মায়া (শেষ পর্ব)

ইঞ্জা ২১ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ০৯:৫৮:০৬অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩১ মন্তব্য

 

আগেই বলেছিলাম, মায়া দারোয়ান যে পথে হাটতে হাটতে পাহারা দিতো, তার ঠিক উল্টো পথেই যেতো, এইটাই তার কাল হলো, ভোরে আমরা উঠে ফ্রেস হচ্ছি, রেডি হবো স্কুলে যাওয়ার জন্য, এই সময় দারোয়ান ডাক দিয়ে বললো মায়া পড়ে আছে উঠোনের পানি যাওয়ার জন্য বানানো নালাতে।

আমরা সবাই পড়িমরি করে দৌড় দিলাম ঘরের বাইরে, নালার সামনে এসে চিৎকার করে উঠলাম আমরা ভাই বোন আর আম্মা, আম্মা দৌড় দিলেন ভিতরে আব্বাকে ডাকতে।
মায়া তখন হা করে করে নিশ্বাস নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে ওর গাল ভিজে আছে।
আব্বা ঘুমিয়ে ছিলেন, ওখান থেকেই উঠে এলেন, মায়ার অবস্থা দেখে আব্বা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন কই ছিলো সে?
দারোয়ান বললো, সারারাত ডিউটি দিয়েছে মায়া ওর সাথে, দারোয়ান পিছনের দিকে গিয়ে ছিলো ডিউটি দিতে, ফজরের আজানের পর ও টয়লেটে গিয়েছিলো, ওখান থেকে ফিরে মায়াকে দেখতে না পেয়ে সে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে মায়া মাঠিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে নালায় পড়ে গেছে, যা মনে হচ্ছে ওকে বিষ দেওয়া হয়েছে।

আব্বা দ্রুত ওর মুখে পানি দিলেন, একটু পর মায়া চলে গেল না ফেরার দেশে।
আমরা ভাই বোনদের চোখে পানি, পারছিনা জোড়ে কাঁদতে, কাঁদলে আব্বা বকা দেবেন।
আব্বা বললেন, তোমরা রেডি হয়ে স্কুলে চলে যাও, এখন মন খারাপ করে লাভ নেই।
আব্বার মুখের উপর কিছু বলা না বা করার সাহস আমাদের নেই, মনটা প্রচন্ড খারাপ হলেও বাধ্য হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলাম, কিছু পেটে গেলোনা আমাদের কারো, স্কুলে চলে গেলাম।
স্কুলে কি আর পড়ার মধ্যে মন বসে, কত স্মৃতি যে বারে বারে ফিরে আসে মনে।
স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরে দেখি মায়া নেই, শুনলাম আব্বার পাড়ার লোক দিয়ে ওকে কবর দিয়েছে, শুনে আরও মন খারাপ হলো।

পরে যা বুঝলাম, দারোয়ান অন্য দিকে গেলে কেউ হয়ত মায়াকে বিষ যুক্ত কিছু ছুঁড়ে দিয়েছে, মায়া হয়ত ব্যক্তিটিকে দেখেনি, দেখলে ও চিৎকার করতো, খাওয়া দেখে ও খেয়ে ফেলাতেই এই মৃত্যু।
আব্বাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন।

মাস খানেক পর আব্বা আমাদেরকে উঠোনে ডাক দিলেন, আমরা বাড়ির বারান্দাতে এসে অবাক হলাম, এক লোক ছোট এক কুকুরের শাবক আনছে, আমরা বাচ্চাটাকে দেখছি আর এর মধ্যে আব্বা লোকটিকে বললেন, এটি তো সরাইলের কুকুর না, আমি তো সরাইলের কুকুর আনতে বলেছি।
লোকটি আব্বাকে বুঝাতে চাইলো এইটাই সরাইলের কুকুর।
আব্বা ক্লিয়ার করে বলে দিলেন, হয় সরাইলের কুকুর আনবা, নাহয় আনবানা।
লোকটি বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেলো।

এর কয়েক বছর পর আমরা পাড়াটা ছেড়ে চলে গেলাম চট্টগ্রামের নামকরা হাউজিং সোসাইটিতে, আব্বা এইখানে নতুন বাড়ি করেছেন আর আগেরটা বিক্রি করে দিয়েছেন।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, বছর খানেক পর আমি এক কুকুর ছানা নিয়ে আসলাম আমার কাজিনের কাছ থেকে, স্পিটজ জাতের ছোট সাদা কুকুর, ঘরের সবাই মহা খুশি, এইটাকেই নিয়ে মশগুল হলাম আবার, নাম রাখলাম কিটস, তখন নাইট রাইডার মুভি চলতো টিভিতে, সেই মুভির ক্যারেকটার ছিলো কিটস নামের এক অত্যাধুনিক গাড়ী, সেই নামেই নাম রাখা হলো কিটস।

আমার আব্বা যেদিন ইন্তেকাল করেন, আমি ছিলাম সিলেট, মধ্যরাতে মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা হয়ে যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
পরে শুনেছি, আমার আব্বাকে রাখা হয়েছিলো ড্রয়িংরুমে এ সিঙ্গেল খাটের উপর, সেইসময় কিটস নাকি পাগলের মতো করে বারবার আব্বার কাছে যেতে চাইছিলো, চিৎকার করছিলো, বাধ্য হয়ে ওকে বেঁধে রাখতে হয়েছিলো, ও এমনি ভাবে প্রভুভক্তি দেখিয়েছিলো।

আমি আর আব্বা বিভিন্ন জাতের কুকুর পুষেছি, জার্মান শেফার্ড, ল্যাব্রাডর, হাস্কি, লাসা ছিলো উল্লেখযোগ্য, এরা সবাই সবসময় প্রভুভক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছে, তাদের কিছু উল্লেখ করার মতো মজার ঘটনা বলি আপনাদেরকে।

ল্যাব্রাডর কুকুরকে ছেড়ে দিলে সে এক দৌড়ে উঠে যেতো সিমানা দেওয়ালে, সেখানেই হেঁটে বেড়াতো সে।
জার্মান শেফার্ড কয়েকটা পুষেছিলাম, তার মধ্যে একটার নাম ছিলো শিলা, এক সকালে আমার ইমিডিয়েট ছোট বোনটা ড্রয়িংরুমের জানালা দিয়ে দেখলো শিলা এক ছেলের গায়ে দুই ঠ্যাং তুলে ওকে স্টান্ডবাই করে রেখেছে, ছেলেটা এসেছিলো ব্যাডমিন্টন কোর্ট থেকে বাল্ব চুরি করতে, ওকে পেয়েই শিলা আটক করে ফেলে, আমার বোন তা দেখে ভয় পেয়ে গেলো, নিশ্চয় শিলা ওর কল্লা গিলে খাবে, এই ভয়েই ও চিৎকার করে শিলা শিলা ছাড়ো ওকে বলে উঠলো আর শিলাও ততখনাৎ চোরকে ছেড়ে দিলো, ছেলেটা সেই সুযোগে পগার পার হয়ে গেলো।

এইসব লেখার একটাই কারণ, কুকুরের প্রভুভক্তি, আপনি যদি ওদের আদর ভালোবাসা দেন, ওরা কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবেনা, দরকার হলে ওরা আপনার জন্য জান দিয়ে দেবে।

সমাপ্ত।
ছবিঃ গুগল।

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ