ভাষ্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ

মনির হোসেন মমি ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪, সোমবার, ১২:০৮:০৯অপরাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ৩২ মন্তব্য

মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কথা তুললে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঢাকার ‘অপরাজেয় বাংলা’র ছবি। তারপর বহু ভাস্কর্য হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় নিয়ে। নগরীর মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো দেখলেই একাত্তরের ৯ মাসের ঘটনার চাক্ষুস দেখা মেলে। এসব ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালির প্রতিবাদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ত্যাগ, তিতিক্ষা, গতি-উদ্যমের প্রতীক, বীরত্ব, গণ হত্যা সহ অসংখ্য চিত্র। যা বর্তমান প্রজন্মকে যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই একাত্তরে। বেশিরভাগ ভাস্কর্যই হয়েছে কেবল মুক্তি যুদ্ধের ভয়াবহ ও বীরত্ব নিয়ে। তবে হয়নি কেবল বিকৃত রাজাকার আর আলবদর নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘ঘৃণা স্তম্ভ’ নামে একটি স্তম্ভ তৈরি করে রাজাকার-আল বদরের ঘৃণা জানালেও তার স্থায়ী রূপ পায়নি।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
ব্যাস্ত ণগরী ঢাকায় ভাষ্কর শামীম শিকদারের একাধিক ভাষ্কর্য থাকলেওসবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন স্বোপার্জিত স্বাধীনতা নির্মাণের জন্য।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়কদ্বীপে নির্মাণ করা হয়।১৯৮৮ সালের ২৫শে মার্চ এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
১৭ ফুট উঁচু ভাষ্কর্য।সাদা মার্বেল এবং মার্বেল ডাস্ট এবং সাদা সিমেন্টসে গড়া।চৌকো বেদির উপর নির্মিত ভাষ্কর্যটির একদম উপরে বামে আছে মুক্তি যোদ্ধা কৃষক আর ডানে রয়েছে অস্ত্র হাতে দুই মুক্তি যোদ্ধা।এ ভাস্কর্যটি মাটি থেকে ১৮ ফুট উঁচু। আজো সব অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্রে আছে ভাস্কর্যটি। এর নির্মাতা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ।
১৯৫২ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার উপর আলোকপাত করে গড়ে তোলা হয়েছে এই ভাষ্কর্যটি। প্যানেলের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বিভিন্ন স্লোগান। স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ানোর জন্য বাঙ্গালী যে পরিমাণ রক্ত দিয়েছে, নির্যাতন সয় তার প্রায় ক’টি খন্ড চিত্র বেদির চারপাশে চিত্রায়িত হয়েছে। বেদির বাম পাশে রয়েছে ছাত্র-জনতার অপর অত্যাচারের নির্মম চেহারা।
রেলওয়ের শহীদের স্মরণে
একাত্তরের ৯ মাসে প্রাণ দিয়েছে হাজারো রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের স্মরণে নগরীর কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে স্থাপিত হয়েছে মুক্তি যুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য। উঁচু বেদির ওপর বসানো হয়েছে আস্ত একটি রেলের ইঞ্জিন। তার ওপর মুক্তি যোদ্ধার হাত বেয়োনেট সহ রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছে। পাশেই উড়ছে বিজয় নিশান। রেল ইঞ্জিনের নিচে বেদির চারপাশে সিমেন্টে তৈরি ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের বিজয়ের ক্ষণটি পর্যন্ত।
একাত্তর স্মরণে
মুক্তি যুদ্ধের এক অনন্য ভাস্কর্য এটি। বাংলা একাডেমি ভবনের প্রধান ফটকের ডান পাশের দেয়ালে স্থাপিত রয়েছে ভাস্কর্যটি। ব্রোঞ্জ কাস্টিংয়ের এ ভাস্কর্যে এক গ্রামীণ যোদ্ধা অস্ত্র হাতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার চারপাশে আছে ব্রোঞ্জ কাস্টিংয়ে তৈরি ম্যুরাল। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কালের ক'টি খণ্ড চিত্র।
988428_10201211923126713_2085086071_n

শিখা চিরন্তন

সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু স্মৃতি বিজড়িত স্থান। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এখানে জাতির মুক্তির সনদটি ঘোষণা করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর এখানেই পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তাই এ উদ্যানটিতে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। এই অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ এ শিখা চিরন্তন উদ্বোধন করেন বিশ্বের চার রাষ্ট্রপ্রধান নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত, সুলেমান ডেমিরেল ও বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তি যুদ্ধের সেক্টর ভাস্কর্য
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী। সে কথা মাথায় রেখে এ ভাস্কর্য নির্মিত হয় ওসমানী উদ্যানে। পর্যায়ক্রমে ১১টি সেক্টরের জন্যই এমন ভাস্কর্য তৈরি হবে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ভাস্কর্যের সাদা দেয়ালের মাঝখানে খচিত বাংলাদেশের মানচিত্র। মানচিত্রে দুই নম্বর সেক্টরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পাশেই কালোর মধ্যে সাদা রঙে লেখা ইংরেজি হরফ ‘কে’। দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশারফের নামের প্রথম অক্ষর।
শহীদ বুদ্ধি জীবী স্মৃতি সৌধ
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত এ স্মৃতিসৌধ। এতে বিশাল প্রাঙ্গণে বেদির ওপর বসানো রয়েছে শ্বেতপাথরের এক ফলক। বেদির চারপাশ দিয়ে নেমে গেছে সিঁড়ি। চারটি দেয়াল ও বেদি সবই লাল ইটে তৈরি। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এ বেদি ফুলে ভরে ওঠে। ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর এ স্মৃতিসৌধের ফলক উšে§াচন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাশার ’৭১-এর গণহত্যা:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যা করা হয় অসংখ্য বাঙালিকে। সেই শহীদদের স্মরণে এ ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণহত্যা নিয়ে একটি ভাস্কর্য। এটি গড়েছেন ভাস্কর রাশা। ভাস্কর্যটির একাংশের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ ও অন্য অশেংর নাম ‘’৭১-এর গণহত্যা’। পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা চিত্রই ফুটে উঠেছে এ ভাস্কর্যে।
রাজার বাগের চির দুর্জয়:
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ করেন রাজারবাগের পুলিশ বাহিনী। সে শহীদদের স্মরণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নির্মিত হয় ‘চিরদুর্জয়’। একটি বেদির ওপর দাঁড়ানো পাঁচ যোদ্ধা। আছেন কৃষক, শ্রমিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য। তাদের তিনজন লাইফেল হাতে, একজন ছুড়ছেন গ্রেনেড আর একজন পতাকা হাতে যাচ্ছেন এগিয়ে। ভাস্কর্যটি মৃণাল হকের গড়া।

ময়মনসিংহ৭১’র স্মৃতিচিহ্ন ভাষ্কর্য ।

১৯৭১ সালে সমগ্র বাংলাদেশে পাক বাহিনী ও তার দোষর রাজাকার আলবদর বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অকাতরে প্রাণ দেন অগনিত মানুষ। ময়মনসিংহের মানুষ বাদ পড়েনি ।ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা শহরের পাড়া টঙ্গীতে ময়লা খানা সংলগ্ন আয়মন নদীর তীরে মুক্তি যুদ্ধকালীন অগনিত মানুষকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় ।দেশ স্বাধীনের দীর্ঘদিন পর বিংশতাব্দীতে সাবেক গণপরিষদ সদস্য , পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক খোন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ময়লা খানার আয়মন নদীতীরে বদ্ধভূমিতে স্থাপন করা হয় পৃথক দু’টি ভাষ্কর্য । এই ভাষ্কর্যদুটি যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধবংস হয়ে যাচ্ছে । এলাকাবাসী ভাষ্কর্য গুলিকে লাকড়ি শুকাতে এবং গরু ছাগল লালন- পালন করতে ব্যবহার করছে । শুধু এদু’টি ভাষ্কর্যই নয় উপজেলার বিভিন্নস্থানে প্রতিষ্ঠিত ভাষ্কর্যগুলির একই অবস্থা যা কেবল ১৬ই ডিসেম্ভর এলেই মনে পড়ে।
চেতনা ৭১’ ভাষ্কর্য
শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে অবস্থিত চেতনা ৭১’ মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম স্মারক ভাষ্কর্য।
(y)  ভাস্কর্যের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এবং একাডেমিক ভবন গুলোর লাল ইটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভিত্তি বেদিটি ৩ টি ধাপ বানানো হয়েছে। এই বেদিটি তৈরি লাল ও কালো সিরামিক ইট দিয়ে। তিনটি ধাপের নিচের ধাপের ব্যাস ১৫ ফুট, মাঝের ধাপ সাড়ে ১৩ ফুট এবং উপরের ধাপটি ১২ ফুট। প্রত্যেকটি ধাপের উচ্চতা ১০ ইঞ্চি। বেদির ধাপ ৩টির উপরে মুল বেদিটি ৪ ফুট উচু, তার উপরে রয়েছে ৮ ফুট উচ্চতার মূল ফিগার।
এই ভাষ্কর্যটির একটি অনন্য বৈষিষ্ট্য হল ভাস্কর্যটিতে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের আদলে অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। পোশাক ও আনুষঙ্গিক উপকরণেও রয়েছে বর্তমান সময়ের ছাপ।মডেলে ছাত্র হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও পরে তুলে ধরার ভঙিমায় দাঁড়িয়ে এবং ছাত্রীর হাতে রয়েছে বই, যা বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতীক নির্দেশ করে।দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে ভাষ্কর্যটি নির্ভীক প্রহরীর মত স্বাধীনতা এবং সার্বোভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সু-উচ্চ ভাষ্কর্য উদ্বোধন করানির্মিত ভাষ্কর্যটি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আদলে তৈরি করা হয়েছে। ভাষ্কর্য নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় সোয়া কোটি টাকা। মাটি থেকে ভাষ্কর্যটির উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফিট।

জাগ্রত চৌরাঙ্গী:
মুক্তি যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক জাগ্রত চৌরঙ্গীর ভাস্কর। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর উদ্যোগে ১৯৭২-৭৩ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত এটিই প্রথম ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের আন্দোলন ছিল মুক্তি যুদ্ধের সূচনা পর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। আর এই প্রতি রোধ যুদ্ধে শহীদ হুরমত উল্যা ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে স্থাপন করা হয় দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য কর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গী।
(y)  জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে।
রি-ইনফোর্সড সিমেন্ট ঢালাইয়ে নির্মিত আঠারো ফুট উঁচু এ ভাষ্করটি ২২ ফুট উঁচু একটি বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত।দৃঢ়ভাবে ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ দুই পায়ে স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধার এই অবয়বধর্মী ভাস্কর্যটির এক হাতে রাইফেল অন্য হাতে উদ্যত গ্রেনেড। যে-কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত এমন বোধের জন্ম দেওয়াই বোধহয় ভাস্করের উদ্দেশ্য ছিল। বেদির চারদিকে ২০৭ জন শহীদ মুক্তি যোদ্ধার নাম লেখা রয়েছে। ভাষ্কর্যটির শিল্পরীতি সম্পর্কে স্থপতি রবিউল হুসাইন বলেন, হয়তো সেটা গিতিহীন, আরো দূর্বার শক্তিতে সঞ্চারিত হবার অপেক্ষা রাখে- এরকম সমালোচনা করা যায়। তবুও এটির উজ্জ্বল উপস্থিতিকে অস্বীকার করা যায় না।একটি মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় প্রথম ভাস্কর্য।

সংশপ্তক
মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্যচর্চায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন ভাষ্কর হামিদুজ্জামান। তাঁর অন্যতম বড় মাপের কাজ ‘সংশপ্তক’। সংশপ্তক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণমূলক ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে এ ভাস্কর্যটি।১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাবির উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহম্মেদ।
আকার
বেদূঈর উচ্চতা ১৫ ফুট এবং মূল ভাষ্কর্যের উচ্চলা ১৩ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এছাড়া এটি নির্মানে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ভাষ্কর্যটির জ্যামিতিক ভঙ্গি এনেছে গতির তীক্ষ্ণতা।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের তাঁজা প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি জাতি। তাদের এ আত্মত্যাগের বিনিময়ে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস কে স্মরণ রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ । সেই রকম ভা+৬বে বাঙালি জাতির এই গৌরব ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে।‘ সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপন যুদ্ধে যারা অপরাজিত। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা যাদের স্বপ্ন, শত্রুর বুলেটের সামনেও জীবন তাদের কাছে তুচ্ছ। সংশপ্তকের গায়ে প্রতিফলিত হয়েছে ধ্রুপদী যোদ্ধাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও লড়ে যান যে অকুতোভয় বীর সেই সংশপ্তক। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনাকে দৃশ্যমান করার লক্ষেই ‘সংশপ্তক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরদের স্মরণেও এটি নির্মাণ করা হয়েছে।আরো অনেক পরে সংশপ্তক অনুসরণে ঢাকার পান্থপথে ইউটিসি সেন্টারে একটি ঝুলন্ত-ভাস্কর্য তৈরি করেন। স্টেনলেস ইস্পাতের সরু নলকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিও অনবদ্য।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বহিরাঙ্গন ভাষ্কর্যটি হল ‘মুক্তিযোদ্ধা’।
(y)  ঢাকার প্রবেশমুখে গাজীপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে ( স্থানটি প্রথম পর্বে উল্লেখিত জাগ্রত চৌরঙ্গী-র নামেও পরিচিত)
(y)  রি-ইনফোর্সড সিমেন্ট ঢালাইয়ে নির্মিত আঠারো ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দৃঢ়ভাবে ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ দুই পায়ে স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধার এই অবয়বধর্মী ভাস্কর্যটির এক হাতে রাইফেল অন্য হাতে উদ্যত গ্রেনেড।
অঙ্গীকার
(y)  চাঁদপুর শহরের মুক্তিযোদ্ধা সড়কের পাশের লেকে হাসান আলী সরকারি হাইস্কুল মাঠের সামনে একাত্তরেরশহীদ স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘অঙ্গীকার’।বেদি থেকে ২২ ফুট ৭ ইঞ্ছি উঁচু। সিমেন্ট, পাথর এবং লোহা দিয়ে তৈরি ভাষ্কর্যটি।
ভাষ্কর্যটির স্থপতি ‘অপরাজেয় বাংলা’র ভাষ্কর শিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ১৯৮৮ সালে ভাষ্কর্যটি স্থাপিত হয়। চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এস এম শামছুল আলমের প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে দৃষ্টিনন্দন এ ভাস্কর্যটি উদ্ভোদন করা হয়। একটী মুষ্টিবদ্ধ ভাষ্কর্যটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধরা স্টেনগানে রয়েছে দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় অঙ্গীকারকে অপরূপ দেখায়।
(y)  স্বাধীনতা সংগ্রাম
স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাষ্কর্য এটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল,জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি স্থাপিত। ১৯৫২-১৯৭১ সালের বিভিন্ন আন্দোলনে নিহত ১৮জন শহীদের ভাষ্কর্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাষ্কর্যটি নির্মিত। সবার নিচে রয়েছে ভাষা শহীদের ভাষ্কর্য এবং সবার উপরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্কর্য। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটিও স্থান পেয়েছে শীর্ষে।ভাষ্কর্যটির উচ্চতা ৬০ ফুট এবং পরিসীমা ৮৫.৭৫ ফুট।
মূল ভাষ্কর্যকে বেষ্টিত করে আরো অনেক ভাষ্কর্য নির্মিত হয়েছে সড়কদ্বীপে। শ্বেত শুভ্র রঙ্গে গড়া মোট ১১৬টি ভাষ্কর্যের সবক’টিই শামীম শিকদারের তৈরি।
“নিতুন কুন্ডের ভাষ্কর্য”
শাবাশ বাংলাদেশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেরা ভাষ্কর্যগুলোর একটি ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ দেখতে পাওয়া যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের দক্ষিণে। ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
৪০ বর্গফুট জায়গা উপর ভাস্কর্যটি দাড়িয়ে আছে ।রয়েছে দুজন বীর মুক্তিযুদ্ধার প্রতিকৃতি। একজন রাইফেল উচু করে দাঁড়িয়ে আর তার বাঁ বাহুটি মুষ্টিবদ্ধ করে জাগানো। খালি গা, নগ্ন পা, লুঙ্গি পরা- যা গ্রাম বাংলার যুবকের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যজন রাইফেল হাতে দৌড়ের ভঙ্গিতে রয়েছে। ১২ ফুট উচ্চতায়- শহুরে যুবকের প্রতীক। পরনে প্যান্ট, মাথায় এলোমেলো চুলের প্রাচুর্য যেন আধুনিক সভ্যতার প্রতীক ।
এ দু’জন মুক্তিযুদ্ধার পেছনে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়ালও দাড়িয়ে আছে। দেয়ালের উপরের দিকে এক শুন্য বৃত্ত যা দেখতে সূর্যের মতোই। ভাস্কর্যটির নিচের দিকে-ডান ও বাম উভয় পাশে ৬ ফুট বাই ৫ ফুট উঁচু দুটি ভিন্ন চিত্র খোদাই করা হয়েছে। ডানদিকের দেয়ালে রয়েছে দু’জন যুবক –যুবতী চিত্র। যুবকের কাঁধে রাইফেল, মুখে কালো দাড়ি, কোমরে গামছা বাধা যেন এক বাউল প্রতিকৃতি। আর যুবতীর হাতে একতারা। গাছের নিচে মহিলা বাউলের ডান হাত আউলের বুকে। বাম দিকের দেয়ালে রয়েছে আরেক চিত্রপট। মায়ের কোলে শিশু, দু’জন যুবতী একজনের হাতে পতাকা। গেঞ্জী পড়া এক কিশোরপতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে । এই ভাষ্কর্যটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে কংক্রিট।
এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী ভাস্কর্য। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতীকি ভাস্কর্য গুলো রয়েছে তার মধ্যে প্রকাশ ভঙ্গীর সরলতা, গতিময়তা, মুক্তি যুদ্ধের চেতনার তেজস্বী প্রকাশ এবং নন্দন তাত্বিক দিক থেকে এই ভাস্কর্যটি অনবদ্য ।স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত সাক্ষ্য। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্ম চারীদের বলিষ্ঠ সাহসী ভূমিকা ছিল। ঘটনার আর্বতনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই তাতে জড়িয়ে পড়েন। অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শাহাদাৎ বরণ করেন।

সহযোগিতায়:বিভিন্ন ব্লগ,মানব কণ্ঠ,এবং অন লাইন

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ