বোবা ভাষা- পর্ব – ০৫

এস.জেড বাবু ২২ জুন ২০২০, সোমবার, ০৪:০৫:২৯অপরাহ্ন গল্প ২৫ মন্তব্য

কোটি মানুষের সুখ দুঃখের গল্প কাছাকাছি রকম হয়। অনেকটাই সিনেমাটিক। নব্বইয়ের দশকে বাংলা ছায়াছবি প্রথম ত্রিশ মিনিট দেখলেই শেষটা অনুমান করা যেত। ছেলেবেলায় ভিলেনের হাতে নায়কের পিতা খুন, মা ধর্ষিতা। বড় হওয়ার পর ভিলেনের মেয়ের সাথে (খুন হওয়া পিতার বেঁচে যাওয়া সন্তান) বর্তমান নায়কের হৃদয় ঘটিত সম্পর্ক। এরপর প্রতিশোধ। শেষবেলায় রাইফেল হাতে ঘটনাস্থলে পুলিশ। হাহাহা বহুলাংশে কমন কাহিনি।

তবুও দর্শক মনযোগ নিয়েই তিন ঘন্টা সিনেমা হলে বসে থাকতো। কারণ গল্পগুলো একরকম হলেও প্রতিটি চরিত্রের চাওয়া পাওয়া একরকম নয়। একরকম নয় ঘটনার প্রেক্ষাপট, চিত্রায়ন আর কল্পিত গানের কথা।

কখনও গল্পগুলো একটু ভিন্ন রকম হয়। চরিত্রগুলোর কেউ কেউ নিজ নিজ কৃতকর্মের ফল ভোগ করে জীবদ্দশায়, কেউ ভোগে আপনজনের প্রায়শ্চিত্তের শোক-তাপ আর কেউ ভোগে পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের ফলাফল। জীবন থমকে গেলেও প্রায়শ্চিত্ত থেমে থাকে না, পরবর্তি বংশধরের কাঁধে চড়িয়ে পূর্বপুরুষদের পাপ পুণ্যের ভাগশেষ,  অনাগত জীবনের দৃশ্যপটে বিধাতা  নিজ হাতেই বন্টন করেন। তাই হয়তো গল্পের ও শেষ বলতে  আপাত দৃষ্টিতে কিছু থাকলেও, রেশটা সেখানে হিডেন ভাইরাসের মতো আপন রক্তপ্রবাহে জড়িয়ে থাকে।

মাকসুদা বেগম, রীতা আর মাসুদের গল্প থেমে থাকেনি। সে রাতে মাসুদ এমিরেটস এয়ারলাইনের বিজনেস ক্লাশের আরাম চেয়ারে সুখনিদ্রায় আপন রক্তের সন্তানকে নিয়ে যে আগামীর স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা আধো সত্য আর আধো মিথ্যার সংযোগে জর্জরিত ছিলো।

সেই একই রাতে মাকসুদা বেগম জীবনে প্রথম স্বভাব বিরুদ্ধ টেনশন মাথায় নিয়ে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। ঘটে যায় অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা সবসময় অভিশাপ হয়না, কখনও কারও ক্ষেত্রে আশির্বাদ ও হয়। প্রচন্ড জোড়ে ব্রেক করার পরও যথাসময়ে থামেনি গাড়ি আর থামেনি ভাগ্যের চাকা। পাগলিটা ছিটকে পড়ে ছয়ফিট দুরে, আরও চারফিট মতো গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তার পাশে। বাচ্চাটা আছড়ে পড়ে উইন্ডশিল্ড এর উপর, খানিকটা গড়িয়ে থামে ওখানটায়- যেখান থেকে হেডলাইটের আলো পিচঢালা পথ ছুঁয়েছে।

প্রথমত দুর্ঘটনা টা সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় এক্সিলেটরে ডান পায়ে জোড় দিচ্ছিলেন মাকসুদা বেগম। দৃষ্টি পড়ে পথে পড়ে থাকা পাগলীর পুঁটলীমতো (ঝুলি) কাপড়ের দলাটার উপর । ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে একটু সুনজরে তাকাতে চেষ্টা করেন তিনি। আঁৎকে উঠেন মধ্যবয়সী শুশিক্ষিতা নারী।

ধবধবে সাদা নরম লিকলিকে একটা হাত বেড়িয়ে আসে ছোপছোপ রক্তে ভেজা কাপড়ের দলাটার ভেতর থেকে। ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুল গুলো ধীরে ধীরে মুঠিবদ্ধ হতে থাকে। তিব্র আলোর ফোয়ারায় ষ্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন মাকসুদা বেগম- বাচ্চাটা হাতের ইশারায় যেন তাকেই কাছে ডাকছে। খুলে গেল এক্স করোলা ৯৬ মডেলের ডান পাশের দরজা। বাচ্চাটাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে গেলেন খানিক দুরে পড়ে থাকা বাচ্চার মায়ের কাছে। ততক্ষনে ঝুলে পড়েছে পাগলীর হাত, খোলা চোখ স্থীর, কাত হয়ে আছে মাথা, বাচ্চাটাকে কোলে রেখে পাগলীর নিঃশ্বাস পরীক্ষা করেন- কিংকর্তব্যবিমূড় হয়েও মুহুর্তেই জীবনের সবচেয়ে জটিল সরল অংকের সহজ সমাধান বের করেন মাকসুদা বেগম।

কথায় বলে, অন্ধকার পেড়িয়ে আলো আসে, পরদিন সকালটা চমৎকার ছিলো রীতা মাসুদের জীবনে। রীতা প্রথমে মেয়ে সন্তান দেখে কেমন যেন বিব্রত বোধ করলেও বাচ্চাটাকে কোলে নেয়ার পর সে পরিস্থিতি বদলে গেছে। মেয়েটার চোখের পাঁপড়ি হুবাহু মাসুদের মতো কুচকুচে কালো আর বড় বড়। মাসুদের মতই হাসলে ডান গালে টোল পড়ে। সনোগ্রাফিতে হয়ত ভুল রিপোর্ট দিয়েছিলো ডাক্তার। সবচেয়ে বড় বিষয়, মেয়েটার ঘাড়ের পিছনে বামদিকে পঁচিশ পয়সা কয়েনের সমান চামড়া কালোমতো, লম্বা আর ঘন পশম দিয়ে আবৃত। মাসুদের ঘাড়ের পিছনের দাগটা এক টাকার কয়েনের সমান হবে। একদিন প্রশ্ন করেছিলো রীতা, জবাবে মাসুদ বলেছিলো “এটা জন্মদাগ”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মাকসুদা বেগম। প্রিয় ছাত্রী ডা. সুমীকে সবটুকু বিষয় সহজে বোঝানো গেলেও কঠিন ছিলো কাজের বুয়াকে বিষয়টি বুঝানো। শেষতক কিছু অতিরিক্ত টাকা পয়সা হতে দিয়ে তাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন মাকসুদা বেগম।

পরদিন স্থানীয় পত্রিকার হেডলাইন পড়েন কম্পিত চোখে- “গভীর রাতে মিয়া বাড়ি জঙ্গলের পাশে চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় সদ্য প্রসূত ছেলে বাচ্চা সহ পাগলী মায়ের মৃত্যূ”- ঘাতক পলাতক।

এরপর কেটে গেল ততগুলো বছর, যতগুলি বছর শেষে চৌদ্দ’তে পা রাখে সেদিনের সে মেয়ে বাচ্চা “নিশী। হ্যাঁ আজ তার নাম আছে। সময়ের দুর্দান্ত হিসেব নিকেশ শেষে মেয়ে আর জামাইয়ের প্রচন্ড ইচ্ছায় নাতনীর নাম রাখেন মাকসুদা বেগম। ঘরে প্রিয় নাতনী, নিজের স্কুলে প্রিয় ছাত্রী।

নিশী’র যখন আট বছর তখন ভাড়া করা বাসাটা নিজের জমানো টাকায় কিনতে চায় মাসুদ রীতা দম্পতি।  সুযোগ  বুঝে নাতনী নিশীর অষ্টম জন্মদিনের গিফট হিসেবে, সে বাড়ির দলিল মাসুদের হাতে তুলে দেন মাকসুদা বেগম। জীবনের যা কিছু সঞ্চয় সবই ওদের। তবুও কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়েটার জন্য নিজেস্ব কিছু বিলিয়ে দিয়ে নিজের অপরাধবোধ কিছুটা হাল্কা করতে চান তিনি।

এমনিতেও নিশী ভিষন চটপটে। কথায় কথায় খিলখিল করে হাসে। মা রেগে গিয়ে প্রচন্ড রকম বকা দিলেও হাসে। স্কুল ব্যাগে কাঁদা মেখে বাড়ি ফিরে বকা খায়, তবু হাসে। মাসুদের জান লুকিয়ে থাকে নিশীর হাসিতে। মেয়ের হাসি দেখে নিজেও মুখ টিপে হাসে আর মনে মনে ভাবে- মা যতটা না স্বল্পভাষি আর গোছানো- মেয়ে তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি দুরন্ত আর চটপটে।

কখনও রীতা মাসুদের ছোটখাটো ঝগড়া হলে নিশি স্কুল থেকে ফিরে মায়ের মুখ দেখেই বলতে পারতো- বাবা বকেছে। উচ্চস্বরে বারান্দায় হেলান চেয়ারে বসে থাকা বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মিমাংসা করতো নিশী। বাবা টা ভিষন বেড়েছে। মা এক কাজ করো। তুমি নানী বাসায় চলে যাও। আমি বাবাকে নুন ছাড়া ভাতই খাওয়াবো। হার্টের অসুখ আর ডায়বেটিক্স থাকার পরও তুমি তাকে যা তা খেতে দাও। চায়ের সাথে চিনি দাও।

ইশশ ভালোবাসা !! ভালোবাসার মানুষের হাতে নুন চর্বি খেলে হার্টের ব্যাথা বাড়ে না। চা তে চিনি খেলেও ডায়বেটিক্স কন্ট্রোলে থাকে। এতো ভালোবাসা থাকলে বাবা তোমাকে জ্বালাতন করে কেন? আজ বাবার একদিন কি আমার একদিন।

 

চলবে___

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ