একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা’ও আমাকে বলছিলেন, “বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে বলিও না।” শেরে বাংলা মিছামিছিই ’শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করেছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠণ করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন—দাঁড়িয়ে বললেন, ”যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরীবের বন্ধু হক সাহেব।“ এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এটুকুই না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে। কয়েকবার মার খাওয়ার পরে আমাদের বক্তৃতার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। পূর্বে আমার দোষ ছিল, সোজাসুজি আক্রমণ করে বক্তৃতা করতাম। তার ফল বেশি ভাল হত না। উপকার করার চেয়ে অপকারই বেশি হত। জনসাধারণ দুঃখ পেতে পারে ভেবে দাবীটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করতাম।
পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ’পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও। আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হাবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের ‘পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও ‘পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা; এই দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্থের মত ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত।
সিপাহি বিদ্রোহ ও ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল। কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বানিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হল—মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ২২ ও ২৩ )
১৪টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
অল্প অল্প করে পড়ছি, জানছি বঙ্গবন্ধুকে। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
🙂 অনুপ্রাণিত হচ্ছি।
ব্লগার সজীব
আপনার অন্য লেখাগুলোও খুব মান সম্পন্ন হয় আপু। আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হই আমরা। রেগুলার আসুন আপু।
লীলাবতী
কত সহজ স্বীকারোক্তি ! হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বললে জনতা মারপিট করতো। এমন স্বীকারোক্তি আজকালকার রাজনৈতিক নেতারা দেবেন না। নিয়মিত লিখছেন আপু, ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এগুলোই তো ভালো লাগার বিষয়, যা আজকালকার নেতাদের মধ্যে দেখা যায় না। অকপটে সত্যকে স্বীকার করে নেয়ার মতো সাহসিকতার মধ্যে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তা বঙ্গবন্ধুকে এভাবে না পড়লে জানা যেতো না। এসব গুণাবলীই তাঁকে কিংবদন্তীতুল্য করেছে।
জিসান শা ইকরাম
আমার মন্তব্য লীলাবতীই করে দিয়েছেন। কত অবলিলায় বলে গিয়েছেন এসব বঙ্গবন্ধু !!
বৃটিশরা এসেই আমাদের হিন্দু মুসলিম বিভেদ টা তৈরী করে দিলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ইতিহাস পাঠ থেকেই জানা যায় বৃটিশরা এই বাংলায় হিন্দু মুসলিম বিভেদের কি বিষবৃক্ষ রোপণ করে গিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা থেকে এমন আরোও সত্য কিছু তথ্য আমরা জানতে পারবো।
ধন্যবাদ আপনারও প্রাপ্তি সোনেলা’য় লিখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। (y)
খসড়া
সব মন্তব্য পড়ে আর কিছু লেখার পাচ্ছিনা। বইটা যেহেতু আগেই পড়েছি তাই মন দিয়ে মন্তব্যগুলি পড়ি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
(y)
দীপংকর চন্দ
অত্যন্ত সুলিখিত এবং অত্যন্ত সুসম্পাদিত একটি বই।
আপনার শ্রমসাধ্য প্রয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা থাকছে। অনেক।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আপনাদের অনুপ্রেরণা আমাকে উৎসাহিত করবে। (y)
নীলাঞ্জনা নীলা
ব্রিটিশ সকল সর্বনাশের মূল। আসলে তাই কি? ঘরের ভেতর যদি একতা না থাকে, বাইরের লোক এসে ঘর সহজেই ভাঙ্গতে পারে।
কোনো একতাবদ্ধ জাতিকে কেউ আলাদা করতে পারে না।
লিখুন আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
খুব সত্য কথা। কিন্তু বাঙালী কানকথায় বিশ্বাসী আর এটাই এ জাতির সকল সর্বনাশের কারণ। চিলে কান নিয়েছে শুনেই চিলের পেছনে দৌড়। এখনো তো তেমনটাই দেখা যায়। নইলে সাইদীকে চান্দে দেখা গেছে শুনে কি লঙ্কাকাণ্ডই না ঘটে গেলো এদেশে!!! ;(
আর এখনো শিক্ষিত (অবশ্যই আমি এদের প্রকৃত জ্ঞানী নয়, কেবল অক্ষরজ্ঞানে পূর্ণ বলবো) লোকেরা ব্লগার বলতেই ধর্ম বিদ্বেষী বলে মনে করে। সেদিন তেমনি এক অক্ষরজ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি লন্ডনের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্প্রতি ডিগ্রী অর্জন করতে যাচ্ছেন, তাঁকে প্রশ্ন রেখেছিলাম “ব্লগার শব্দের প্রকৃত মিনিং জানেন? না জানলে ইন্টারনেট ঘেটে জেনে নেন।”
এই হচ্ছে বাঙালীর অবস্থা।
অপার্থিব
শেরেবাংলা ও শ্যামাপ্রসাদ অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার পক্ষে ছিলেন। কিন্ত তার মন্ত্রীসভা দেশভাগ পূর্ব বিভিন্ন সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতা ও বাংলার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়ীকতা পরবর্তীতে দেশভাগকে অনিবার্য করে তোলে। শেখ মুজিব যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাকে আবার স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হয়েছিল। এটাই তার অন্যতম বড় রাজনৈতিক ভুল।