বন্ধু মেজদা

রিতু জাহান ২ মার্চ ২০১৬, বুধবার, ০৫:০৭:১০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৪৫ মন্তব্য

প্রিয় বন্ধু মেজদা,

যেখানে অনেক কথার ঝুড়ি ভরে ফেলি, সেই নির্ভরতার, সেই সম্পর্কের একটাই নাম, সে শুধুই বন্ধু। মানুষের খারাপ ভাবনা বা সম্পর্কের মানে বদলে দেয়ার চেষ্টায় সে সম্পর্কে কালো ছাপ পড়ে যায়। অনেক সময় দুর্গন্ধও ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষ।

এখানে কালো ছাপের দাগ ছাড়া দুর্গন্ধ ছড়ায়নি কারণ সেখানে রক্তের সম্পর্ক ছিল, বয়সের পার্থক্য ছিলো অর্ধেকেরও বেশি। তবুও তুমি আমার বন্ধু মেজদা। আমার দুষ্টামির লাগাম টেনে ধরা, আবার দুষ্টামির জন্য লাগাম ছেড়ে দেওয়ার স্বাধীনতা তুমিই দিয়েছো। তুমি ছিলে আমার নির্ভরতা। তুমি যখন ঢাকা পড়তে, ছুটি হলে সোজা আমাদের বাসায় আসতে। আমি সব কথা তোমায় বলতাম,স্কুলের কলেজের সব কথা। তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনতে। একটুও বিরক্ত হতে না।

তোমাদের বাড়িটা ছিলো আমার অবাধ দুষ্টামির জায়গা। যখন সব ভাই বোনরা বেশি হইহুল্লোড় করতাম, তুমি বাড়িতে ঢুকলে সবাই চুপ। সবাই তোমায় খুব ভয় করতো, শুধু আমি ভয় পেতাম না।

তুমি আমায় বলতে অনেক কিছুই আমি বুঝিনা। বুঝতেও চাই না। তুমি কিন্তু চাইতে যে আমরা বোনেরা ছোটই থাকি। শিশু সুলভ আচরণগুলো থাক অনেকদিন পর্যন্ত। কিন্তু মেজদা, যে বাড়িতে বড় ভাই বোনেরা সাহিত্য চর্চা করে, দিনে রাতে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখে সেই বাড়ির কলেজ পড়ুয়া মেয়ে প্রেম করবে না! তাই যখন জুলফিকারের কথা তোমায় বললাম, তুমি হঠাৎ একটু চুপচাপ হয়ে গেলে। তবুও মনোযোগ দিয়ে শুনলে।

তুমি বাড়িতে আসলে তোমার হাতের দিকেই আগে আমি তাকাতাম। কি খাবার এনেছো তাই দেখতাম। সবাই বলতো তোর মেজদা আনছে , কেউ তো আর ভাগ পাবে না। চিপস্ আমার খুব প্রিয় ছিলো, তুমি তাই ওটা আনতেই।

জুলফিকারের সাথে দেখা হওয়ার সব কথাই তুমি খুটে খুটে শুনতে। তোমাকে যেদিন বললাম, জুলফিকার আমার জন্য চিপস্ এনেছিল, শুনে তুমি কি যে হেসেছিলে! রেগেছিলাম আমি খুব। বলেছিলে প্রেম করছিস এখন একটু বড় হ।

একদিন তোমায় বললাম, কেয়া নামের এক মেয়ে পি.সি কলেজে পড়ে , ঐ মেয়ে জুলফিকারকে চিঠি দেয়, থানার ফোনে গানও শোনায়,"তুমি আমার প্রথম সকাল"তখন বলেছিলে ' সিরিয়াস হ,আর কতো ছোট থাকবি বলতো!'

যেদিন দুলাভাই আমায় বলল, তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা সবাই চিন্তা করছে, শুনে আমি দীঘির পাড়ে কতক্ষণ বসেছিলাম মনে নেই। তবে সেদিন দুলাভাইকে শুধু বলেছিলাম,ও তো আমার মেজদা, আমার বন্ধু।

তুমি জান মেজদা, সেদিনই আমি সত্যি বড় হয়ে গেছিলাম। আর কোনোদিন তোমাদের বাড়ি যাইনি। তোমাকেও কিছু বলিনি। তুমিও কোনো প্রশ্ন করোনি।

এখন অনেক ভিড়ের মাঝে হঠাৎ আমার দিশেহারা লাগে। মাঝরাতে হঠাৎ কখনও ঘুম ভেঙ্গে গেলে লক্ষ করি, তোমাকে না বলা কথাগুলো আমার জমে পাথর হয়ে গেছে। এখন আমি আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠি, একি সেই আমি! হায়রে আমার স্মৃতির সোনালী প্রহর! আয়নায় অনেকক্ষণ দেখার পর আমি অতীত থেকে জীবনটাকে বর্তমান বিন্দুতে এনে রাখি। এখানেও যে আমার অনেক সুখ। সত্যি বলছি আক্ষেপ নেই। বৃষ্টি এলে বড় মিছিলও ভেঙ্গে যায়। জীবনের বাস্তবতায়,আমার কথার ভিড় ও ভেঙ্গে যায়।

তোমার মনে আছে আমার প্রেম যেন নিশ্চিন্ত পেম হয়, তাই তুমি কেয়া আপুকে বলেছিলে, জুলফিকারকে যেন ফোন না দেয়, চিঠি না লেখে। ও সম্পর্কে আমার ও বোন হয়।

এখন কি আমার নিশ্চিন্ত জীবন? হ্যাঁ এখন অন্তত তা বলতে পারি যে আমার নিশ্চিন্ত জীবন। একটি দুটি ছোটখাটো অভাব বোধ এবং কখনও কখনও সামান্য একটু এক ঘেয়েমি ছাড়া আর কোনো হিসাব অন্তত আমি করিনা। তবে অভিমান জমানো অনেক। তোমার অনেক কথা এখন বুঝি, ঐ যে বলতে এতো পাগলামি করিস, একটু বড় হ,সবাই তোর মতো ভাববে এমন কথা ঠিক না, সবাই সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেয় না।

তুমি ঠিকই বলেছো। আসলে মায়ের পেটের ভাই ছাড়া সবাই সব ছেলেমেয়ের নির্মল বন্ধুত্ব কেও যৌনতার মোড়কে জড়িয়ে দেয়। আসলে কি জান, আমরা উপন্যাস পড়তে পড়তেও কিন্তু নায়ক নায়িকার সহজ সরল প্রেমকে একঘেয়েমি মনে করি। একটু যৌবন সুড়সুড়ি আমরাও চাই। এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন বুঝতে পারি অনেক কিছু। আমি ঠিক মোহনার কাছে পৌছানো এক নদী। যার স্রোত আছে কোনো ঢল নেই। সামনে শুধু মহা সমুদ্র। সেই নদী বয়ে চলতে হঠাৎ এক বাঁক, ঐ বাঁকে যে ছোট সমুদ্র, সেই সমুদ্রে প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটার খেলা। আমি যখন একটু বাঁক ফিরতে চাই, সমুদ্র উল্টো স্রোতে বয়। কি যে তার অভিমান! রাগ বড় বেশি। অহংকার তার খুব বেশি।

আমি বার বার সূর্যকে ভালোবেসে সূর্যকে অহংকারী বানিয়ে দেই। অভিমান এখন আমারও ,তাই তো শিউলি আমি। সূর্য উঠার আগেই ঝরে পড়ি।

ইতি তোমার -
মৌনতা

[ জিশান ভাইয়ার বন্ধুকে নিয়ে লেখাটি পড়ে আমার বন্ধুকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে জাগ্রত হল , তাই এই লেখা ]

0 Shares

৪৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ