তুমি কবে আসবা?
-কালই চলে আমু,
-তবে আমার জন্য নয় চাচ্চির জন্য একটা সুন্দর শাড়ী আনবা।
সত্যিইতো বিয়ের এতোগুলো মাস পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ফুলীর জন্য পরিধেয় বস্ত্র কিছুইতো দেয়া হয়নি।বাপের বাড়ী থেকে যা এনেছিল তাই উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পড়ছেন পরনের কাপড়ের রং কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।আর বেকার আকমলই বা কিনে দিবে কি দিয়ে তার কাছেতো টাকা নেই।মোড়ল বাবা কেমন পাষন্ড এ দিকে একবারও দেখবার প্রয়োজনবোধ করেন না।অথচ তার ছোট বোনকে মাসে অন্তত দুই সেট জামা কাপড় কিনে দিচ্ছেন সে।
অসহায় দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইল ফুলীর দিকে তারপর ভাতিজির কপালে চুমো দিয়ে চলে গেলেন গন্তব্যের উদ্দ্যেশে।

চলবে..
যৌতুকের বলি ৭ম

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ