বোবা ভাষা (পর্ব- ০৩)

এস.জেড বাবু ১৯ জুন ২০২০, শুক্রবার, ০৮:৩৩:১৮অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

যখন স্ব-দলবলে আলোকপতি অধিগ্রহন করে আঁধারের বসতি, ক্লান্ত শেয়ালের গলা ভাঙ্গা চিৎকার স্তিমিত প্রায়, আলোর ক্ষুধায় সবুজের কুসুম ভেঙ্গে উঁকি মারে কোটি কোটি নিষিক্ত কলির ভেতর ঘুমন্ত পাপড়িগুলো, পরগাছার লিকলিকে ডগা সুযোগ বুঝে মেলে দেয় আরও চারটি পাতা, দু’দুটি খুড়ি। দুইপাশে দুটি সুঁড় ফাঁটা বাকলের খাঁজ আঁকড়ে ধরে চার ইঞ্চি মতো বাড়িয়ে নেয় নিজের দৈর্ঘ্য।

ওদের জন্মান্তরের তৃষ্ণায় আর আলো আঁধারের ঢাল তলোয়ারহীন যুদ্ধের মহিমায় চারপাশের বাতাসে ভর করে মিহি কুয়াশার অসচ্ছ আস্তরণ। যেন শেষবারের মতো শৈত্যসূধা পাণ করতে ব্যাস্ত- ধরিত্রীর নিত্য নিশিথ তৃষা।

এখনো নড়ে চড়ে উঠেনি কাক, কোকিল। নড়ে উঠেনি হাজারো / লাখো রং আর আকৃতির স্তন্যপায়ী, তৃণভোজী আর মাংসাসী প্রাণীকূল।

তিন সেকেন্ড হলো ভূমিষ্ট হয়েছে সন্তান, প্রসব যন্ত্রনায় জ্ঞান হারাতে হারাতে সঞ্চিত ফিরে পায় একাকী মা। কিছু একটা নেই, শেষ পেয়ালা পানির জন্য যেমন আটকে থাকে শেষ বেলার শেষ নিঃশ্বাস, তেমনি কিছু একটার অভাব গর্ভদানের কষ্টে- শান্তিতে মুর্ছা যাওয়ার জন্য।

হ্যাঁ- সাড়া শব্দ নেই নবজাতকের দেহে / মুখে। অসহ্য কষ্টে যন্ত্রনায় নেতিয়ে আসা শিরা উপশিরাগুলোতে এক ঝটকায় ইচ্ছের প্রচন্ড বিদ্যুতিক শক্তি ছিটিয়ে দেয়- সতের বছরের পাগলীটার মাতৃত্বের মমতা।

মস্তিষ্কের যে অংশে মাতৃত্ব লুকয়ীত থাকে, তা বিধাতার নিজগুণে তৈরী করা সুরক্ষিত গুপ্ত কুঠুরী। অত্যাচার, অনাচার, অভাব, হীনতা বা কষ্ট যা ই হউক, দুনিয়ার কোনও অনুভুতি সে কুঠুরীর সঞ্চিত অনুভবে স্পর্শ বা বিচরণ করতে পারে না বিধায়, পাগলীরাও মা হয়, ওদের সন্তান ও দুনিয়ার আলো দেখে।

মিলি সেকেন্ডের ক্ষিপ্রতায় রক্তাক্ত তুলতুলে নিথর মাংসপিন্ডটাকে বুকে তুলে নিয়ে আকুতি ভরা চাহনিতে উর্ধ্ব গগণে মুখ তুলে পাগলী মায়ের অষ্পষ্ট উচ্চারণ- বাঁচাও, বাঁ...চা...ও।

কলঙ্কিত গর্ভধারণের সামাজিক তিরষ্কার এতটা তিক্ষ্ন যে পাগলিটাও বুঝতে পেরেছিলো হয়ত। যে সমাজ আর সভ্যতা তাকে মধ্য রাত্রির অসভ্য নগ্ন পাশবিকতা থেকে আড়াল করতে পারেনি, ওরাই করে তিরষ্কার। তাইতো লোকালয় ছেড়ে শহরের অদুরে জঙ্গলের পাশেই কেটেছে গত চারমাস।  অন্ধকার পথের শেষ প্রান্তের আলোর খুঁটি আর এই জঙ্গল পাগলীর জীবন বৃত্তের অভ্যন্তরে পরিচিত স্মৃতিমুখর দুঃস্বপ্ন। তাইতো তলপেটের আকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে সামাজিক তিরষ্কার যখন বাড়তে থাকে, তখন জনমানবের চোখের অনেকটা আড়ালে জঙ্গলের এই অংশটাকে নিজের অস্থায়ী আবাসন করে নিয়েছিলো অনাগত সন্তানের পাগলীনী জননী।

আলসে দুনিয়া, নিস্তব্ধতার দেয়াল প্রতিধ্বনি পরে পাগলীর চিৎকার ফিরিয়ে দেয় পাগলীর কানে- বাঁ..চা..ও।

চারপাশে সুনশান নিরবতা। কুয়াসা ভেজা পিচঢালা পথে, দম আটকে থাকা সদ্য প্রসূত সন্তানের জীবন বাঁচানোর তাগিদে এক পাগলী মায়ের অন্তহীন দৌড়।

রাত্রি নামের পর্দার আড়ালে, জীবন নামের ভিবিষীকায়, ক্ষুধা নামের যুদ্ধের বিপরীতে, আধুনিক  সভ্যতার দেয়া চুড়ান্ত উপহারের চোখে এক টুকরো আলো দেয়া চাই।

আর মাত্র দশগজ দুরেই আলো। হটাৎ সামনে থেকে রাত্রির নিরবতা খানখান করে ঝলমল করে উঠে হেডলাইটের তিক্ষ্ন আলো, রাবার পাথরে ঘর্ষনের শব্দের সাথে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে চিৎকার করে উঠে চারচাকা সভ্যতার ব্রেক।দুই পায়ের হাঁটুতে প্রচন্ড ধাক্কা। উত্তপ্ত পিচ আর টায়ার পোড়া গন্ধ নিতে নিতে রাস্তার পাশের ভেজা দুর্বাঘাসে লুটিয়ে পড়ে পাগলীর দেহ।

চিরকালের মতো ঘুমের কোলে লুটিয়ে পড়ার আগে মাথা ঘুড়িয়ে রাস্তায় চোখ মেলে পাগলী। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পায়, হাঁটু গেড়ে বসে কেউ একজন তার প্রসবিত রক্ত ভেজা মাংস পিন্ডটাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। মরনকালে শেষবারের মতো একটা নবজাতকের চিৎকারের শব্দ শুনে খুশি হলেও, পাগলিটা প্রচন্ড ইচ্ছায় বুঝতে ব্যার্থ হয়- বাচ্চাটা ছেলে ! না মেয়ে !!

 

চলবে____

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ