দিনটি ছিল ঝলমলে রুদ্রজ্জল, ২০১২ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ  প্যারিসের গার-দু- নরড রেল ইস্টিসন থেকে থালেজ ট্রেনে চেপে বসলাম, গন্তব্য ব্রাসেলস মিডি রেল ইস্টিসন, বেলজিয়াম। হাই স্পিড ট্রেন ঘন্টায় প্রায় ৩০০ কি/মি বেগে চলে। সত্যি বলেতে এইটা আমার প্রথম আন্তদেশীয় ট্রেন ভ্রমন। বিমানে চরেছি অনেক কিন্তু ট্রেনে চরে দেশ ভ্রমন এই প্রথম।

কিছুটা নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার অধীর আগ্রহে বসে আছি জানালার পাশে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে লাগল, প্রেমের নগরী প্যারিস ছেড়ে চলে যাচ্ছি, নতুন দেশের আগমনী হাতছানির উত্তেজনা আর প্যারিসকে বিদায় জানানোর বেদনা দুইয়ে মিলে আমি যেন নতুন এক ভূবনে ডুব সাতার খেলছি।

কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে চলল, আমি অবাক দৃষ্টিতে জানালায় বাইরে তাকিয়ে আছি, এত সুন্দর প্রকৃতি এর আগে কোনদিন দেখিনি। অনেক দূরে দূরে এক একটা খামার বাড়ি দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় আমাদের বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা কেলেণ্ডারের পাতা উল্টে যাচ্ছি।

দেখছি আর ভাবছি এত সুন্দর পৃথিবী অথচ সামন্য কয়েকটা দিনের আয়ু নিয়ে কেন আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাই। পৃথ্বীটা কত সুন্দর অথচ তার খুব সামান্যই আমরা দেখে যেতে পারি। একটা জিওডাক কেন বেঁচে থাকে ১৬০-১৭০ বছর! একটা তুয়াতারা কেন বেঁচে থাকে ২০০ বছর! একটা কচ্চপ কেন বেঁচে থাকে ২৫০ বছর!! আমরা কেন মানুষ কেন নই!!!

কিছুক্ষন পর সংকেত এলো আমারা ব্রাসেলসে চলে এসেছি, ট্রেনের গতি কমে এলো, দেখতে দেখতে ১ ঘন্টা ৩১ মিনিট পার হয়ে গেলো। নতুন দেশ নতুন শহর অন্যরকম একটা উত্তেজনা। ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে  নেমে পরলাম, ইস্টিসনের বাইরে আমার বন্ধু অপেক্ষা করছে, আমাকে দেখা মাত্র হাত নেড়ে ছুটে এল। অনেক দিন পর বন্ধুকে কাছে পাওয়া। প্রবাসের মাটিতে প্রিয় মানুষ জনের আকস্মিক কাছে পাওয়া বরাবরই অন্যরকম আনন্দের সূচনা দেয়।

দুজনেই টেক্সি চড়ে বসলাম, গন্তব্য ইথারবেক, ছোট্ট এই শহরটা এত সুন্দর আর পরিপাটি যে যেদিকে তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। আর মনে মনে ভাবি ইস আমাদের ঢাকা শহর যদি এমন সুন্দর ছিমছাম পরিপাটি হত!!! দীর্ঘশ্বাসটা লুকিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা আমাদের গন্তব্যে চলে এসেছি, আমার বন্ধু একটা স্টুডিও ফ্লাট নিয়ে থাকতো, শহরটার মত বন্ধুর ছোট্ট ফ্লাট খুবই ভাল লাগল। তারপর গোসল, দুপুরের খাবার, দুই বন্ধুর জমিয়ে আড্ডা।

দিনের আলো ঝিমিয়ে এলো, পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দুই বন্ধুর ভ্রমন পিয়াসু মন আর কিছুতেই ঘরে থাকবে না, তাই মনের সাথে যুদ্ধ না করে বের হয়ে গেলাম আমার প্রথম গন্তব্য Parc du Cinquantenair (পঞ্চাশতম বার্ষিকী পার্ক), চমৎকার একটা পার্ক, সাথে সুবিশাল খোলা মাঠ। জায়গাটা এত বড় আর এত নয়নাভিরাম যা আমার খুদ্র লেখনীতে প্রকাশ করতে পারব না। এক পাশে পানির ফুয়ারা, অন্য পাশে মিঊজিয়াম, তার উপর শত শত পর্যটক। হাটি হাটি পা পা করে কখন যে রাতের নীরবতা চলে এল বুজতেই পারিনি,  ঘরে ফেরার পালা এখন।

Parc du Cinquantenaire, BrusselsParc du Cinquantenaire, Brussels 2                                                               Parc du Cinquantenair (পঞ্চাশতম বার্ষিকী পার্ক)

ভোরের সোনালি আলোয় ঘুম ভেঙ্গে গেছে, টেবিলে রাখা ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন গাইডটা  একটু নেড়ে চেরে দেখছি, ফ্রেশ হয়ে নাস্তার পাট চুকিয়ে শরু করলাম নতুন যাত্রা, গন্তব্য ইউরোপিয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট হাউস, সুবিশাল কাচের বিল্ডিং সত্যিই খুব মনমুগ্ধকর।

EU Parlament House, Belgium                                                 ইউরোপিয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট হাউস, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম।

চা বিরতি শেষ করে মেট্রো ট্রেনে চেপে বসলাম গন্তব্য “দ্যা অটোমিয়াম” ১৯৫৮ সালের ব্রাসেল ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার এক্সপো ৫৮ উপলক্ষে নির্মিত অন্যতম সুন্দর এক ভাস্কর্য। না আর অপেক্ষা করা যাবে নাহ, খাবারের বেলা যে পার হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সুকান্ত সাহেবের জলসানো রুটি পূর্ণিমা চাঁদের কথা। দেরি না করে চলে গেলাম পার্শ্ববর্তী রেস্তুরায়, খাবারের দামটা যদিও একটু বেশী ছিল কিন্তু ঊপভোগ করার মত খাবার ছিল, বেলজিক ট্রেডিশনাল ডিশ “কারবোনাদ ফ্লেমন্দ”।

Atomium in Brussels, Belgium                                                                   অটোমিয়াম ব্রাসেলস, বেলজিয়াম।

বেলজিয়ামের ৩য় দিবস, গন্তব্য, দ্যা গ্র্যান্ড প্লেস, আর তার পাশে “দ্যা সিটি টাউন হল” ইউরোপিয়ান স্থাপত্য গুলি বরাবরই আমার খুব ভাল লাগে, এত সুন্দর, এত মন মুগ্ধকর যে দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছা করে না। তারপর চলে গেলাম রয়াল মিঊজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, মোফ মিউজিয়াম, দ্যা রয়্যাল প্যালেস অফ ব্রাসেলস যদিও বেলজিক রাজা রানির আবাসন ঐ প্যালেসে নয় তবু রাজবাড়ী বলে কথা!

Royel Palace of Brussels                                                                      দ্যা রয়্যাল প্যালেস অফ ব্রাসেলস।

The Grand Place, Brussels                                                                    দ্যা গ্র্যান্ড প্লেস অফ ব্রাসেলস, বেলজিয়াম।

 

Foret des soignes, Brussels                                                                   সনিয়ান ফরেস্ট, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম।

চতুর্থ আর শেষ দিন যাত্রা শুরু “সনিয়ান ফরেস্ট’’ কেন জানি মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেল, ব্যাস্ত শহরের মাঝে বন জঙ্গল, কত সাজানো গোছানো ওদের জীবন, আর আমরা?? শহর তো অনেক দূরের কথা গ্রামের জঙ্গল কেটে সাবার করে দিচ্ছি অজানা মঙ্গলের আশায়। আমি প্রকৃতি ভালবাসি, বনের নিরবতা আমাকে অন্যরকম প্রশান্তি দেয়, পাখির কোলাহল, মেঠো পথ, ঝরা পাতার শব্দে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অজানা পথে। হারিয়ে যেতে চাইলেও হারানো হয় না, ফিরে আসি আপন ঠিকানায়। সময় শেষ হয়ে যায় শুধু শেষ হয়না জীবনের পথচলা।

 

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ