মনে পরে আজও

নাসির সারওয়ার ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার, ০২:৫৪:০৬পূর্বাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ৪২ মন্তব্য

আমাদের গর্বের স্বাধীনতার কিছু কথা। এইতো সেদিনের কথা, অথচ মাঝে চলে গেছে ৫১ টা বছর। সেই আমিতো আছি আমিই হয়ে। মনের কোনায় এখনো জমানো আছে ৭১, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা । কতটুকুনই বা ছিলাম, তারপরও বয়ে বেড়াচ্ছি সেই দুর্বিষহ দিনগুলোর স্মৃতি যা এখনো চোখের সামনে এসে কী জেনো খুঁচিয়ে দেয়। কি এক যন্ত্রনা্র মাঝেই না যেতে হয়েছে সেই ছোটবেলাটা। হাই স্কুলে যাবার মন মাতানো আনন্দের বদলে মনটাই চুপসে গেলো।

কি এক ভয়ংকর রাত সেই ২৫শে মার্চ। ঢাকা শহরকে ভীতিকর শব্দ দিয়ে কে যেনো নরক বানিয়ে দিলো। মাইল দুরে থেকেও আগুনের ফুলকি দেখছি আমাদের বাড়ী থেকে। বাবা রেডিওর পাশে বসে কি সব শুনছে। সবার মুখ যেনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মায়ের মুখ দেখে ভয় হচ্ছে। এই মা তো এমন গম্ভীর ভাব নিয়ে কখনো থাকেনি। ছোট বোনটা সবে মাত্র হামাগুড়ি শিখেছে। গোলার শব্দে ঘুম ভেংগেছে অথচ যেনো কান্না ভুলে গেছে। শুরু হলো মায়ের আশেপাশে বসে থাকা নিঝুম এক রাত।

কিছুদিন আগে শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন আমাদের এলাকায়। আমাদের ফুটবল খেলার মাঠে কি একটা নির্বাচনের কথা বার্তা বলেছিলেন তিনি। বড় ভাইয়ের সাথে আমিও গিয়েছিলাম উনার কথা শুনতে। তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম থেকে পূর্বকে আলাদা করবেন। কারন পশ্চিমারা আমাদের সব সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। আরো কত কথা যা সব বুজে উঠতে পারিনি। ২৫শে মার্চ তাহলে কি তার কথারই ফসল!

কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের এলাকায় (বর্তমানে গুলশান শুটিং রেঞ্জ) একটা মিলিটারি ক্যাম্প বসে গেলো। তারা মাঝে মাঝে এলাকার মাঝে অনেক শব্দ করে হাটাহাটা করলো। আমরা আমাদের গেটের ধারেকাছেই গুরগুর করে দিন কাটাচ্ছি। শুধু বড় ভাইটি কোথায় কোথায় যেন যায়। আমি শুনে গেলাম উনি নাকি যুদ্ধ নিয়ে ভাবছে এবং নিজেকে প্রস্তুত করছে যাবার জন্য। তা শুনে মা কি বলেছিলেন, আজ তা আর মনে নেই।

একদিন ভোরে আমার এক বন্ধু এসো চীৎকার শুরু করলো। “তোর ভাইয়াকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে”। সে এক বিষাদের সময় যারা এরকম ধারার মাঝে গিয়েছিলেন, তারাই উপলব্দি করতে পারবেন। একটা সংসারকে ভেঙ্গে মুছড়ে দেবার বাকী আর কি থাকে। মা বের হয়ে গেলেন। আজও জানা হয়নি কোথায় গিয়েছিলেন। তবে সন্ধ্যা বেলা ছেলে নিয়ে বাড়ীতে ফিরলেন। খুশীতে সবাই কাঁদছে যা দেখে শিখে নিলাম আনন্দ কান্না কাকে বলে। পরে যা যেনেছিলাম তা হলো, ভাইয়ারা কয়েক বন্ধু মিলে যুদ্বে যাবার শলাপরামর্শ করছিলো বাজারের এক রেস্টুরেন্টে বসে। মিলিটারি এসে সবাইকে ধরে নিয়ে ওদের ক্যাম্পে আটকে রাখলো। সন্ধ্যা বেলা এদের গুলি করা হবে। কে এক অলৌকিক কারনে গুলি না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো, তা আজও অস্পষ্ট। তবে ভাইয়ার আর যুদ্বে যাওয়া হয়নি। মিলিটারি প্রতিদিন এসে দেখে যেতো। বাসায় না থাকলে অন্য সবাইকে মেরে ফেলবে বলে দিয়েছিলো। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন, মাস। শুধু রেডিও শুনে মুক্তিযোধাদের সাহসিকতার খবর শুনে বুকটা ভরে উঠত।

আমার বন্ধুদের সংখ্যা কমতে শুরু হোল ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে। সবাই কেন জানি ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দুপুরের পরে বাইরে যাওয়া কমাতে হোল কী যেন কারফিউ নামের যন্ত্রণার কারণে।

বেশ খারাপ মনটা, আমার নতুন ডেজ্ঞা আর চুইগুলো (ডেজ্ঞা হোল সাধারণ মার্বেলের চেয়ে একটু বড় যা দিয়ে অন্যকে তীব্র আক্রমণ করা আর চুই হোল ছোট যা অন্যের আক্রমণকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা) কাউকে ভালো ভাবে দেখিয়ে ভাব না নিতে পারার। মাঝে মাঝেই খাকী পোশাকধারী কিছু মানুষ এসে কী সব ভাষায় কথাবার্তা বলে চলে যেতো। খুব যে ভয় লাগতো তা নয়। তবে ওদের আচরণটা ভালো লাগতো না। সন্ধ্যার পরে লাইট (কুপী বা হ্যারিকেন) জ্বালানো হতো অল্প সময়ের জন্য। খাবারের টেবিলেও সবাই ক্যামন জেনো আড়ষ্ট ভাবে কথা বলে। মনে হচ্ছে আমি ছাড়া সবাই যেন আতঙ্কে রোগে ভুগছে।

একদিন খুব ভোরে সামনের বাড়ীর সরকার চাঁচা এসে বিদায় বলে গেলেন। হায় হায়, এলাকার মোটামুটি সবাই নাই হয়ে যাচ্ছে আমরা ছাড়া। পাশের মহল্লা থেকে এক আত্মীয় এসে বাবা মাকে বললেন তারাও চলে যাবেন। কিন্তু যাবেনটা কোথায়, তা বলতে পারছেনা। আর আমরা, কী করবো কোথায় যাবো। ৪ তারিখ রাতের বেলা শুরু হোল ঘোছানোর পালা। কি কি নেয়া যাবে বা নিতে পারবো আমরা। আমি ব্যস্ত আমার মার্বেলের কৌটা আর লাটিম নিয়ে। সবার আগে ওগুলোইতো লাগবে আমার। ভালো ঘুমই হোলনা যেখানে যাচ্ছি সেখানে দু’চার জন খেলার সাথী পাব কিনা তাই ভেবে। খুব ভোরেই মা সবাইকে রেডি করে ফেললেন জেনো আমরা মনুষ্য দেশের বাইরে যাচ্ছি। কেরোসিনের চুলা থেকে চাল ডাল নুন সবই আছে। দুটো লাটিম দুই পকেটে আর হাতে মার্বেলের কৌটা নিয়ে নিজেকে বেশ গম্ভীর করে তৈরি করে ফেললাম। বিঁধি বাম, লাটিম দুটো দেখেও না দেখার ভান করে মার্বেলগুলো রেখে যেতে বললেন মা। আমাকে নাকি অন্য ব্যাগ টানতে হবে। বলে কি এসব, আমি কি করে ওসব খাবার দাবারের মতো বেহুদা জিনিষ পত্র টানবো মার্বেল রেখে! শুরু হোল ৮ জনের যাত্রা। রাস্তা থেকে যোগ হবেন ওই আত্মীয় সংসার। মা ক্যামন করে জেনো পুতুল সাইজের ছোট বোনটাকে আঁচলে বেঁধে দু হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে নিলো। ওই পুতুল সাইজের সামান্য বড় একটা ভাই নাকি একাই হাঁটবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। অথচ কিছুক্ষণ বাদেই তার অবস্থান হলো বড় ভাইয়ের ঘাড়ে। আরও তিন সাইজের তিন পুতুল নিয়ে আত্মীয়টা যোগ হোল অল্প সময়ের ব্যবধানে। একটু ভয় ভয় লাগছে যখন আব্বা বললেন আমরা পূর্ব দিকে যাচ্ছি। সূর্য্য তো পুব দিকেই উঠে এবং আমরা সেদিকেই যাচ্ছি, অথচ উনি নিজেও জানেন না কোথায় যাচ্ছেন। মনে হয় মাইল দুয়েক পরে সমুদ্রের (বিল বা ঝিল কিছু একটা হবে) পাড়ে এলাম যেখানে একটাই নৌকা। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা নৌকায় চেপে বসলাম। এইবার আমার নাও বাওয়ারও সুযোগ হবে দেখছি কারণ মাঝি যাচ্ছেনা আমাদের সাথে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম, মনে করতে পারছিনা। সারাদিন কি কিছু খেয়েছিলাম, আজ তাও মনে আনতে চাচ্ছি না। শুধু মনে আছে ভীষণ ভীত আমি কোথায় যাচ্ছি ভেবে। আর কী ফেরা হবে যেখানে আমার সব মায়ারা মিশে আছে।

সন্ধ্যা হয় হয় করছে। ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে নৌকা চলছে নাচের তালে। কী এক অপরূপ নান্দনিক দৃশ্য। সৃষ্টিকর্তা কি সৌন্দর্য ঢেলে প্রকৃতি সাজিয়েছেন। আমার কি সেই চোখ আছে তা উপভোগ করার, আমি যে কুল খুঁজছি এখন। সবাই জেনো পণ করেছে কথা না বলার। আমার চাইতেও ছোট আছে বেশ কজন। অবাক কাণ্ড কেউ টুঁশব্দ ও করছেনা কোন। ওরাও কি সজাগ ওদের চেতন নিয়ে! ওরাও কি বুজতে পারছে আমরা হারিয়ে গেছি নাকি অজানা কোন দেশে যাচ্ছি। একসময় নাচের মুদ্রায় কে যেন লয় কেটে দিলো। সবাই নড়েচড়ে বোঝার চেষ্টা শুরু করে দিলে আমার সাথেই। আরে হ্যাঁ, ঐতো নতুন পৃথিবী জেগে উঠেছে অথৈ জলের মাঝে। ছোটখাটো একটা দ্বীপের মত যাতে ভেসে আছে দুটো মাটির ঘর। আমরা তো এর জন্যই বৈঠা বেয়ে চলছি সেই সকাল থেকে। একটু পরেই তো আমরা পা রাখবো সেথায় নতুন এক আশা নিয়ে। দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে আবছা আলোয় একে একে সবাই পা রাখলাম সবুজ ঘাসে। আহা, কি শান্তি এই মাটির স্পর্শ, কি মায়া আছে এতে! একজন মাঝ বয়েসের মানুষ আসলেন হ্যারিকেন নিয়ে। প্রথম দেখায় যদি কাউকে ভালো লাগার বিষয় থাকে, তাহলে ওনাকে প্রথম সারিতে রাখতে হবে। ভীষণ মায়াবী চোখের এই মানুষটির মার্জিত কথাবার্তা শুনে বেঁচে থাকার আনন্দ জ্বালাই হয়ে যায়। কেন যে এই মানুষগুলোর মতো মানুষরা আমাদের দেশ চালাবার ভার পায়না! খুবই বিনীত ভাবে দুই ঘরের একটা ছেড়ে দিলেন। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছেনা এমন মানুষ যে আছে এই নতুন পৃথিবীতে। তাদের সামান্য কিছু জিনিষ পত্র বের করে নিয়ে গেলো অন্য ঘরটায়। মুড়ি গুড় দিয়ে সে যে আপ্যায়ন, আজো চোখের মনে গেঁথে আছে।

শুরু হলো নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা। একটা মাটির ঘর আর ১৪ জন মানুষ। তারপরও মনে হচ্ছে মিলিটারির যন্ত্রনা থেকে এ যাত্রা বেঁচে গেলামতো। ছোটদের জন্য এযেনো এক বিশাল খেলাঘর। সারাদিন কাটে এই দ্বীপের মাঝে। ঘাস মাটিতে ভালোই যাচ্ছে দিন। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বঁড়শি বানাতে সাহায্য করলেন ঐ বাড়ীর চাচা। শিখে গেলাম পুঁটি মাছ ধরা। বড়রা নৌকা করে অন্য দ্বীপে যেতে পারে। কোথায় যায় কে জানে। সন্দ্যা বেলা সবাই রেডিও নিয়ে বসে। এযোনে প্রতিদিনের রুটিন।

একদিন সেদিন হয়ে আসলো। পাশে্র দ্বীপ থেকে অনেক চীৎকার যা আমরা আমাদের এখান থেকেও শুনেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন বুঝিনি এই স্বাধীন মানে কি। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, আমি আমার বাড়ীতে ফিরে যেতে পারবো যেখানে আমার সব মায়ারা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

স্মৃতিকাতরতা এ এক অসম্ভব বোঝা, আনন্দের সাথেই বয়ে বেড়াচ্ছি স্বাধীনতার সাধে।

0 Shares

৪২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ